বছর ঘুরে ফের মনসা পুজো। দৈবকৃপা নিতেই পারেন। কিন্তু আগে জেনে নিন ‘এভিএস’ দাওয়াইয়ের কথা। এই বর্ষায় জেলায় জেলায় সাপের কামড়ে বহু অঘটনের খবর রয়েছে। তাই বিপদ এলে প্রয়োগে দেরি নয়। সতর্ক করলেন সর্পরোগ-বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডা. দয়ালবন্ধু মজুমদার এবং ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতির সৌম্য সেনগুপ্ত। লিখছেন গৌতম ব্রহ্ম
‘বেহুলা কখনও বিধবা হয় না এটা বাংলার রীতি’। সত্যি কি তাই? কলার ভেলায় ভেসে যাওয়া লখিন্দররা কি সত্যিই দৈবকৃপায় বেঁচে উঠছে? ওঝা-গুনিনের ঝাড়-ফুঁক-তুকতাক কি বিষ নামাতে পারছে?
কথাটা আংশিক সত্য। এই বাংলায় প্রায় ৮১ প্রজাতির সাপ রয়েছে। এর মধ্যে মাত্র চার প্রজাতির সাপে বিষ রয়েছে। নির্বিষ সাপ দংশন করলে ওঝার মন্ত্রে ‘বিষ’ নেমে যায়! অনেকটা ‘ঝড়ে বক মরে ফকিরের কেরামতি বাড়ে’ অবস্থা। অনেক সময় আবার বিষাক্ত সাপ কামড়ালেও বিষ ঢালতে পারে না। মানে ‘ড্রাই বাইট’ হয়। সেক্ষেত্রেও চওড়া হয় গুনিনের বুকে ছাতি। সমস্যা হয় কালাচ, কেউটে, গোখরো, চন্দ্রবোড়া কামড়ালে। এই ‘মহা চার’ রক্তে বিষ ঢাললে ওঝাকে বেটে খাওয়ালেও লাভ নেই। তখন ভরসা একজনই। ‘অ্যান্টি স্নেক ভেনাম’।
সাপের বিষের অ্যান্টিডোটই এখন বেহুলা হয়ে বাঁচাচ্ছে লখিন্দরদের। তবে হ্যাঁ, সাপে কামড়ানোর ১০০ মিনিটের মধ্যে রোগীকে এভিএস দিতে হবে। যত দেরি হবে ততই রোগীর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা কমবে। এই সহজ সত্যিটা এখন অনেকটাই বুঝতে পারছেন এ রাজ্যের মানুষ। তাই সাপে কাটা রোগীর হাসপাতালে আসার প্রবণতা বাড়ছে।
সরকারের ভূমিকা এক্ষেত্রে অত্যন্ত প্রশংসনীয়। সর্পাঘাতের চিকিৎসা নিয়ে রাজ্য সরকার এখন আগের থেকে অনেক বেশি সিরিয়াস। মেডিক্যাল অফিসার থেকে আশাকর্মী, সিভিল ভলান্টিয়ার থেকে নার্স সবাইকে সর্পদ্রষ্ট রোগীর চিকিৎসা প্রোটোকল নিয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। বোঝানো হচ্ছে ‘রুল অফ হান্ড্রেড’। আশাকর্মীও এখন জানে, কালাচ কামড়ালে রোগীর চোখের পাতা পড়ে যায়। ফুসফুস অকেজো হয়ে যায়। চন্দ্রবোড়ার ছোবলে নষ্ট হয়ে যায় কিডনি। ডাক্তাররা জানেন বিষ ঝাড়ার মন্ত্র। কালাচ কামড়ালে রোগীকে এভিএস দিয়ে ক্রিটিক্যাল কেয়ারের ব্যবস্থা করতে হবে। কেউটে-গোখরো দংশালে নিওস্টিগমিন-অ্যাট্রোপিন ইঞ্জেকশন দেওয়ার পর এভিএস দিতে হবে। তবে সমস্যা হচ্ছে চন্দ্রবোড়া নিয়ে। ২০-৩০ ভায়াল এভিএস দিয়েও রোগীর রক্তের তঞ্চন ক্ষমতাকে ফেরানো যাচ্ছে না। কিডনি অকেজো হয়ে যাচ্ছে। ডাক্তাররা তাই চন্দ্রবোড়ার শিকার দেখলেই ডায়ালিসিসের ব্যবস্থা তৈরি রাখছেন। এত কিছুর পরেও ফি বছর গড়ে আড়াই হাজার মানুষের সর্পদংশনে মৃত্যু হচ্ছে!
[ডায়াবেটিসে ভুগছেন? ঘরোয়া উপায়ে রইল রোগমুক্তির দাওয়াই]
কয়েক মাস আগের কথা। বসিরহাটে মনসার পালা গান মঞ্চস্থ করার সময় সাপের ছোবলে মৃত্যু হয় মনসার ভূমিকায় অভিনয় করা এক মহিলার। মৃত্যু হয়েছে অনেক সাপুড়েরও।
আসলে সাপে কামড়ের সমস্যা বহুদিন উপেক্ষিত থেকেছে। গ্রামের চাষি, খেতমজুর, জেলেদের মতো প্রান্তিক মানুষগুলি সাপের দংশনে মারা যান বেশি। তাই সমস্যাটি ‘গ্রামীণ’ হয়ে রয়ে গিয়েছে। ডেঙ্গু-ম্যালেরিয়ার মতো ‘কুলীন’ হয়ে উঠতে পারেনি। অথচ আমাদের দেশে প্রতি বছর ৫০ হাজার মানুষ সাপের কামড়ে মারা যান। এটা সরকারি হিসাব। বেসরকারি মতে সংখ্যাটা লক্ষাধিক। অথচ অস্ট্রেলিয়ায় আমাদের দেশের থেকে অনেক বেশি বিষধর সাপ থাকলেও মৃত্যুর হার পাঁচ বছরে মাত্র দুই থেকে তিনজন। আসলে আমাদের দেশে এখনও বহু মানুষ সাপে কামড়ালে সঠিক সময় হাসপাতালে না গিয়ে ওঝা, গুনিন, পীর, ফকির বা মনসার স্থানে যান। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে গ্রামীণ এলাকায় চিকিৎসার অপ্রতুলতা। দুঃখের বিষয়, এমবিবিএস সিলেবাসে সাপের কামড়ে চিকিৎসার বিষয়টি ভীষণভাবে অবহেলিত। ফলত বহু চিকিৎসক সাপে
কাটা রোগী দেখলেই চিকিৎসা করতে ভয় পান, রেফার করে দেন অন্যত্র। তবে আশার কথা, দয়ালবন্ধুবাবু ‘স্নেক বাইট ইন্টারেস্ট গ্রুপ’ নামে হোয়াটসঅ্যাপে একটি গ্রুপ খুলেছেন, তাতে ভারতের প্রায় আটটি রাজ্যের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা রয়েছেন। এখানে সাপে কাটা চিকিৎসা নিয়ে নিয়মিত আলোচনা হয়। বিপাকে পড়লে চিকিৎসকরা বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নেন।
বিষধর মহা চার-
বাংলায় মূলত চার প্রজাতির বিষধর সাপ রয়েছে।
- গোখরো
- কেউটে
- চন্দ্রবোড়া
- কালাচ
এছাড়া রয়েছে মারাত্মক বিষধর শাঁখামুটি। কিন্তু সাপটি এতই শান্ত যে ওর কামড়ে মৃত্যুর কোনও রেকর্ড নেই। উত্তরবঙ্গের পার্বত্য অঞ্চলে শঙ্খচূড় থাকলেও তা সাধারণত জনবহুল এলাকা এড়িয়ে চলে। গোখরো এবং কেউটে ফণাযুক্ত সাপ। এদের বিষ নিউরোটক্সিন। চন্দ্রবোড়ার বিষ হেমাটোটক্সিন, রক্তকণিকা ধ্বংসকারী। কালাচ ফণাহীন নার্ভবিষযুক্ত সাপ।
কামড় এড়াতে-
- বাড়ির চারপাশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখুন।
- রাতে অবশ্যই বিছানা ঝেড়ে মশারি টাঙিয়ে শুতে হবে।
- ঘুমানোর সামনে টর্চ রাখুন।
- বুট জুতো পরার আগে অবশ্য তা ঝেড়ে নিতে হবে।
- মাটির বাড়িতে কোনও ইঁদুরের গর্ত থাকলে তা আজই বুজিয়ে ফেলুন।
- অন্ধকারে হাঁটাচলা না করাই ভাল। একান্তই বাধ্য হলে হাতে লাঠি নিয়ে রাস্তায় চলুন।
- হাততালির ধারণা ভ্রান্ত, কারণ সাপের কান নেই।
- মাঠে চাষের কাজ করার সময় ফুলপ্যান্ট পরুন। গামবুট ব্যবহার করতে পারলে ভাল। নাহলে সিমেন্টের বস্তা মোজার মতো করে পরুন।
তবে একটা কথা মনে রাখতে হবে সাপ অত্যন্ত নিরীহ প্রাণী। আতঙ্কিত হয়ে বিপদে পড়লে পালনোর পথ না পেলে তখনই দংশন করে।
[অতিরিক্ত প্লাস্টিকের ব্যবহারে ক্ষতি হতে পারে আপনার বাচ্চার]
কামড়ালে কী করবেন?
- রোগীকে আগে আতঙ্কের ঘেরাটোপ থেকে বের করুন। কারণ আতঙ্ক মৃত্যু ডেকে আনতে পারে। রোগীকে বোঝান, সর্পাঘাতের রোগী সময়মতো চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে ওঠেন।
- রোগীকে বেশি নাড়াচাড়া করা যাবে না। যত কম নড়াচড়া হবে, তত কম হারে বিষ শরীর ছড়াবে। হাত-পা যত কম ছুড়বে ততই ভাল।
- আগে থেকে জেনে নিন রোগীর নিকটস্থ কোন হাসপাতালে সাপে কাটার ওষুধ (এভিএস, নিওস্টিগমিন, অ্যাট্রোপিন, অ্যাড্রিনালিন) আছে। অন্তর্বিভাগযুক্ত সব সরকারি হাসপাতালেই এভিএস থাকার কথা। সময় যেহেতু খুব গুরুত্বপূর্ণ, তাই অ্যাম্বুল্যান্সের জন্য অপেক্ষা না করে রোগী পরিবহণে মোটরবাইক ব্যবহার করা যেতে পারে।
- সাপ দেখে নয়, ডাক্তার চিকিৎসা করবেন রোগীর লক্ষণ দেখে। তাই হাসপাতালে সাপ নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। খুব বেশি হলে মোবাইলে ছবি তোলা যেতে পারে।
- আতঙ্কে অজ্ঞান হয়ে যাওয়া রোগীকে হাসপাতালে যাওয়ার পথে পাশ ফিরে শুইয়ে দিন। নাহলে মুখের লালা শ্বাসনালীতে ঢুকে শ্বাসরোধ হয়ে মৃত্যু ঘটাতে পারে। মুখে গ্যাঁজলা জমলে তা পরিষ্কার করে দিন।
- রোগীর অসহ্য যন্ত্রণা হলে প্যারাসিটামল ট্যাবলেট দেওয়া যেতে পারে।
কী করবেন না-
- দংশন স্থলে কষে বাঁধন দেবেন না। কষে বাঁধন দিলে দংশনস্থলে গ্যাংগ্রিন হতে পারে।
- কাটাছেঁড়া করবেন না।
- মুখ দিয়ে বিষ টানার চেষ্টা করবেন না।
- আর কোনওভাবেই সময় নষ্ট করবেন না।
- মনে রাখতে হবে সাপে কামড়ানোর বা বিষক্রিয়ার লক্ষণ দেখতে পাওয়ার ১০০ মিনিটের মধ্যে ১০০ মিলিলিটার এভিএস শরীরে প্রবেশ করালে রোগী বেঁচে যাওয়ার সম্ভাবনা একশো শতাংশ।
রক্ত পরীক্ষা দরকার?
শুধুমাত্র চন্দ্রবোড়ার কামড় একটি মাত্র রক্ত পরীক্ষা দ্বারা নিশ্চিত হওয়া যায়। তা হল ২০ ডব্লুবিসিটি। এই পরীক্ষায় রোগীর রক্ত তঞ্চনে কোনও ব্যাঘাত হচ্ছে কি না জানা যায়। রোগীর শরীর থেকে ২ মিলিমিটার রক্ত নিয়ে নতুন কাচের টেস্টটিউবে দাঁড় করানো অবস্থায় ২০ মিনিট রাখতে হবে। চন্দ্রবোড়া কামড়ালে রক্ত জমাট বাঁধবে না।
ক্ষতিপূরণ-
সাপের কামড়ে মৃত্যু হলে রোগীর পরিবার এক লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ পায়। অনুদান দেবেন জেলার ক্ষেত্রে জেলাশাসক এবং কলকাতার ক্ষেত্রে ত্রাণ অধিকর্তা।
[কোষ্ঠকাঠিন্যে ভুগছেন? আজই মেনু থেকে বাদ দিন এই খাবারগুলি]
The post ভক্তি থাকুক মা মনসায়, ভরসা রাখুন সাপের বিষের নয়া দাওয়াইয়ে appeared first on Sangbad Pratidin.