দিব্যেন্দু মজুমদার, হুগলি: ‘ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়।’ বহুকাল আগেই কিশোর কবি লিখে গিয়েছিলেন একথা। কথাটি যে বেদবাক্যের মতো চিরন্তর সত্যি, তা ফের একবার প্রত্যক্ষ করল মানুষ। তবে এবার আর গদ্য নয়। যে ব্যক্তি ক্ষুধাতাড়িত, তিনি কলম নয়, আঁচড় কাটেন তুলিতে। এঁকে বুঝিয়ে দেন পেট তাঁর একটুকরো ঝলসানো রুটির প্রতীক্ষা করছে।
[ রীতি মেনে রূপান্তরকামী প্রেমিকাকে বিয়ে করলেন জলপাইগুড়ির যুবক ]
পরনে নোংরা লুঙ্গি, গায়ে আলখাল্লা জামা, গলায় গামছা আর হাতে প্লাস্টিকের পুটুলি। এই বেশে বছর পঁয়তাল্লিশের এক ব্যক্তিকে রবিবার দেখা গেল হুগলি ঘাট স্টেশনে। সকলেই মনে করেছিল এলাকায় আর একটা পাগলের সংখ্যা বাড়ল। কিন্তু দুপুরের পরই মানুষটাকে নিয়ে সকলেরই আগ্রহ ক্রমশ বাড়তে থাকে। ক্ষুধার্ত মানুষটির চারপাশে তখন বহু মানুষের ভিড়। কিন্তু কোনওদিকে খেয়াল নেই ওই প্রৌঢ়ের। শুধু তাঁর হাতের পুটুলি থেকে একে একে বের হয়ে এল ইঁটের টুকরো, কাঠ কয়লা, কচুপাতা, আরও অনেক কিছু। হুগলি ঘাট স্টেশনের নিচে ঢালাই করা জায়গায় তখন এই জিনিসগুলো দিয়েই আপনভোলা লোকটি একের পর এক ছবি এঁকে চলেছে। পেটে খিদের জ্বালা নিয়ে তখন তার ছবির আঁকার মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে রঙিন হয়ে উঠেছে রেলের সেই রুক্ষ ঢালাই করা জায়গাটি। অবাক বিষ্ময়ে সকলে তখন সেই দিকেই তাকিয়ে। সেখানে ফুটে উঠছে তাঁর আবেদন।
শুধু এক মুঠো অন্নের জন্য পথকেই জীবন হিসেবে বেছে নিযেছে এই ভবঘুরে। নাম অনিল। বাড়ি বজবজের এক বিশাল নদীর তীরে। তারই মাঝে আঁকড় কেটে জানাল ছন্নছাড়া মন আর কোথাও দাঁড়ায় না। এটা আজও সভ্য জগতের কাছে লজ্জা যে একটা মানুষ তার খাদ্যের সন্ধানে পথে পথে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কখন কে দয়া করবে তখন খাওয়া জুটবে, নচেৎ নয়। অথচ দৈনন্দিন জীবনে আমরা অনেক সময় অনেক খাবারই নষ্ট করি। আর এই ভবঘুরে তারই শিল্প সৃষ্টির মাঝে মাঝে কিছু জীবনমুখী কথা লিখে আমাদের মনে করিয়ে দিল, ‘খোলা আকাশের নিচে জীবনটা কেমন কখনও দেখেছ?’
সরাসরি প্রশ্ন তিনি কাউকে করেননি। কিন্তু তাঁর অঙ্কনশৈলী নিঃশব্দে জানিয়ে যাচ্ছে আবেদন। ‘যদি কারও মন চায় আমায় হেল্প করো। খুব ক্ষুধার্ত আমি।’ এমন শিল্পী আর শিল্পের মর্যাদা দেবে না, এমন অমানবিক বোধহয় খুব কম সংখ্যক লোকই হয়। তাই অনিলের সাহায্য যে একেবারেই ওঠেনি, তা নয়। যার যা সামর্থ্য তা দিয়েই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় অনেকেই। আর সেই অর্থ সাহায্য নিয়ে নাটুকে মঙ্গলকামনা বা ঈশ্বরস্মরণ নয়, মানুষটি তাঁর পুটুলি গুছিয়ে চলা শুরু করে অজানার পথে। শুধু যাওয়ার আগেও ধরিত্রীর বুকে আঁচড় কেটে লিখে দিয়ে গেল- ‘এমন জীবন তুমি করিবে গঠন, মরিলে হাসিবে তুমি, কাঁদিবে ভুবন।’
[ পণের ১৫ হাজার টাকা না পেয়ে নববধূকে ‘খুন’, গ্রেপ্তার স্বামী-সহ তিন ]
