সুকুমার সরকার, ঢাকা: শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর এখন বাংলাদেশের মসনদে রয়েছেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মহম্মদ ইউনুস। তাঁর নেতৃত্বে গঠিত হয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। প্রধান উপদেষ্টা পদে দায়িত্ব গ্রহণের পর রাষ্ট্রের সংস্কারের ডাক দিয়েছেন ইউনুস। সেই মতোই এবার বাতিলের খাতায় চলে যাচ্ছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যার দিন হিসাবে ১৫ আগস্টের জাতীয় শোক দিবস, ঐতিহাসিক ৭ মার্চ-সহ ৮টি জাতীয় দিবস। গত সেপ্টেম্বর মাসেই উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তার পরই সাম্প্রতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে অন্তর্বর্তী সরকার এই জাতীয় দিবসগুলো বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানা গিয়েছে।
চলতি বছরের ৫ আগস্ট ব্যাপক গণ আন্দোলনের জেরে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দেন শেখ হাসিনা। বাধ্য হন দেশ ছাড়তে। এর পর ৮ আগস্ট শপথ নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। তার কয়েকদিনের মধ্যেই আসে ১৫ আগস্ট। এতদিন এই শোক দিবস পালনের জন্য সরকারি ছুটি থাকত বাংলাদেশে। কিন্তু হাসিনা গদিচ্যুত হতেই এবছর সেই ছুটি বাতিল করে দেয় ইউনুস সরকার। বিজ্ঞপ্তি জানিয়ে বলা হয়, বিএনপি-সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ১৫ আগস্ট দিনটি বাতিলের পরামর্শ দিয়েছিল। উপদেষ্টা পরিষদের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর বৈঠকের পর ছুটি বাতিলের বিষয়টিকে অনুমোদন দেওয়া হয়। এর পর থেকেই ৮টি জাতীয় দিবস বাতিল নিয়ে আলোচনা শুরু হয়।
এনিয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সংশ্লিষ্ট আধিকারিক সংবাদমাধ্যমকে জানান, ৮টি জাতীয় দিবস বাতিল করা সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে অনুমোদিত হয়েছে। খুব শীঘ্রই এসব দিবস বাতিল করে বিজ্ঞপ্তি জারি করবে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে, বাতিল হওয়া ৮টি দিবসের মধ্যে ৫টিই শেখ হাসিনার পরিবারের সদস্যদের জন্ম ও মৃত্যু সংক্রান্ত। এর মধ্যে ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্ম দিবস ও জাতীয় শিশু দিবস, ৫ আগস্ট হাসিনার ভাই শহিদ ক্যাপ্টেন শেখ কামালের জন্মবার্ষিকী, ৮ আগস্ট হাসিনার মা বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের জন্মবার্ষিকী, ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুবার্ষিকী ও জাতীয় শোক দিবস, ১৮ অক্টোবর হাসিনার ছোট ভাই শেখ রাসেল দিবস। এছাড়া বাতিলের তালিকায় রয়েছে ঐতিহাসিক ৭ মার্চ, ৪ নভেম্বর জাতীয় সংবিধান দিবস, ১২ ডিসেম্বরের স্মার্ট বাংলাদেশ দিবস।
বলে রাখা ভালো, হাসিনার শাসনকালে ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর ইউনেসকো ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণকে বৈশ্বিক দলিল হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এর পর শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ৭ মার্চে ভাষণ দেওয়ার দিনটিকে ঐতিহাসিক ৭ মার্চ দিবস হিসেবে ঘোষণা করে আওয়ামি লিগ সরকার। এর পর থেকে কয়েক কোটি টাকা ব্যয় করে ৭ মার্চে একাধিক অনুষ্ঠান করে জাঁকজমকপূর্ণভাবে পালন করত তৎকালীন হাসিনা সরকার। এছাড়া, ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর গণপরিষদে বাংলাদেশের সংবিধান গৃহীত হয়েছিল। ওই বছরেরই ১৬ ডিসেম্বর বা বিজয় দিবস থেকে তা কার্যকর হয়। ২০২২ সালের ৪ নভেম্বর দেশে প্রথমবারের মতো জাতীয় সংবিধান দিবস পালিত হয়। ডিজিটাল বাংলাদেশের ইস্তাহারকে স্মরণীয় করে রাখতে ২০১৭ সালের ১২ ডিসেম্বর প্রথমবারের মতো জাতীয় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি দিবস পালন করত হাসিনার সরকার।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, হাসিনা-সহ বঙ্গবন্ধু মুজিবের স্মৃতি মুছতে তৎপর বিএনপি, জামাত-সহ একাধিক রাজনৈতিক দল। আর সেই মতোই পদক্ষেপ করছে ইউনুস সরকার। ৫ আগস্টের পর বাংলাদেশের নানা প্রান্তে হাসিনা ও মুজিবের মূর্তি ভাঙচুর করা হয়। পুড়িয়ে দেওয়া হয় মুজিবের ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরের বাড়ি। এই বাড়িতে স্বপরিবারে তাঁকে হত্যা করা হয়েছিল। হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর সেই বাড়ি জাদুঘর হিসাবে সংরক্ষণ করেছিলেন। সেই চিত্র দেখে অনেকেই মনে করেছিলেন, হাসিনার পরিবারের স্মৃতি মুছে ফেলতেই এই কাণ্ড ঘটানো হচ্ছে। এবার অন্তর্বর্তী সরকারের জাতীয় দিবসগুলো বাতিলের সিদ্ধান্তে সেই বিতর্কই আরও একবার উসকে গেল বলে মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল।