বিশ্বজ্যোতি ভট্টাচার্য, শিলিগুড়ি: খুনসুটি যেন কাল হচ্ছে কুকুর ছানাদের! সেই সমস্ত শাবকরাই চিতাবাঘের 'সফট টার্গেট'। যা নিয়ে উত্তরের জঙ্গল সংলগ্ন গ্রাম-শহরে আতঙ্কের ছায়া। পরিবেশপ্রেমীদের শঙ্কা, উত্তরের গ্রাম-শহরে বেড়ে চলা পথ কুকুর বড়সড় বিপদ ঘনিয়ে আনতে পারে। সেদিকে নজর রেখে এবং বিপদ এড়াতে বনদপ্তর সুন্দরবনের ধাঁচে উত্তরেও নাইলন ফেন্সিং ও ট্র্যাপ ক্যামেরা বসাতে শুরু করেছে।
চলতি বছরের নভেম্বর মাস থেকে উত্তরের চা বাগান লাগোয়া বিভিন্ন এলাকায় ছয়টি চিতাবাঘের হামলায় ১৫ জন জখম হয়েছেন। ডিসেম্বরেই তিনটি হামলার ঘটনা ঘটে। জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে হামলার ঘটনা অনেক বেড়ে যায়। গত বছরের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে উত্তরের তরাই ও ডুয়ার্সে নয়টি চিতাবাঘের হামলা হয়। মৃত্যু হয় ৩ জনের। জখম হয় অন্তত ১৫ জন। গত বছরের ৯ জানুয়ারি আলিপুরদুয়ার জেলার দলগাঁও চা বাগানে এক মহিলাকে চিতাবাঘ খুবলে খায়। পরদিন ১০ জানুয়ারি বীরপাড়া চা বাগানের ফ্যাক্টরি লাইনে এক কিশোরীর চিতাবাঘে খুবলে খাওয়া দেহ উদ্ধার হয়। নৃশংস হামলার কারণ অনুসন্ধানে নেমে চোখ কপালে ওঠে পরিবেশ কর্মীদের। জানা যায়, কুকুর ছানার লোভে চিতাবাঘ চা বাগানে ঘাপটি মেরে ছিল। শিকার শেষ হতে মানুষকে টার্গেট করে। এর আগে ২০২৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর চিতাবাঘের হামলার ঘটনা ঘটে জলপাইগুড়ি জেলার ধূপগুড়ি ব্লকের দক্ষিণ কাঠুলিয়া এলাকায়। জখম হন এক ব্যক্তি। খোঁজ নিয়ে জানা যায় চিতাবাঘটি কুকুর ছানা শিকারের লোভে গ্রামে ঢুকে পড়ে। একই কারণে গত বছরের শুরুতে ডুয়ার্সের চালসা, ডামডিম, বেতগুড়ি এবং নাগরাকাটায় পরপর চিতাবাঘের হামলার ঘটনা ঘটে।
পরিবেশ কর্মীরা জানান, নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাসে কুকুর ছানাদের পথেঘাটে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়। ওই সময় চিতাবাঘের 'সফট টার্গেট' হয় কুকুর ছানা। যে কারণে শ্বাপদরা শহর ও সংলগ্ন এলাকায় ঘাপটি মেরে থাকে। শিকার পেলে ভালো নইলে মানুষের উপরে হামলা চালায়। গত বছর তরাই ও ডুয়ার্সে ৩০টি চিতাবাঘের হামলার ঘটনা ঘটে। তারমধ্যে নয়টি ছিল জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে। চলতি বছরের ১১ নভেম্বর উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩ নম্বর গেটের কাছে একটি বাথরুম থেকে বেরিয়ে আসা চিতাবাঘের হামলায় ২ জন জখম হয়। এগারো দিন পর ২২ নভেম্বর মাথাভাঙ্গার বৈরাগীরহাট গ্রাম পঞ্চায়েতের সাতগাছি গ্রামে লোকালয়ে চিতাবাঘ ঢুকে চিতাবাঘ হামলা চালায়। এক তরুণী সহ ৭ জন জখম হয়।
৫ ডিসেম্বর শিকারপুর চা বাগানের চার নম্বর সেকশনে চিতাবাঘ এক শ্রমিকের গবাদি পশুর উপরে হামলা চালায়। ১০ ডিসেম্বর ফের ওই চা বাগান এলাকায় গরুর পাল নিয়ে যাওয়ার সময় এক ব্যক্তি চিতাবাঘের আক্রমণে জখম হয়।
পরিবেশপ্রেমীদের শঙ্কা, উত্তরের জঙ্গল লাগোয়া প্রতিটি গ্রাম-শহরে পথ কুকুরের সংখ্যা উদ্বেগজনক ভাবে বেড়ে চলায় এবারও চিতাবাঘের হামলা ও মৃত্যুর ঘটনা বাড়বে। বেপরোয়াভাবে যেখানে-সেখানে ছোট চা বাগান গড়ে ওঠায় বুনোরা এখন সহজে জঙ্গল থেকে শহরে পৌঁছে যেতে পারছে। ডুয়ার্সের লাটাগুড়ির পরিবেশপ্রেমী অনির্বাণ মজুমদার বলেন, "এখন বাজার এলাকাতেও কুকুর ছানার লোভে ঢুকছে চিতাবাঘ। বিষয়টি খুবই উদ্বেগের।" তিনি জানান, যে কোনও মূহুর্তে বিপজ্জনক পরিস্থিতি হতে পারে। ওই কারণে পথ কুকুরদের নির্বীজকরণের ব্যবস্থা করার দাবি জানানোর হয়েছে। হিমালয়ান নেচার অ্যান্ড অ্যাডভেঞ্চার ফাউন্ডেশনের কো-অর্ডিনেটর অনিমেষ বসু জানান, মানুষের লোভে চিতাবাঘ লোকালয়ে ঢোকে না। পথ কুকুর ছানাদের লোভে ওরা লোকালয়ে ঘুরে বেড়ায়। বিশেষত বয়স্ক এবং অসুস্থ চিতাবাঘ সহজে শিকারের জন্য গ্রাম-শহর বেছে নেয়। এখন সেই সহজ শিকার হয়েছে পথ কুকুর।
বনকর্তারা জানান, চিতাবাঘ নিজের বাসস্থান থেকে শিকারের জন্য প্রায় ২৫ কিলোমিটার এলাকা ঘুরে বেড়ায়। এদের শাবক প্রসবের নির্দিষ্ট সময় নেই। কিন্তু প্রসবের পর স্ত্রী চিতাবাঘ যে এলাকায় শিকারের অভাব নেই সেখানে শাবকদের নিয়ে আস্তানা গাড়ে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় বন দপ্তরের তরফে সুন্দরবনের ধাঁচে উত্তরেও নাইলন ফেন্সিং ও ট্র্যাপ ক্যামেরা বসানো শুরু হয়েছে। বানারহাট ব্লকের বিন্নাগুড়ি বন্যপ্রাণ শাখার উদ্যোগে কলাবাড়ি চা বাগানের হুলাস লাইন এলাকায় বসানো হয়েছে অন্তত ১২ ফুট উঁচু নাইলনের ফেন্সিং। পাশাপাশি বসানো হয়েছে ট্র্যাপ ক্যামেরা। সুন্দরবনে যেভাবে বাঘের হামলা ঠেকাতে বিশেষ জালের বেড়া ব্যবহার করা হয় উত্তরবঙ্গে প্রথম সেই প্রযুক্তির সাহায্য নেওয়া হয়েছে।
