shono
Advertisement

যান্ত্রিক পরাগ মিলন ব্যয়বহুল, খরচ কমাতে পতঙ্গই ভরসা কৃষকের

পতঙ্গ বৈচিত্র্য রক্ষা করতে হবে সকলকে।
Posted: 02:24 PM May 31, 2023Updated: 02:24 PM May 31, 2023

আমাদের মুনাফামুখী চাহিদা মেটাতে প্রকৃতি, পরিবেশকে তছনছ করছি। হাজারও পতঙ্গের বাসভূমিকে আমরা শেষ করছি। ফুলের পরাগায়নে অন্যতম ভূমিকা নেয় মধু মৌমাছি। শুধু মধু মৌমাছি নয় বিভিন্ন পতঙ্গেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে পরাগায়নে। একা মৌমাছিই সব পরাগী পতঙ্গের চাহিদা মিটিয়ে মেটাতে পারে না। পতঙ্গ বৈচিত্র্য রক্ষার জন্য তার উপযোগী পরিবেশও আমাদের রক্ষা করতে হবে। নয়তো ফসল উৎপাদনে যান্ত্রিক পরাগায়নের ব্যবস্থা করতে হবে। শস্য উৎপাদনকে আরও ব্যয় বহুল করবে। লিখেছেন অ্যাসোসিয়েশন ফর অ্যাডভান্সমেন্ট ইন প্ল্যান্ট প্রোটেকশনের সচিব।

Advertisement

গত বছর এই সময়ে গিয়েছিলাম সিকিমে। জোড়থাং হয়ে পৌঁছলাম মঙ্গলবারে নামে একটি গ্রামে। ছিলাম দিন দুই। ভোর বেলা হাঁটতে বেরিয়েছি। তখনও আকাশ পরিষ্কার হয়নি। বোঁ বোঁ করে একটা শব্দ। তাকিয়ে দেখি বেশ বড় বড় লোমশ মৌমাছি। পিঠে সাদা ছাপ। সারা দিনে তেমন দেখা না মিললেও বিকেলের পর থেকে আবার তাদের উড়াউড়ি। সন্ধ্যার পর ৭টা-৮টা পর্যন্ত তাদের ছোটাছুটি চলতে থাকল এ ফুলে, সে ফুলে। এরা বাম্বল বি। সমভূমি অঞ্চলে এদের দেখা পাওয়া যায় না। এদের নিয়ে সারা পৃথিবীতেই খুব আগ্রহ। নেকটার সংগ্রহ করতে গিয়ে লোমশ গায়ে শুধু পরাগরেণু মেখে গর্ভমুন্ডে সেসব তারা পৌছে দেয় তাই নয়, উড়তে উড়তে তারা একধরনের তরঙ্গও তৈরি করে। গাছের সংস্পর্শে এসে এরা একধরনের কম্পন তৈরি করে। যা পরাগধানিকে ফাটিয়ে রেণুগুলিকে বাইরে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করে। গ্রীন হাউস চাষের পরাগ মিলনে এরা খুব কাজের। কেতাবি ভাষায় একে বলে বাজ পলিনেশন (Buzz pollination)।

সমতল অঞ্চলে বাস করেন আপনি? চারিদিকে চেয়ে দেখুন, যে গাছের পাতাগুলো একটু চওড়া, ফেব্রুয়ারির পর গরম পড়তেই, সেই পাতাগুলোর ধার থেকে গোল গোল করে কাটা। করঞ্জ, আম, জামরুল, অশোকের মত বহু গাছেই এমনটা নজরে পড়বে। এমন কাটা পাতা দেখতে পাবেন গোলাপ গাছেও। আগে ভাবতাম ককচ্যাফার বিটল বোধহয় এসব পাতা কেটে খায়। তা কিন্তু নয়। এই পাতা কেটে পেটের কাছে মুড়ে নিয়ে উড়ে যায় কিছু মৌমাছি। এরা লুকোনো খাঁজে, ফাঁকে-ফোকরে পাতা দিয়ে টিউব তৈরি করে বাসা বানায়। এই কাটা পাতা গুলো অনেকটা দেওয়ালের মতো কাজ করে। ভেজা স্যাঁতসেঁতে দেওয়াল থকে জল চুঁইয়ে যেন না ঢুকতে পারে। সেই পাতার টিউবের মধ্যে, পরাগ রেণু, নেকটার মিশিয়ে জমা করে। তার উপর এই মৌমাছির মায়েরা ডিম পেড়ে দিয়ে যায়। তারপর তাদের ঘরগুলো সিল করে মায়েরা কাজ শেষ করে বেরিয়ে যায়।

[আরও পড়ুন: চা বাগানের ‘যম’ লুপার ক্যাটার পিলার! চিবিয়ে সাবাড় করছে ‘দুটি পাতা একটি কুড়ি’]

ডিম ফুটে এই মৌমাছির লার্ভা গুলো জমানো সমস্ত খাবার খায়। সেখানেই তারা বড় হয়। পিউপা হয়। তারপর পূর্ণাঙ্গ মাছি বাইরে বেরিয়ে আসে। এরা জোট বেঁধে থাকে না। পেটের তলায় এদের লোম থাকে। শারীরিক গঠনটা এমন, যে সমস্ত ফুলের নেকটার মধু-মৌমাছি সংগ্রহ করতে পারে না, সেই ফুলে এরা কার্যকরী। ফুলের নিচের দিকের পাপড়ি ধরে এরা ঝুলে পড়ে। ফুলের মুখটা একটু চওড়া হয়। এরপর মুখ ঢুকিয়ে নেকটার গ্রন্থী থেকে ওরা মিষ্টি রস সংগ্রহ করে। আর তলপেটের লোমে লেগে থাকা পরাগরেণু ওই ফুলের গর্ভমুন্ডে লেগে যায়। হয় পরাগ মিলন। এমন হাজারো ফুলের হাজার ধরনের আকৃতি। ফলে একা মধু মৌমাছি সব চাহিদা মেটাতে পারে না। সানহেম্প, অড়হর ডালের মতো কিছু ফসলে এরাই পরাগ মিলনে সাহায্য করে। এক ধরনের কালো ভোমরা, পিঠে হলুদ ছোপ নজরে পড়ে? এরা ওড়ার সময় ও খানিকটা বোঁ বোঁ আওয়াজ হয়। তবে বাম্বল বি-র মতো ততো তীব্র নয়।

শুকনো গাছের কাণ্ড, কাঠের পাটাতন, করিবর্গা, বহুদিন ধরে রাখা পাঁজাবাঁধা বাঁশে গোল গোল গর্ত দেখেছেন কি? এগুলোই এই কাল ভোমরা বা কাঠুরে মৌমাছিগুলোর আশ্রয়। আমার বাড়ির গেটের পাশে, এমন শুকিয়ে যাওয়া একটা কুর্চি গাছের গায়ে এমন বহু গর্ত ছিল। তখন বুঝিনি।গাছটা কেটে ফেলেছিলাম নতুন করে লাগাবো বলে। পরে সারাদিন ধরে দেখেছিলাম, কালো ভোমরার মতো পতঙ্গগুলো কেটে ফেলা গাছের জায়গায় উড়ে বেরাচ্ছে। খুঁজছে ওদের বাসা। পরে বুঝেছি,ওগুলো আসলে কাঠুরে মৌমাছি। কিছু ফসলের পরাগ মিলনে ওরা খুব কাজের।আমাদের মুনাফামুখী চাহিদা মেটাতে এমনভাবে প্রকৃতি পরিবেশকে তছনছ করছি যে এমন হাজারো পতঙ্গের বাসভূমিকে আমরা শেষ করছি। বৃষ্টির জল সবে পড়তে শুরু করেছে। নানা জংলা রাস্তারধারে বেড়ে উঠছে। ব্যাস, সঙ্গে সঙ্গে রাসায়নিক আগাছানাশক প্রয়োগ করে সব পরিষ্কার করছি। কেন করছি? আমরা জানি কি, এই জংলার ফুল গুলোর পোলেন থেকে বন্ধু পোকা, পরাগী পতঙ্গ প্রোটিন খাদ্য পায়? শেষ করছি, শেষ করছি সব আমরা এভাবে।

প্রকৃতিকে ভাল করে না বুঝে, যত্র তত্র এভাবে হাত বাড়ালে, আমরা সখাত সলিলে ডুবব।এবারের বিশ্ব মৌমাছি দিবসে সেই জন্যই বৈজ্ঞানিক মৌপালনের সঙ্গে সঙ্গে এই জাতীয় পতঙ্গ সহায়ক পরিবেশ সংরক্ষণেও জোর দেওয়া হয়েছে। মনে রাখা প্রয়োজন, এই বিপুলা পৃথিবীতে বিপুল পুষ্প বৈচিত্র্য। আকৃতিতে, প্রকৃতিতে তা বৈচিত্রময়। কিন্তু যেহেতু উদ্ভিদ, এরা তো আর চলাচল করতে পারে না। ফলে, যৌন সংযোগের জন্য, পুরুষ ফুল স্ত্রী ফুলের কাছে বা একই ভাবে তাদের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ একে অন্যের কাছে পৌঁছোতে পারে না। তাদের পরাগ রেণু গর্ভমুন্ডে পৌঁছোতে অন্যের সাহায্য প্রয়োজন হয়। এদের মধ্যে কেউ কেউ বাতাস, জল ইত্যাদির সাহায্যে পরাগ রেণু ছড়িয়ে দেয়। খালি চোখে সাধারণ ভাবে সেই সব ধরা না পড়লেও, এধরনের ভাসমান পরাগ রেণু থেকে যে আমাদের এ্যালার্জি হয়, শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যা হয়, তা আমরা জানি। কোনও কোনও সময় এধরনের পরাগরেণু একসঙ্গে ফুল থেকে বেরিয়ে এসে পরাগ মেঘও তৈরি করে। কিন্তু সফল পরাগায়নে পতঙ্গ, পাখি, বাদুড় এদের ভূমিকা মুখ্য।

রাতে ফোটা ফুলে, রাতের পতঙ্গ, অথবা বাদুড় জাতীয় প্রাণীরা ভূমিকা নেয়। বৈদ্যুতিন আলো ব্যবহারের ফলে, রাতের অন্ধকারময় এলাকা কমে আসছে। ফলে রাতের পতঙ্গদের জীবনেও তার কুপ্রভাব পড়ছে। অনেক সময় যাদের আমরা ফসলের ক্ষতিকর পতঙ্গ হিসেবেই শুধু গণ্য করি, তারাও কেউ কেউ পরাগায়নে সাহায্য করে। যেমন ডাল জাতীয় ফসলে চিরুনি পোকা বা থ্রিপস এই জতীয় ভূমিকা পালন করে। ফলে, একথা যেন আমরা না ভাবি, একা মৌমাছিই সব পরাগী পতঙ্গের চাহিদা মিটিয়ে দেবে। পতঙ্গ বৈচিত্র্য রক্ষার জন্য তার উপযোগী পরিবেশও আমাদের রক্ষা করতে হবে। নয়তো ফসল উৎপাদনে যান্ত্রিক পরাগায়নের ব্যবস্থা করতে হবে। সব চাহিদা সেভাবে মিটবেও না। ফুল এবং এই জাতীয় পতঙ্গ একে অন্যকে বার্তা দেওয়া নেওয়া করে। এই বার্তা প্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে তাদের শরীরে জৈব রাসায়নিক পরিবর্তনও হয়। সর্বোপরি, যান্ত্রিক পরাগায়ন, শস্য উৎপাদনকে আরও ব্যয়বহুল করবে।আসুন, এই বৈচিত্র্যময় প্রকৃতিতে সব সদস্যকে চেনার চেষ্টা করি। বোঝার চেষ্টা করি তাদের ভূমিকা।

[আরও পড়ুন: খেতে ভাল হলেই চলবে না, জেনে নিন চকচকে আম ক্রেতাদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার সহজ উপায়]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement