সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: মৃত্যুর প্রায় ১৯০ বছর পর রাজ্যের মাধ্যমিক শিক্ষা পর্ষদ অনুমোদিত পাঠ্যবইয়ে ফিরলেন নারকেলবেড়িয়ায় বাঁশের কেল্লা তৈরি করে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণাকারী তিতুমীর৷ ১৮৩১-এ ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে তাঁর বিদ্রোহকে অনেকেই ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে দেশের প্রথম সশস্ত্র আন্দোলন বলে দাবি করেন৷ এবার দশম শ্রেণির ইতিহাসের পাঠ্যবইতে একরাশ বিতর্ককে সঙ্গী করে ফিরলেন তিতুমীর, খবর ‘দ্য হিন্দু’র৷
বাংলার ইতিহাসে এমনিতেই তিতুমীরকে নিয়ে বহু মতামত-জনশ্রুতি রয়েছে৷ ওয়াহাবি মতবাদে অনুপ্রাণিত সেই তিতুমীরকে নিয়ে পর্ষদ অনুমোদিত দশম শ্রেণির পাঠ্যবইয়ে লেখা হয়েছে, “তিতুমীর বহু হিন্দুকে হত্যা করেছিলেন৷ বহু মন্দির ধ্বংস করেছেন৷” পাঠ্যবইয়ের এই অংশটুকু নিয়ে বহু বিশিষ্ট ঐতিহাসিক প্রতিবাদ জানিয়েছেন৷ তাঁরা বলছেন, ইতিহাসকে বিকৃত করা হচ্ছে৷ বিশিষ্ট ঐতিহাসিক ও ইসলাম ধর্মের স্কলার গৌতম ভদ্র বলছেন, “বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলনের অধ্যায়ে বলা হয়েছে, তিতুমীরের নেতৃত্বে বহু পুরোহিতকে হত্যা করা হয়েছে, মন্দির নষ্ট করা হয়েছে৷ এই দাবি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন৷” তিনি আরও দাবি করেছেন, তিতুমীর একটিই হিন্দু মন্দির ধ্বংস করেছেন ও একজনই পুরোহিতকে হত্যা করেছিলেন৷ তাও কোনও ধর্মীয় কারণে নয়৷ তালুকদার দেব রায় ছিলেন এক অত্যাচারী ও ব্রিটিশদের আজ্ঞাবহ৷ তিতুমীরের বিদ্রোহ ছিল ওই ধরনের লোকেদের বিরুদ্ধেই৷
[এসি নেই? গ্রীষ্মে এই কৌশলগুলিতেই ঠান্ডা রাখুন ঘর]
ঐতিহাসিকদের দাবি, তিতুমীর হিন্দু জমিদার কর্তৃক মুসলমানদের উপর বৈষম্যমূলকভাবে আরোপিত খাজনা এবং মসজিদের করের তীব্র বিরোধিতা করেন। তিতুমীর ও তাঁর অনুগামীদের সঙ্গে স্থানীয় জমিদার ও নীলকর সাহেবদের মধ্যে সংঘর্ষ তীব্রতর হতে থাকে। তাঁরা সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হন। ১৮৩১ সালের ২৩শে অক্টোবর বারাসতের কাছে বাদুড়িয়ার ১০ কিলোমিটার দূরে নারকেলবাড়িয়া গ্রামে তাঁরা বাঁশের কেল্লা তৈরি করেন। রাজ্য সরকারের বইতে যে ধরনের চরিত্র হিসাবে তিতুমীরকে তুলে ধরা হয়েছে সেটা ঠিক নয়, দাবি অধ্যাপক ভদ্রের৷
ভুলের এখানেই শেষ নয়, ওয়াহাবি আন্দোলনের ইতিবৃত্তও ঠিকভাবে তুলে ধরা হয়নি ছাত্রছাত্রীদের কাছে, অভিযোগ ‘ইমান ও নিশান’ বইয়ের লেখক গৌতম ভদ্রের৷ তিনি বলছেন, “রাজ্য সরকারের পাঠ্যবইতে লেখা হয়েছে, হাজার হাজার গরিব ও পিছিয়ে পড়া মুসলিমরা তিতুমীরের দলে যোগ দেন৷ কিন্তু ইতিহাস কখনও এরকম অসমর্থিত সংখ্যাকে মান্যতা দেয় না৷ তিতুমীরের আন্দোলন কখনই ১৮৫৭-র সিপাহি বিদ্রোহ নয় যে হাজার হাজার মানুষ যোগ দেবেন৷” তাঁর আরও অভিযোগ, “তিতুমীরের মৃত্যুর পর ওয়াহাবি আন্দোলন স্তব্ধ হয়ে যায় বলে লেখা হয়েছে পাঠ্যবইয়ে৷ কিন্তু বারাসত ছাড়া আন্দোলনের তীব্রতা অন্য কোথাও কমেনি৷ ওই অংশটুকুও দায়সারাভাবে লেখা হয়েছে৷”
অধ্যাপক অতীশ দাশগুপ্ত তাঁর একটি বইতে তিতুমীর প্রসঙ্গে লিখেছেন, তিতুমীর চব্বিশ পরগনা, নদীয়া এবং ফরিদপুরের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের অধিকার নিয়ে সেখানে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। তিতুমীর তাঁর গ্রামের দরিদ্র কৃষকদের সঙ্গে নিয়ে হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে জমিদার এবং ব্রিটিশ নীলকরদের বিরুদ্ধে সংগঠিত হয়ে আন্দোলন শুরু করেন। তিতুমীরের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হিন্দুদের পাশাপাশি ধনী মুসলমানরাও ছিলেন। কোনও কোনও ঐতিহাসিক বলেছেন, তিতুমীরের সংগ্রাম ছিল প্রকৃত কৃষক বিদ্রোহ।
একটি সূত্রের দাবি, ১৮৩১-এর ১৮ নভেম্বর জেনারেল উইলিয়াম বেন্টিঙ্কের নেতৃত্বে ব্রিটিশ সৈন্যরা ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তিতুমীর ও তাঁর অনুগামীদের আক্রমণ করে। সাধারণ তলোয়ার ও হালকা অস্ত্র নিয়ে তিতুমীর ও তাঁর সৈন্যরা ব্রিটিশ সৈন্যদের আধুনিক অস্ত্রের সামনে দাঁড়াতেপারেনি। ১৯শে নভেম্বর সকালে তিন ঘন্টা লড়াইয়ের পর তিতুমীর ও তাঁর ৫০ জন সঙ্গী মারা যান৷ তিতুমীরের ৮০০ জন সঙ্গীকে গ্রেপ্তার করা হয়৷ বাঁশের কেল্লা গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়।
সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্রও বিষয়টি নিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছেন৷ তাঁর বক্তব্য, “বাংলার পাঠ্যবইয়ে ইতিহাসকে বিকৃত করা হয়েছে৷” তৃণমূলের সঙ্গে বিজেপির গোপন আঁতাতেই তিতুমীরের মতো একজন ধর্মনিরপেক্ষ নেতার চরিত্রে সম্প্রদাতিকতার রং চড়ানো হয়েছে বলে তাঁর অভিযোগ৷ এ বিষয়ে অবশ্য বইটির বিতর্কিত অংশটির লেখক বিশ্বজিৎ বাগের কোনও মন্তব্য পাওয়া যায়নি৷
[চিয়ারলিডার নেই, এবার আইপিএল ম্যাচে বাজবে রামচন্দ্রের নামগান!]
The post হিন্দুদের হত্যা-মন্দির ভাঙায় অভিযুক্ত তিতুমীর, বিতর্কে রাজ্যের পাঠ্যপুস্তক appeared first on Sangbad Pratidin.
