সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: হত্যা পাপ না পুণ্য?
আমার, আপনার মতো সাধারণ মানুষের কাছে ব্যাপারটা যা-ই হোক না কেন, ক্ষত্রিয়মতে শত্রুসংহারের চেয়ে বড় পুণ্যের আর কিছুই নয়। অশ্বত্থামাও তা-ই করেছিলেন! তাঁর যে ভাবেই হোক, কাজটা অন্যায় বলে মনে হয়নি।
কেন, তার জন্য পিছিয়ে যেতে হবে মহাভারত-এর কিছু পাতা উলটে!
তখন কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ শেষ হয়ে গিয়েছে। পাণ্ডববাহিনীর হাতে একে একে মৃত্যু বরণ করেছেন কৌরব শিবিরের বহু বীর সন্তান। পরাজিত, লাঞ্ছিত দুর্যোধন আর উপায় না দেখে আশ্রয় নিয়েছেন দ্বৈপায়ন হ্রদের অতলে।
Advertisement
কিন্তু, সারা জীবনে তো তাঁর সমস্যা বলতে ছিল কেবল একটাই- অহং! সেই অহঙ্কারেই ঘা দিলেন পাণ্ডবরা। দ্বৈপায়ন হ্রদের তীরে এসে।
এবং, সম্মুখ সমরের আহ্বান এড়াতে পারলেন না দুর্যোধন। উঠে এলেন জল থেকে। শুরু হল ভীমের সঙ্গে গদাযুদ্ধ।
সেই যুদ্ধে কী হয়েছিল, তা নতুন করে না বললেও চলে। দুর্যোধনের ঊরু আর অহং- দুই ভঙ্গ হয়েছিল ভীমের গদাঘাতে।
ওই সময়েও কিন্তু দুর্যোধনের একটা সান্ত্বনা ছিল ঠিকই! ধূলায় লুণ্ঠিত, রক্তাক্ত জ্যেষ্ঠ কৌরবকে কথা দিয়েছিলেন দ্রোণাচার্যের পুত্র অশ্বত্থামা- দুর্যোধনের অপমানের প্রতিশোধ তিনি নেবেনই! ভীম যেমন ছলনায় হারিয়েছেন দুর্যোধনকে, সে ভাবেই তিনিও ছলনায় জনহীন করবেন পাণ্ডবশিবির।
যেমন ভাবা, তেমন কাজ। ভগবান শিবের দেওয়া চন্দ্রহ্রাস খড়্গ নিয়ে রাতের আঁধারে পাণ্ডবশিবিরে হানা দিলেন দ্রোণপুত্র। পঞ্চপাণ্ডব ভেবে একে একে হত্যা করলেন দ্রৌপদীর পাঁচ ঘুমন্ত সন্তান প্রতিবিন্ধ্য, সুতসোম, শ্রুতকীর্তি, শতানীক আর শ্রুতসেনকে। পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নিতে ঘুমের মধ্যেই মস্তকচ্ছেদন করলেন শিখণ্ডীর। অশ্বত্থামার রোষে প্রাণ হারালেন আরও অনেক যোদ্ধাই!
পঞ্চ পাণ্ডব তখন কৃষ্ণের সঙ্গে রয়েছেন গঙ্গাতীরে। উপভোগ করছেন যুদ্ধজয়ের সাফল্য। তার মধ্যেই এই খবর যখন তাঁদের কানে এল, দ্রৌপদীর কান্নায় ভারি হয়ে উঠল চরাচর।
এবার অবশ্য অর্জুন চুপ করে বসে থাকেননি। শপথ নিলেন, তিনি এর শেষ দেখে থাকবেন। রথে চড়ে তাই ধাওয়া করলেন অশ্বত্থামাকে।
অশ্বত্থামা যখন দেখলেন অর্জুন আসছেন, তখন তিনি প্রয়োগ করলেন ব্রহ্মশির অস্ত্র। এই অস্ত্রে পৃথিবী ধ্বংস হতে পারত। বিপদ বুঝে কৃষ্ণ থামিয়ে দিলেন সেই অস্ত্র। কিন্তু, কোথাও একটা সেটা নিক্ষেপ করতেই হত। অবশেষে পরামর্শ করে সেই অস্ত্র নিক্ষেপ করা হল অভিমন্যুর স্ত্রী উত্তরার গর্ভে।
উত্তরার সন্তানকে পরে অবশ্য প্রাণ দান করেছিলেন কৃষ্ণ। কিন্তু, অশ্বত্থামাকে ক্ষমা করেননি। অভিশাপ দিয়েছিলেন, এতগুলো অন্যায় হত্যার জন্য তিনি মৃত্যুর মাধ্যমে মুক্তি পাবেন না। কলিযুগের শেষ দিন পর্যন্ত তাঁকে বেঁচে থাকতে হবে। চাইলেও আত্মহত্যা করে জ্বালা জুড়াতে পারবেন না তিনি।
আর, ক্ষতিপূরণ হিসেবে অশ্বত্থামা নিজের হাতে মাথার মণি কেটে দেন কৃষ্ণকে। কর্ণের যেমন কবচ-কুণ্ডল, অশ্বত্থামারও তেমনই ওই মণি!
তার পর?
এবার আমরা চলে আসতেই পারি বর্তমানে। অতীত হয়ে অশ্বত্থামার এই বৃত্তান্ত রীতিমতো অটুট রয়েছে বর্তমানেও। প্রচলিত বিশ্বাস, মধ্যপ্রদেশে ইন্দোরের কাছে আসিরগড় দুর্গে আজও বাস করছেন অশ্বত্থামা।
আসিরগড় দুর্গ তৈরি হয়েছিল ১৩৭ খ্রিস্টাব্দে। জানা যায়, আশা আহির নামে এক রাখাল বালক নিজের ক্ষমতায় রাজা হয়ে এই দুর্গ নির্মাণ করেন। এই দুর্গই এখন অশ্বত্থামার আবাসস্থল। বিগত ৫০০০ বছর ধরে এখানেই রয়েছেন তিনি। সবার চোখের আড়ালে।
কাহিনি বলে, আসিরগড় দুর্গে এক শিবমন্দির রয়েছে। প্রতি প্রভাতে শিব-উপাসক অশ্বত্থামা সবার আগে সেই মন্দিরে পূজার্চনা করেন। ভোরের আলো ফুটলেই দেখা যায়, শিবলিঙ্গ সাজানো রয়েছে ফুলে, চন্দনে। কিন্তু, কোথা থেকে সেই ফুল-চন্দন এল, কেউ বলতে পারেন না। বলতে পারেন না, কখন এসে অশ্বত্থামা নিত্যপূজা সম্পন্ন করেছেন।
তবে, রাতের বেলায় এই দুর্গে অনেকেই দেখেছেন দ্রোণপুত্রকে। দেখা গিয়েছে, রক্তাক্ত কপাল নিয়ে তিনি হাহাকার করে ঘুরে বেড়াচ্ছেন দুর্গে। কারও সঙ্গে দেখা হলে ক্ষতের জ্বালা জুড়াবার জন্য তিনি হলুদ আর চন্দন ভিক্ষা করেন!
কিন্তু, অশ্বত্থামার সেই ভীষণ, রক্ত-ঝরা রূপ যাঁরাই দেখেছেন, অজ্ঞান হয়ে গিয়েছেন। অনেকে উন্মাদ হয়ে গিয়েছেন চিরতরে।
চাইলে আপনি ঘুরে আসতেই পারেন আসিরগড় থেকে। কিন্তু, রাতের বেলায় ওখানে থাকার ঝুঁকি না নেওয়াই বিচক্ষণতা হবে!
আসলে, প্রখর পাপবোধ আর অভিশাপের জ্বালা নিয়ে যিনি ছটফট করছেন মুক্তির জন্য, তাঁর মুখোমুখি হওয়া বড় সহজ নয়। ভয় না পেলেও আত্মদহন হবেই! ক্ষত্রিয়বীরকে শান্তি দিতে না পেরে!
আপনি কি হলুদ-চন্দন নিয়ে আসিরগড়ে যাওয়ার কথা ভাবছেন?
ভগবান কৃষ্ণের অভিশাপ স্মরণ করুন! সেই অভিশাপ অমান্য করে অশ্বত্থামার পাশে দাঁড়ানো কি উচিত হবে?
The post আসিরগড় দুর্গে আজও ঘুরে বেড়ায় মহাভারতের এই চরিত্র! appeared first on Sangbad Pratidin.