সুকুমার সরকার, ঢাকা: ঢাকা থেকে কলকাতা যেতে সড়ক বা রেলপথেই পড়ে বেনাপোল সীমান্ত। কলকাতা থেকে মাত্র ৮০ দূরেই ব্রক্ষ্ম হরিদাস ঠাকুরের পাটবাড়ি আশ্রম। সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের ইছামতি বইটিতে গুরুত্বের সঙ্গে স্থান পেয়েছে হরিদাস ঠাকুরের পাটবাড়ি আশ্রমের কথা। বিভূতিভূষণ লিখেছেন, প্রায় বিকেলেই তিনি তাঁর বনগাঁ-এর বন্ধুর সঙ্গে একটি গাড়িতে চেপে পাটবাড়ি আশ্রমে যেতেন। পাটবাড়ি যাওয়া-ফেরার পথে প্রায়ই দেখা মিলত সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগার। এই পাটবাড়ি আশ্রমে প্রতি বছর ব্যাপক আয়োজনের সঙ্গে দুর্গাপুজো অনুষ্ঠিত হয়। এবছরও তার অন্যথা হয়নি। ধুমধাম করে হচ্ছে উৎসব উদযাপন।
ভারত-বাংলাদেশ এই সীমান্ত সংলগ্ন পাটবাড়ি দুর্গামণ্ডপটি দেশ-বিদেশ থেকে আসা হাজার হাজার ভক্তের আগমনে মুখরিত হয়ে ওঠে। কালের নিয়মে হরিদাস ঠাকুরের পাটবাড়ি আশ্রমটি আজ হয়ে উঠেছে একটি দর্শনীয়স্থান। এখানে রয়েছে প্রায় ৬০০ বছরের প্রাচীন মাধবীলতা আর তমাল বৃক্ষ। এই গাছের ছায়ার তলেই হরিদাস ঠাকুরের পাটবাড়ি আশ্রম। সাতক্ষীরা জেলার কলারোয়া থানার কেড়াগাছি গ্রামে জন্ম নেন হরিদাস ঠাকুর। যশোর জেলা শহর থেকে পাটবাড়ির দূরত্ব মাত্র ৩৮ কিলোমিটার এবং কলকাতার শিয়ালদহ রেলস্টশন থেকে মাত্র ৮০ কিলোমিটার। বাস বা ট্রনে যোগে আসা যায় এখানে।
এই আশ্রমে দেশ-বিদেশ থেকে আসা ভক্ত-দর্শনার্থীদের থাকা-খাওয়ার সুব্যবস্থা আছে। তাদের নিরাপত্তার জন্য প্রশাসনিক ব্যবস্থাও করা হয়েছে। রয়েছে সম্প্রীতিও। হিন্দু-মুসলমান কোনও ভেদাভেদ নেই এখানে। এখানে সব ধর্মের মানুষের সহযোগিতায় অনুষ্ঠানগুলো হয়ে থাকে। ভক্তদের কথায়, হরিদাসপুর সীমান্ত থেকে মাত্র দেড় কিলোমিটার দূরেই বৈষব সন্ন্যাসী হরিদাস ঠাকুরের স্মৃতিবিজড়িত আশ্রমের প্রবেশ মুখেই তমাল আর মধুমঞ্জুরী ভক্তদের প্রধান আকর্ষণ। আশ্রম সংশিষ্টদের বিশ্বাস, এই দুটি গাছের বয়স ৫০০ বছরের বেশি।
আশ্রমের সভাপতি তাপস কুমার বিশ্বাসের কথায়, মাধবীলতার এতদিন বাঁচার কথা না। কিন্তু মরেনি। লতায়, পাতায় আর ফুলে ফুলে হরিদাস ঠাকুরের স্মৃতি বহন করে দাঁড়িয়ে আছে আজও। ভক্তরা সেজন্যই বলেন, সিদ্ধবৃক্ষ মাধবীলতা। আশ্রমে থাকা প্রাচীন নথিপত্রেও এই গাছের কথা আছে। মধ্য বসন্ত থেকে গ্রীষ্ম পর্যন্ত লালচে সাদা ফুলে ভরে থাকে এই গাছ। মধুমঞ্জুরীর গোড়া ও শিকড় থেকে নতুন লতা গজায়। লতা কেটে মাটিতে লাগালেও চারা গাছ হয়। হরিদাস ঠাকুর বেনাপোলে এসেছিলেন ১৪৭১ সালে। তিনি আসার আগেও এ গাছ এখানে ছিল। তখন এটি ছিল ছোট লতা গাছ। দীর্ঘ সময়ে এর কাণ্ড এখন বৃক্ষকাণ্ডের মত হয়ে গিয়েছে। মহাপ্রভু গৌরাঙ্গ যাওয়ার সময় তিনি হাতের লাঠিটি আশ্রমের জন্য রেখে যান স্মৃতি হিসাবে। সেই লাঠি থেকেই এ তমাল গাছের জন্ম। অদ্বৈত মহাপ্রভুর স্মৃতিচিহ্ন হিসাবে ভক্তদের কাছে এ তমাল গাছটিও পূজনীয়।
আশ্রমের সাধারণ সম্পাদক শ্যামল দাস জানান, হরিদাস ঠাকুরের শৈশব কাটে কেড়াগাছি গ্রামে। কৈশোরে উত্তীর্ণ হওয়ার পর তাঁর মধ্যে ভাবের উদয় হয়। হরিনাম জবতে জবতে লোকালয় ছেড়ে চলে যান বেনাপোলের নির্জন জঙ্গলে। কথিত আছে, ওই জঙ্গলে বসে প্রতিদিন তিনি লক্ষবার হরিনাম জবতেন। কৃপালাভের আশায় হরিদাস ঠাকুরের পরম বৈষ্ণবী হয়ে যান লক্ষী হীরা। অসংখ্য ভক্তের হৃদয় জয় করে হরিদাস ঠাকুর দেহত্যাগ করেন। তার স্মৃতি বিজড়িত এলাকায় ভক্তরা পরে পাটবাড়ি আশ্রম গড়ে তোলেন । আশ্রমের সহ-সভাপতি সুকুমার দেবনাথ বলেন, এখানে একটি জাদুঘর এবং মাটির নিচে রয়েছে গিরি গোবর্ধন মন্দির।