সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: সামনেই রোগী, যন্ত্রণায় চিৎকার করছেন তিনি। অথচ অসহায় চিকিৎসক। কারণ ভাষা সমস্যা। ভিনরাজ্যের রোগী কিছুতেই কষ্টের কথা বোঝাতে পারছেন না। ইংরেজি তো দূর, হিন্দিও জানেন না মানুষটা। বালেশ্বরে (Baleshwar) করমণ্ডল এক্সপ্রেসের (Coromandel Express) ভয়ংকর দুর্ঘটনা ভারতীয় রেলের ইতিহাসে সম্ভবত সবেচেয়ে বড় দুর্ঘটনা। একটি মালগাড়ি, যশবন্তপুর এক্সপ্রেস এবং চেন্নাইগামী করমণ্ডল এক্সপ্রেসের বিপর্যয়ে এখনও পর্যন্ত প্রাণ হারিয়েছেন ২৮৮ জন। আহত ৭৪৭। আশঙ্কাজনক ৫৬ জন। দুর্ঘটনা পরপরই অসংখ্য আহতের ঠিকানা হয়েছিল নিকটবর্তী বালেশ্বর জেলা হাসপাতাল। আচমকা যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি তৈরি হয় সেখানে।
শুক্রবার দুর্ঘটনা ঘটে সন্ধে সাতটার আশপাশে। শনিবার বেলা বারোটা অবধি ৫২৬ জন আহতকে প্রাথমিক ভাবে ভরতি করা হয় জেলা হাসপাতালে। আচমকা একসঙ্গে এত রোগীকে পরিষেবা দেওয়ার ক্ষমতা ছিল না পড়শি রাজ্যের জেলা হাসপাতালটির। তথাপি আহতদের সেবায় ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন হাতে গোনা ডাক্তার, নার্স এবং অন্য স্বাস্থ্যকর্মীরা। পরিস্থিতির চাপে রক্তাক্ত, যন্ত্রণাকাতর রোগীদের জন্য অতিরিক্ত শয্যার ব্যবস্থা হয়। তাতেও স্থান সঙ্কুলান হয়নি। এরপর স্ট্রেচারে রাখা হয় হাত-পা ভাঙা, কাটা দুর্ঘটনাগ্রস্তদের। নিমেষে সমস্ত বিভাগের ঘর, এমনকী বারান্দাও ভরে ওঠে কাতরাতে থাকা রোগীদের ভিড়ে। ছোটাছুটি শুরু করেন চিকিৎসক, নার্স এবং অন্য স্বাস্থ্যকর্মীরা। চাইলেও দ্রুত সব রোগীর কাছে পৌঁছাতে পারছিলেন না ওঁরা। এর মধ্যেই তুলনায় গুরুতর আহত ৬১ জনকে রোগীকে কটকের মেডিক্যাল কলেজ এবং হাসপাতাল পাঠানো হয়।
[আরও পড়ুন: রেল দুর্ঘটনার দায় নিয়ে ‘নিঃশব্দে’ সরে গিয়েছিলেন লালবাহাদুর, আজও স্মরণীয় সেই ইতিহাস]
কয়েক দশকের পেশাদার জীবনে এমন অভিজ্ঞতা হয়নি, জানান জেলা হাসপাতালের অ্যাডিশনাল মেডিক্যাল অফিসার ডাঃ মৃত্যুঞ্জয় মিশ্র। বলেন, “অনেক দশক ধরে এই পেশায় আছি। জীবনে এমন বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি দেখিনি।” মৃত্যুঞ্জয় জানান, আচমকা দুর্ঘটনায় আহত ২৫১ জন রোগী ভিড় করেছিল হাসপাতালে। “আমরা মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। আমাদের কর্মীরা সারা রাত কাজ করেছেন। সবাইকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়েছেন।”
একদিকে যখন দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুমিছিল, রেলের বিরুদ্ধে প্রশ্ন উঠছে, এত বড় দুর্ঘটনা কেন ঘটবে? কার গাফিলতি? ভারতীয় রেলের প্রযুক্তির উন্নতি তথা বন্দে ভারত ট্রেন নিয়ে যখন তুমুল প্রচার। প্রধানমন্ত্রী মোদি রাজ্যে রাজ্যে ঘুরে উদ্বোধন করছেন, তখন রেলের মূল পরিকাঠামোতেই গলদ? অবহেলিত নয় তো যাত্রী নিরাপত্তা? এমন সব অন্ধকার প্রশ্নের মধ্যে আশার আলো বালেশ্বর হাসাপাতালের চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্ত্যকর্মীরা যেমন, তেমনই নিকটবর্তী অঞ্চলের সাধারণ মানুষ।
[আরও পড়ুন: ১০ দলিত খুনে সাজা চার দশক পর, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ৯০-এর বৃদ্ধের]
তারাই অন্ধকার রাতে হাজারও বাধা উপেক্ষা করে প্রাথমিকভাবে উদ্ধারকাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন। জেলা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দাবি করেছেন, শুক্রবার রাতে প্রায় ২ হাজার মানুষ জেলা হাসপাতালে হাজির হন রোগীদের সাহায্যের জন্য। তাঁদের কারণেই অল্প সময়ে ৫০০ ইউনিট রক্তের ব্যবস্থা হয়েছিল। হাসপাতালের স্বাস্থ্যকর্মীদের পাশাপাশি তারাও রাতভর ছোটাছুটি করেন। পরে অবশ্য ভূবনেশ্বর এইমস থেকে অতিরিক্ত চিকিৎসকদের একটি দল পৌঁছায় জেলা হাসপাতালে। অর্থাৎ একদিকে স্বজনহারা কান্নার রোল, অন্যদিকে সেবায় ঝাঁপিয়ে পড়া একদল মানুষ। শুক্রবার রাতের বালেশ্বর জেলা হাসপাতাল যেন আলো-অন্ধকারময় আস্ত পৃথিবীর মেটাফোর হয়ে উঠেছিল!