টিটুন মল্লিক, বাঁকুড়া: ২২ ঘণ্টা পেরিয়েও তৃণমূল বিধায়ক তন্ময় ঘোষের দপ্তর, চালকল ও মদের দোকানে চলছে আয়কর তল্লাশি (Income Tax Raid)। যা নিয়ে বিষ্ণুপুরের অলিগলিতে এখন জোর চর্চা। কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে নানা অভিযোগ। কেউ বলছেন, আইসিডিএসের চাল ভিন রাজ্যে পাচারের সঙ্গে জড়িয়ে বিধায়ক। কেউ বলছেন, বেনামী বেআইনি বালি খাদান রয়েছে তাঁর নামে। শুধু বালি খাদান নয়, রয়েছে প্রচুর বেনামী জমিও। নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক কেউ কেউ আবার অতীত খুঁড়ে তুলে আনছেন বিমা জালিয়াতির ইতিহাসও। যদিও এসব অভিযোগের সত্যতা যাচাইয়ের উপায় নেই। কারণ, বুধবার দুপুর ১টা নাগাদ আয়কর তল্লাশি শুরুর পর থেকেই বন্ধ বিষ্ণুপুরে বিধায়কের মোবাইল।
বিষ্ণুপুরের অভিজাত পরিবারের সন্তান তন্ময়। তবে সাতের দশকে তাঁর বাবার বিরুদ্ধে দুর্ঘটনার বিমা জালিয়াতির অভিযোগ উঠেছিল। কেউ কেউ বলেন, সেই বিমার টাকা দিয়েই চূড়ামণিপুরে চালকল খুলেছিলেন তন্ময়ের (Tanmay Ghosh) বাবা। এর পর আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে।
[আরও পড়ুন: বিনিয়োগ টানতে নবান্নের মাস্টারস্ট্রোক! এবার পর্যটনকে শিল্পের মর্যাদা রাজ্যের]
কাট টু ২০০৫– পরবর্তী সময়।
তৎকালীন কংগ্রেস পুরপ্রধান শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয় তন্ময়ের। কার্যত শ্যামাপ্রসাদের হাত ধরেই ক্ষমতার অলিন্দে অবাধ বিচরণ ছিল তাঁর। বিষ্ণুপুরের রাজনৈতিক মহলে কান পাতলেই শোনা যায়, ক্ষমতায় না থেকেও সেইসময় বিষ্ণুপুরের কার্যত সর্বেসর্বা হয়ে উঠেছিলেন এই তন্ময়। একদিকে পুরপ্রধানের সঙ্গে ‘ঘনিষ্ঠতা’ তো অন্যদিকে রেক পয়েন্টে শ্রমিক সরবরাহের ঠিকাদারি ব্যবসা, দুইয়ের সংযোগে তন্ময় তখন যেন বিষ্ণুপুরের হর্তাকর্তা বিধাতা।
রেক পয়েন্টের ব্যবসাটা ঠিক কী? ট্রেনে করে যেসমস্ত পণ্য সরাবরাহ করা হয় তা বিভিন্ন জেলার একাধিক পয়েন্টে নামানো হয়। এবং সেখান থেকে সড়ক পথে পৌঁছে যায় ডিলারের গোডাউন বা কারখানায়। সেই সময় বাঁকুড়া জেলার অন্যতম রেক পয়েন্ট ছিল বিষ্ণুপুর। সেখানে শ্রমিকের ঠিকাদার ছিলেন তন্ময়। সেখান থেকে দুহাতে কাঁচা পয়সা আয় করতেন তিনি। অন্তত এমনই অভিযোগ স্থানীয় বাসিন্দাদের।
২০০৯ সালে রাতারাতি কংগ্রেসের পুরসভা তৃণমূল হয়ে যায়। শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় হন তৃণমূলের পুরপ্রধান। সেইসময় থেকে ঘাসফুল শিবির সঙ্গে সখ্যতা বাড়ে ঠিকাদার তন্ময়ের। অভিযোগ, সরাসরি না হলেও বকলমে পুরসভার সমস্ত ঠিকাদারির সামলাতেন তিনি। আর তাঁর মাথায় আশীর্ব্বাদের হাত ছিল তৃণমূল জমানার বস্ত্রমন্ত্রী শ্যামাপ্রসাদের। এই সময়ই পারিবারিক চালকলের ব্যবসাও সামলাতে শুরু করেন তন্ময়। রাজ্যে পালাবদলের পর বালি খাদানের ব্যবসাতেও হাত পাকাতে শুরু করেন।
[আরও পড়ুন: এবার রাজভবন থেকে দ্রুত পাশ হবে বিল! সুপ্রিম ক্ষোভের পরই ‘স্পিড’ বাড়ালেন রাজ্যপাল]
জানা যায়, একক এবং যৌথভাবে বাঁকুড়া সংলগ্ন ৫টি নদীতে একাধিক খাদানের ইজারা নেন তন্ময়। অভিযোগ, সরকারকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে চলতে থাকে তাঁর বেআইনি বালি খাদানের ব্যবসা। নদীতে অবাধে বালি তুলে বিক্রি করতে থাকেন তিনি, এমনই দাবি করছেন বিরোধীরা। ২০১৫ সালে সরাসরি রাজনীতির আঙিনায় পা রাখেন তন্ময় ঘোষ। হন তৃণমূলের কাউন্সিলর। ২০২০ সালে কাউন্সিলরের মেয়াদ শেষে পুরসভার প্রশাসকমণ্ডলীতে আনা হয় তাঁকে। সেই সময় বিষ্ণুপুর শহর তৃণমূলের সভাপতিও হন। এর মাঝেই ফুল বদলে বিজেপিতে যোগ দেন শ্যামাপ্রসাদ। রাতারাতি গ্রেপ্তার হন তিনি। সেই সময় তৃণমূলের টিকিটে বিধায়ক পদের দৌঁড়ে সবচেয়ে এগিয়ে ছিলেন তন্ময়। কিন্তু ভাগ্যে শিঁকে ছেড়েনি। বদলে বড়জোড়া থেকে এনে অর্চিতা বিদকে বিষ্ণুপুর বিধানসভার টিকিট দেয় তৃণমূল। ক্ষোভে সৌমিত্র খাঁয়ের হাত ধরে বিজেপিতে যোগ দেন তন্ময়। টিকিটও পান। বিধায়ক হওয়ার তিন মাসের মধ্যে অবশ্য ফিরে যান তৃণমূলে।
তার পর থেকে জেলায় তন্ময়ের উত্থানের চোখে পড়ার মতো। অভিযোগ, তাঁর সঙ্গে বিবাদের জেরেই পুরপ্রধান হওয়া হয়নি অর্চিতার। সাধারণ কাউন্সিলর হয়েই থেকে যান। বদলে তন্ময় ঘনিষ্ঠ বসেন পুরসভার চেয়ারম্যান পদে। সূত্রের খবর, এর পর থেকে তন্ময়ের ইশারা ছাড়া একটি পাতাও নড়ে না বিষ্ণুপুর পুরসভা ও গোটা এলাকার। অভিযোগ, বিধায়কের দপ্তরের পাশেই রয়েছে পুরসভার ডরমেটরি। সেখানকার একটি ঘর রয়েছে তন্ময়ের দখলে। সেখানেই না কি সমস্ত ‘কুকীর্তি’ নথি রাখা থাকে।
তন্ময় ঘোষ রেশন ডিলারদের ডিস্ট্রিবিউটর। অর্থাৎ রেশন ডিলারদের মান সরবরাহ করেন তিনি। এতেও নাকি দুর্নীতির গন্ধ রয়েছে, অভিযোগ করে বিরোধীরা। আইসিডিএসের চাল সরবরাহ করেন বিধায়ক। ‘চাল সিন্ডিকেট’ সেই ভালো চাল ওড়িশায় বিক্রি করে ঝাড়খণ্ডে থেকে ‘থার্ড গ্রেড’ পোকাধরা চাল এনে আইসিডিএস কেন্দ্রের সরবরাহ করেন। সেই সমস্ত লেনদেনের কাগজই না কি রাখা হয়েছে সেই ডরমেটরির ঘরে। আর তার পাশে বিধায়কের দপ্তর, দপ্তরের নিচে মদের দোকান এবং চালকলে গত ২২ ঘণ্টা ধরে তল্লাশি চালাচ্ছে আয়কর আধিকারিকরা। কিছু কি মিলল? না কি স্রেফ রাজনৈতির প্রতিহিংসা থেকেই এই অভিযান, তা নিয়েও অবশ্য বিষ্ণুপুরের মানুষের মনে কৌতূহলের অভাব নেই। বিধায়কের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ কতটা ঠিক আর কতটাই বা ভুল, তা জানতে একাধিকবার ফোন করা হলেও তন্ময় ঘোষের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। ফোনের ওপাশ থেকে যান্ত্রিক কণ্ঠ বারবার বলেছে, ‘দ্য নম্বর ইউ ট্রায়িং টু রিচ, ইজ কারেন্টলি সুইচড অফ।’