দিব্যেন্দু মজুমদার, হুগলি: অটোমোবাইল ইঞ্জিনিয়ারিং পাস যুবক। মেধাবীও। পাড়ায় কেউ কখনও তার দিকে কোনও কারণেই আঙুল তুলতে পারেনি। ভদ্র স্বভাব। বাবা শিক্ষিত, বোন শিক্ষিকা। শ্রীরামপুরের (Serampore) অভিজাত এলাকার ওই পরিবারকে সকলেই সমীহ করত। কিন্তু সেই বাড়ির ছেলেটিকে যখন পুলিশ তুলে নিয়ে যাচ্ছে, ছোটোখাটো কোনও বিষয় নয়, একেবারে বাড়িতেই অস্ত্র কারখানা বানিয়ে ব্যবসা ফেঁদে বসার অভিযোগে তখন তাজ্জব পাড়া। আর এখন পুলিশ তদন্ত করে যা পাচ্ছে তাতে চক্ষু ছানাবড়া পুলিশেরও। ছাত্রাবস্থায় একটি গোষ্ঠীর সংস্পর্শে আসার পরই নাকি তার এই রিভলভার-সহ নানা আগ্নেয়াস্ত্র তৈরির হাতেখড়ি। আর এখন তো সে ঝানু। তার কাছ থেকে নিয়মিত আগ্নেয়াস্ত্র কিনত দুষ্কৃতীরা। এক একটি ওয়ান শটার সে বিক্রি করত তিন থেকে হাজার পাঁচেক টাকায়।
মঙ্গলবার ভোরে হুগলির শ্রীরামপুর থানার পুলিশ শ্রীরামপুরের জলকল মাঠ থেকে কুখ্যাত দুষ্কৃতী রমেশ দাস ওরফে লেংড়িকে আগ্নেয়াস্ত্র-সহ গ্রেপ্তার করেছিল। ধৃত রমেশকে জেরা করে পুলিশ জানতে পারে শ্রীরামপুরের অভিজাত এলাকা ঋষিবঙ্কিম সরণির বাসিন্দা পেশায় অটোমোবাইল ইঞ্জিনিয়ার সুজাত গোস্বামীর কাছ থেকে সে আগ্নেয়াস্ত্রটি কিনেছে। এরপরই শ্রীরামপুর থানার আইসি দিব্যেন্দু দাসের নেতৃত্বে পুলিশ সুজাত গোস্বামীর বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে অস্ত্র কারখানার হদিশ পায়। রমেশকে শ্রীরামপুর থানার পুলিশ ধরার আগেই কলকাতার এসটিএফ-এর একটি বিশেষ তদন্তকারী দল সোমবার রাতে স্ট্র্যান্ড রোড থেকে সুজাত গোস্বামী ও মহম্মদ শাহিদ নামে দুই অপরাধীকে ধরে। ধৃতদের কাছ থেকে পুলিশ আটটি দেশি পিস্তল উদ্ধার করে। পুলিশের অনুমান অস্ত্র বিক্রি করতেই কলকাতায় গিয়েছিল সুজাত। সে ধরা পড়ার পরের দিন রমেশ নামে কুখ্যাত দুষ্কৃতীকে শ্রীরামপুর থানার পুলিশ গ্রেপ্তার করে। তাকে জেরা করার পর মঙ্গলবার গভীর রাতে পুলিশ সুজাতর বাড়ি রেড করে। ঘরে তল্লাশি চালানোর সময় পুলিশ রীতিমতো বিস্মিত হয়ে যায়। ঘরের মধ্যেই বড় আকারের এক অস্ত্র কারখানা তৈরি করা হয়েছে। দোতলার ঘরের একটি কোণে ও বাড়ির নিচে এক কোণে ছোট কুঠুরিতে তৈরি হয়েছে অস্ত্র কারখানা। আর সেখানেই মিলেছে লেদ মেশিন, গ্যাস কাটার, ম্যাগাজিন, পালিশ মেশিন ও কিছু অর্ধসমাপ্ত আগ্নেয়াস্ত্র ও বেশ কিছু বন্দুকের নল। লোকাল মেড ইম্প্রোভাইজড পয়েন্ট ৭২ এম এম পিস্তল বানাতে সিদ্ধহস্ত সুজাত। আর এই আগ্নেয়াস্ত্র বানানোর সুবাদেই কুখ্যাত দুষ্কৃতীদের সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে উঠেছিল সুজাত’র।
[আরও পড়ুন: বিজয়ার উপহার জেলাশাসকের, ফলভরতি ঝুড়ি ও শুভেচ্ছাবার্তা পেয়ে খুশি পুরুলিয়ার কোভিড রোগীরা]
পাশাপাশি এই সকল অস্ত্র পাচারের জন্য টোটোচালক মহম্মদ শাহিদের সঙ্গেও একটা সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল তার। বিশেষ করে বর্তমানে অন্যান্য যানের থেকে টোটোর আধিক্য এতটাই বেশি যে সেই টোটোতে করে আগ্নেয়াস্ত্র এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় পুলিশের নজর এড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার সহজ রাস্তা বেছে নিয়েছিল সুজাত। এসটিএফের হাতে ধৃত সুজাত এলাকায় অত্যন্ত ভদ্র ছেলে বলে পরিচিত। তার পড়াশোনার শুরু একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে। গত প্রায় চার বছর ধরে বাড়ির মধ্যেই চলছে অস্ত্র তৈরির কারখানা। সুজাতর এক বোন একটি নামী স্কুলের শিক্ষিকা। বাবাও ভাল চাকরি করতেন। সেখানে বাড়ির ছেলে বাড়ির ভিতর এরকম একটা অস্ত্র কারখানা গড়ে তুলেছে তা বাড়ির লোক জানতে পারেননি কেন, সেটাও ভাবাচ্ছে পুলিশকে। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে পরিবারের লোকজনের বক্তব্য, সুজাত বাড়ির ভিতর মোটরসাইকেলের পার্টস তৈরি করত। কিন্তু গোটা পরিবার যেখানে এতটা শিক্ষিত সেখানে তাঁরা বুঝতে পারলেন না কোনটা মোটরসাইকেলের পার্টস আর কোনটা অস্ত্র তৈরির যন্ত্রাংশ, এই তত্ত্ব মানতে নারাজ পুলিশ। এদিকে জলকল মাঠ থেকে ধৃত রমেশ দাসকে পুলিশ ইতিমধ্যেই পাঁচ দিনের পুলিশি হেফাজতে নিয়ে এর পিছনে আর কারা জড়িত রয়েছে তার সন্ধান শুরু করেছে।