সংবাদ প্রতিদিন ব্যুরো: ময়নাতদন্তের রিপোর্টে সংক্রমণের ইঙ্গিত স্পষ্ট। তবে তা কিসের জন্য স্পষ্ট নয়। স্যালাইনের বিষক্রিয়া, অন্য কোনও ওষুধের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া, নাকি অপারেশনে ভুলচুক? কারণ যাই হোক, প্রসূতি মামনি রুইদাসের যে লাগামছাড়া সংক্রমণের কারণেই মৃত্যু হয়েছে তা নিশ্চিত।
রিপোর্ট অনুযায়ী, মৃতার বুকে ও পেটে ২.২ লিটারের মতো রক্ত মিশ্রিত তরল জমেছিল। সংক্রমণ হলে কিডনির মেডালা ও কর্টেক্স এলাকা আলাদা করে বোঝা যায় না। এক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। লিভারের আকারও স্বাভাবিকের থেকে অনেকটা বড় ছিল। ওজন দাঁড়িয়েছে প্রায় ১ কেজি ৭১৭ গ্রাম। যা সাধারণত এক থেকে দেড় কেজি ওজনের হয়। তাছাড়া সংক্রমণের জেরেই মাথায়, ফুসফুসে 'ইডিমা' হয়েছিল। বিকল হয়ে গিয়েছিল একের পর এক অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। পরিণতি 'সেপটিক শক'-এ মাল্টিঅর্গান ফেলিওর। মামনি রুইদাসের ময়নাতদন্তের রিপোর্টেও মৃত্যুর কারণ এটাই উল্লেখ করা হয়েছে।
ফরেনসিক বিশেষজ্ঞদের মত, মৃতের শরীরে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছিল। ফুসফুসের বাইরে থাকা প্লুরাল ক্যাভিটিতে দেড় লিটার রক্ত মিশ্রিত তরল মজুত ছিল। পেরিটোনিয়াল ক্যাভিটিতেও মজুত ছিল ৭০০ মিলি তরল, একই ধরনের। এখন প্রশ্ন হল, প্রসূতির শরীরে সংক্রমণের প্রবেশ কীভাবে? স্যালাইনের বিষক্রিয়ায়, নাকি অন্য কোনও ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায়? নাকি অস্ত্রোপচার এবং অস্ত্রোপচারে ব্যবহার করা যন্ত্রপাতি নিয়ে সমস্যা? এই প্রবল সংক্রমণের সঙ্গে দুদিন যুঝেছিলেন প্রসূতি। বেঁচে যাওয়া বাকি চারজনও মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছেন।
প্রসূতিদের পর যে দুই তাদের শিশুসন্তান মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্ত্তি আছে তাদের মধ্যে প্রসূতি রেখা সাউয়ের সন্তান আশঙ্কাজনক। গত বুধবার সীজারের পর থেকেই সে হাসপাতালেই চিকিৎসাধীন। বর্তমানে তাকে এসএনসিইউতে ভেন্টিলেশন সাপোর্টে রাখা হয়েছে। অপরজন মৃত প্রসূতি মামনি রুইদাসের সন্তান। তাকে গত শুক্রবারই হাসপাতাল থেকে ডিসচার্জ করে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার পর তার জণ্ডিসের নানান উপসর্গ দেখা দেয়। ফলে গত সোমবার তাকে ফের এনে মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালেই ভর্ত্তি করা হয়েছে। শিশু বিভাগের বিভাগীয় প্রধান তারাপদ ঘোষ বলেছেন, দুজনের মধ্যে একজন ভেন্টিলেশনে আছে। মেডিক্যাল টিম গড়ে তার চিকিৎসা চলছে। বাকি একজন স্থিতিশীল।
উল্লেখ্য, প্রসূতি রেখা সাউ নিজেও মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
এদিকে মঙ্গালবার কলকাতা থেকে সিআইডির এক ডিএসপির নেতৃত্বে টিম পৌঁছয় মেদিনীপুরে। সঙ্গে ছিলেন জেলার ডিডি (আই)-এর আধিকারিকরা। জানা গিয়েছে, গত ৯ জানুয়ারি যে চিকিৎসক ও নার্সরা ডিউটিতে ছিলেন, তাঁদের একে একে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। ওই রাতের দায়িত্বে থাকা আরএমও, দুজন জুনিয়র ডাক্তার ও চারজন নার্সকেও সিআইডি জিজ্ঞাসাবাদ করে। অসুস্থ ও মৃত প্রসূতির পরিবারের সদস্যদের সঙ্গেও কথা বলবেন
সিআইডি আধিকারিকরা।
সূত্রের খবর, সিআইডি টিম আরএমওকে জিজ্ঞাসা করেন, ঘটনার দিন নাইট ডিউটি করার কথা থাকলেও কেন তিনি উপস্থিত ছিলেন না? তিনি বিষয়টি কাকে জানিয়েছিলেন? তিনি কি পিজিটি চিকিৎসকদের অস্ত্রোপচার করার নির্দেশ দিয়েছিলেন? যদি তিনি না দেন, তবে কী পদ্ধতিতে পিজিটিরা অস্ত্রোপচার করলেন? সব খতিয়ে দেখেছে গোয়েন্দারা। খতিয়ে দেখা হচ্ছে হাসপাতালের রোস্টার তথা রেজিস্ট্রার খাতাও। গোয়েন্দারা এদিন মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষা মৌসুমী নন্দী ও হাসপাতাল সুপার জয়ন্ত রাউতের চেম্বারে ঢুকে দীর্ঘক্ষণ কথা বলেন। হাসপাতাল সুপার জয়ন্ত রাউৎ বলেছেন, বিষয়টি নিয়ে তদন্ত চলছে। সিআইডি দল সংশ্লিষ্ট সকলের সঙ্গেই কথাবার্তা বলছেন। এর বেশি কিছু বলা যাবে না। তবে বিশেষ সূত্রের খবর, সিআইডি দল এদিন হাসপাতালে প্রায় ছয় ঘন্টা হাজির থেকে বেশ কিছু তথ্য সংগ্রহ করে নিয়ে গিয়েছেন। কখন কি ওষুধ প্রয়োগ করা হয়েছে তার তালিকাও নিয়ে গিয়েছেন।
অন্যদিকে, প্রসূতি মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে তোলপাড় হতেই কড়া নির্দেশিকা জারি করলেন মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ অধ্যক্ষা ডাঃ মৌসুমী নন্দী। এক নির্দেশিকা জারি করে তিনি জানিয়ে দেন, যদি পিজিটিরা নিজেরাই ওটি করেন তবে এটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে। এক্ষেত্রে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে। সব বিভাগের ক্ষেত্রেই এটি প্রযোজ্য।