সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: অধীর চৌধুরীর সঙ্গে মতের মিল ছিল। তাই একুশের আগে জোটও হয়েছিল। হাত ধরে মিছিলেও হেঁটেছিলেন মহম্মদ সেলিমরা। কিন্তু শুভঙ্কর সরকারকে নিয়ে ‘অ্যালার্জি’ তো কাটছেই না, উলটে ভোট যত এগোচ্ছে, ততই দুশ্চিন্তা বাড়ছে আলিমুদ্দিনে। দুশ্চিন্তা একটি প্রশ্ন ঘিরেই। তা হল- শেষমেশ যদি জোট হয়ও, ‘ঠকতে’ হবে না তো? তবে কংগ্রেসের অবশ্য সেই অর্থে কোনও ‘অ্যালার্জি’ নেই। জোটের রাস্তা খোলা রেখেই যা করার করছে তারা।
রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনের আর মাস তিনেকও বাকি নেই। শাসকদল তৃণমূল এবং প্রধান বিরোধী দল বিজেপি ইতিমধ্যেই ভোটযুদ্ধের দামামা বাজিয়ে দিয়েছে। কিন্তু বাম ও কংগ্রেসের সমন্বয়ের কোনও প্রক্রিয়াই এখনও গতি পায়নি। আদৌ জোট হবে কি না, সেই প্রশ্নের উত্তরই অমিল। আর যদি জোট হয়ও, কে কার সঙ্গে প্রথম যোগাযোগ করবে, কে কাকে কী প্রস্তাব দেবে, এই নিয়ে চাপা টানাটানিতেই সময় কাটিয়ে চলেছে দুই শিবির। এ সবের মধ্যেই প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি শুভঙ্কর ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছেন, এ যাত্রায় জোটে খুব একটা আগ্রহী নন তাঁরা। তাই আসন্ন নির্বাচনে ২৯৪টি আসনেই একা লড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে তাঁর দল।
সিপিএম অবশ্য এখনও প্রকাশ্যে এরকম কোনও ইঙ্গিত দেয়নি। বামফ্রন্টের অন্য শরিকরা কংগ্রেসে ‘অ্যালার্জি’র কথা স্পষ্ট ভাবে আলিমুদ্দিনকে জানিয়ে দিলেও, সিপিএমের একটা অংশ এখনও কংগ্রেসের সঙ্গে হাত ধরতে আগ্রহী। তবে শুভঙ্কর-প্রশ্নে সাবধানী আলিমুদ্দিনের একটা ব়ড় অংশ। একটি অসমর্থিত সূত্রের দাবি, সম্প্রতি এই বিষয়টি নিয়ে গান্ধী পরিবারের এক সদস্যের সঙ্গে আলোচনাও হয়েছে দিল্লির সিপিএম নেতৃত্বের। সেই আলোচনায় তাঁরা বুঝিয়ে দিয়েছেন, বাংলার কংগ্রেসের নেতৃত্বে শুভঙ্কর থাকলে জোট আদৌ সম্ভব কি না, তা নিয়ে তাঁরা যথেষ্ট সন্দিহান।
যদিও সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তী বলেন, ‘‘জোট নিয়ে এখনও আলোচনা হয়নি, কংগ্রেস কীভাবে ভোটে লড়বে, সেটা ওরাই ঠিক করবে। সেটা সম্পূর্ণ ওদের ব্যাপার। জোট করা নিয়ে আমাদের সেই অর্থে কোনও আপত্তি নেই। আর এখানে ব্যাপারটা তো শুভঙ্কর সরকার নন। জোট হবে কি হবে না, সেটা ঠিক করবেন কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব।’’ শুভঙ্করের সঙ্গেও যোগাযোগ করেছিল সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল। তিনি বলেন, ‘‘কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের নির্দেশেই বাংলার কংগ্রেস পরিচালিত হয়। তবে শীর্ষ নেতৃত্ব কখনওই স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করেন না। এ রাজ্যে ২৯৪টি আসনে আমাদের সংগঠন মজবুত করার প্রয়োজন ছিল। সেটা আমরা করছি। আর সাধারণ মানুষও চাইছেন, বাংলায় কংগ্রেস একা লড়ুক। বাকিটা ভবিষ্যতে দেখা যাবে। তবে এটুকু বলতে পারি, বহুত্ববাদে বিশ্বাসী এমন কোনও রাজনৈতিক দলকেই কংগ্রেস অচ্ছুত বলে মনে করে না।’’
ঘটনাচক্রে, কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বও যে আপাতত জোটে আগ্রহী নন, তার আভাস মিলেছিল বাংলার কংগ্রেসের পর্যবেক্ষক গোলাম আহমেদ মীরের কথায়। এআইসিসি-তে মীর জোট রাজনীতির দক্ষ কারিগর বলেই পরিচিত। নিজভূম জম্মু-কাশ্মীরে ন্যাশনাল কনফারেন্সের সঙ্গে জোট করে বিধানসভা ভোটে লড়াইয়ে তাঁর ভূমিকা ছিল। আবার ঝাড়খণ্ডেও হেমন্ত সোরেনের ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চার সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করে দ্বিতীয়বার বিজেপিকে পরাস্ত করতে সফল হয়েছেন তিনি। সেই মীরও সম্প্রতি বলেছেন, ‘‘আপাতত বাংলায় এককভাবে পথ চলে নিজেদের সংগঠন মজবুত করতে চাইছি। ভোটের সময় কী হবে, তা নিয়ে পরে ভাবা যাবে।’’ আশ্চর্য নয় যে, শুভঙ্করও বিধানভবনের ‘পরশপাথর’ মীরের সুরেই কথা বলবেন।
অবশ্য পরিস্থিতি যে এদিকেই গড়াতে চলেছে, তা গত বছর প্রদেশ কংগ্রেসের সভাপতি পদ থেকে অধীরের অপসারণের সময়েই আন্দাজ করতে পেরেছিল আলিমুদ্দিনের একাংশ। তাঁদের মত, অধীর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কড়া সমালোচক হওয়ার কারণেই সিপিএম-কংগ্রেসের জোটের পথ সুগম হত। কিন্তু অধীরের স্থলাভিষিক্ত করা হয়েছে যাঁকে, তিনি তৃণমূল তথা মমতার প্রশ্নে তুলনায় ‘নরমপন্থী’ বলেই পরিচিত। সিপিএমের প্রথম সারির এক নেতার মত, ‘‘অধীর চৌধুরীর জায়গায় শুভঙ্কর সরকারকে এনে রাহুল গান্ধী, মল্লিকার্জুন খড়্গেরা আসলে জোড়া বার্তা দিয়েছিলেন। প্রথম বার্তার লক্ষ্য যদি কালীঘাট হয়, তাহলে দ্বিতীয়টি প্রত্যাশিত ভাবেই আলিমুদ্দিন।’’
প্রসঙ্গত, গত লোকসভা ভোটে তৃণমূল এবং কংগ্রেসের মধ্যে জোটের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত তা ভেস্তে যায়। তার প্রথম কারণ যদি আসন নিয়ে মতানৈক্য হয়ে থাকে, তাহলে দ্বিতীয় কারণ অবশ্যই অধীর। ভোটের পর রাহুলের সঙ্গে দেখা করেছিলেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। শাসকদলের একাংশের দাবি, সেই সময় কংগ্রেস-তৃণমূলের বোঝাপড়া না হওয়ার জন্য এক এবং একমাত্র অধীরকেই ‘দায়ী’ করেছিল বাংলার শাসকদল। ঘটনাচক্রে, তার পরেই অধীরের জায়গায় শুভঙ্করকে নিয়োগ।
বঙ্গ কংগ্রেসের এক নেতা বলেন, ‘‘কংগ্রেসের যে একা লড়ার শক্তি নেই, তা সকলেই জানেন। জোট কংগ্রেসও করতে চায়। কিন্তু কার সঙ্গে জোট করা উচিত, তা নিয়ে দলে বিবিধ মত রয়েছে। অধীর চৌধুরীর শিবির মনেপ্রাণে চান বামেদের সঙ্গে জোট করতে। কিন্তু শুভঙ্কর সরকারের গোষ্ঠীর মত তৃণমূলের সঙ্গে জোট করার পক্ষে।’’ ওই নেতার সংযোজন, ‘‘আসলে শীর্ষ নেতৃত্ব দুই রাস্তাই খোলা রাখতে চেয়েছিলেন। আপাতত মধ্যপন্থা অবলম্বন করতেই শুভঙ্করের মতো নেতাকে বাংলার কংগ্রেসের সভাপতি করা হয়েছে। যাতে পরে বাস্তব পরিস্থিতি বুঝে সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়। আর তা না হলে একাই লড়া হবে। এতে অসুবিধা কী? ২৯৪টা আসনে লড়তে না পারলেও অন্তত ২০০ আসনে লড়ার জায়গায় রয়েছে কংগ্রেস।’’
সন্দেহ নেই, বাংলায় কংগ্রেসের সঙ্গে তৃণমূলের সম্পর্ক মসৃণ হলে সবচেয়ে বেশি বিড়ম্বনায় পড়বে সিপিএম তথা বামেরা। তবে আলিমুদ্দিন এখনই এ নিয়ে সরাসরি কোনও কটাক্ষ বা বিদ্রূপাত্মক মন্তব্যের দিকে না গিয়ে কিছু দিন অপেক্ষা করতে চাইছে। বাংলায় সিপিএমের সঙ্গে যাতে কংগ্রেসের সখ্য থাকে, দিল্লিতে এই বিষয়টি দেখাশোনা করতেন সীতারাম ইয়েচুরি। তাঁর প্রয়াণ দু’পক্ষের সমঝোতার প্রক্রিয়াকে অন্তত আঠারো বাঁও জলে ফেলে দিয়েছে! নিরন্তর দিল্লির কংগ্রেস নেতৃত্বের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে ইয়েচুরি যে ভূমিকা পালন করতেন, সেই দক্ষতা ও ইচ্ছা এখন অমিল।
এই পরিস্থিতিতে কংগ্রেসকে বাদ রেখে বৃহত্তর বাম ঐক্য নিয়ে ভোটে কীভাবে লড়া হবে, তা নিয়েও অঙ্ক কষে রাখছে আলিমুদ্দিনের একাংশ। জোট নিয়ে বৈঠক হয়েছে আইএসএফ নেতা নওশাদ সিদ্দিকির সঙ্গেও (নওশাদ কংগ্রেসের সঙ্গেও কথা বলতে চেয়ে চিঠি দিয়েছিলেন শুভঙ্করকে। দাবি, তার জবাব মেলেনি)। সিপিএমের একাংশের মত, কংগ্রেসের সঙ্গে জোট না হলে দল আরও বেশি করে নিজের ঘর গোছানোয় মন দেবে। এতে তরুণ প্রজন্মের নেতাদের কাঁধে আরও দায়িত্ব এসে পড়বে। তাতে তাঁরা উজ্জীবিতই হবেন। পাশাপাশি, সিপিএমের ওই অংশের মত, তৃণমূল তথা মমতা-বিরোধী একটা বিশাল ভোটব্যাঙ্ক রয়েছে। তার একটা বড় অংশ দীর্ঘকাল সিপিএমের সঙ্গেই কোনও না কোনওভাবে সম্পৃক্ত ছিল। রাজ্যে পালাবদল এবং পর্যায়ক্রমে বিজেপির উত্থানে তা ভাগ হয়ে গিয়েছে। সেই হারানো ভোটব্যাঙ্ককে আবার একছাতার তলার নিয়ে আসার সুযোগ পাবে নেতৃত্ব। এতে আখেরে দলের ভালোই হবে। স্বল্পমেয়াদে না হলেও, দীর্ঘমেয়াদে তো বটেই।
আলিমুদ্দিনের ওই অংশের দাবি, সম্প্রতি ‘বাংলা বাঁচাও যাত্রা’য় তার খানিক আভাসও মিলেছে। দীর্ঘদিন থেকে নিষ্ক্রিয় হয়ে থাকা কর্মী-সমর্থকদের প্রত্যাশিত সমর্থনই পাওয়া গিয়েছিল ওই কর্মসূচিতে। তাই কেন নিজেদের কোমরের জোর না বাড়িয়ে কেন শুধু কংগ্রেসের ‘লেজুরবৃত্তি’ করা হবে, সেই প্রশ্ন তুলছেন অনেকে। ঘটনাচক্রে, সরাসরি এ ভাবে বলা না হলেও, চলতি বছরের শুরুতে পার্টি যে দলিল প্রকাশ করেছিল, তাতেও প্রকারান্তরে এই বার্তাই ছিল। তা ছাড়া দিল্লিতে কংগ্রেসের সঙ্গে তৃণমূলের সখ্য রয়েছে। ‘ভোটচুরি’ বিতর্কের আবহে রাহুল-সোনিয়া গান্ধীদের সঙ্গে সাক্ষাৎও করেছেন অভিষেক। এই পরিস্থিতিতে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট হলে সিপিএমের কর্মী-সমর্থকরা তা ভালো চোখে দেখবেন না বলেই বিশ্বাস দলের একাংশের। দলের রাজ্য কমিটির এক নেতার কথায়, ‘‘এই মুহূর্তে দলের লক্ষ্য হওয়া উচিত আবার এ রাজ্যে খাতা খোলা। বেশ কয়েকটি আসনে জিতে বাংলায় আবার প্রাসঙ্গিত হয়ে ওঠা। সেই কারণেই ২৯৪টি আসনেই না ঝাঁপিয়ে কিছু টপ প্রায়োরিটি আসন চিহ্নিত করা হয়েছে। বাঁকুড়া, পশ্চিম মেদিনীপুর, পুরুলিয়া, বর্ধমান, হুগলি, নদিয়া ও উত্তর ২৪ পরগনার একাধিক আসনকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। সেই তালিকায় যাদবপুর, দমদম, কামারহাটির মতো ৫০-৬০টি আসন রয়েছে, যেখানে জেতার জায়গায় রয়েছে পার্টি।’’
২০১৬ সালের বিধানসভা থেকে ২০২৪ সালের লোকসভা ভোট পর্যন্ত দল নানা ভাবে জোট, আসন সমঝোতা করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছে। কিন্তু যত সময় গিয়েছে, ফল তত খারাপই হয়েছে বামেদের। তাই কংগ্রেসের সঙ্গে জোটের উপকারিতা নিয়ে দলের অনেকেই সন্দিহান। সিপিএমের একটি সূত্রের বক্তব্য, তার বড় কারণ, নির্বাচনে সিপিএমের লোকেরা কংগ্রেস প্রার্থীদের ঢেলে ভোট দিলেও, কংগ্রেসের ভোট সিপিএমের ঝুলিতে ঢোকে না। ফলে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট না হলে বড় ক্ষতি হয়ে যাবে, এই ধারণা সঠিক নয়। অধীরের আমলে এমনটা ঘটে থাকলে, শুভঙ্করের আমলে তা ঘটার সম্ভাবনা আরও বেশি বলেই মত আলিমুদ্দিনের একাংশের।
তবে শুভঙ্কর প্রশ্নে সিপিএমের অন্দরে পালটা অভিমতও রয়েছে। কেউ কেউ বলছেন, শুভঙ্কর এখানে কোনও ‘ফ্যাক্টর’ই নন। কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কথা শুনেই তাঁকে চলতে হয়। তাই জোট না হওয়ার জন্য শুধু তাঁকেই দায়ী করা যায় না। আর শুভঙ্করের সঙ্গে মতের মিল যে একেবারে নেই, তা নয়। বিজেপি-বিরোধিতার প্রশ্নে, ধর্ম ও জাতপাতের নামে বিভাজনের রাজনীতির বিরুদ্ধে তিনিও একই ভাবেই সরব। সম্প্রতি উত্তর কলকাতায় রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী এবং পরবর্তীকালে কংগ্রেস নেতা হাফিজ আলম সৈরানির প্রয়াণ বার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে রাজ্যে গণতান্ত্রিক এবং ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির একজোট হওয়ার প্রশ্নে একই সুর শোনা গিয়েছিল সেলিম এবং শুভঙ্করের গলায়।
চলতি বছরে নদিয়ার কালীগঞ্জের উপনির্বাচনে কংগ্রেসের সঙ্গে সমঝোতার কথা মনে করিয়ে জোটের পক্ষে সওয়াল করা এক সিপিএম নেতা বলেন, ‘‘রাজনীতিতে অনেক কিছু মাথায় রেখে চলতে হয়। তাই শুভঙ্করকে নিয়ে দলের অ্যালার্জি রয়েছে, এমনটা ভাবা ভুল। রাজনীতি তো সম্ভাবনার শিল্প। দেখা যাক কী হয় ভবিষ্যতে।’’
