shono
Advertisement

পরনের অন্তর্বাস খুলে শূন্যে ওড়ানো, কেন আমেরিকায় জন্ম নিয়েছিল ‘ব্রা পোড়ানো’আন্দোলন?

'মিস আমেরিকা' প্রতিযোগিতাকে বেছে নিয়েছিলেন আন্দোলনকারীরা।
Posted: 09:08 PM Apr 08, 2023Updated: 09:21 PM Apr 08, 2023

বিশ্বদীপ দে: ‘অধিকার বুঝে নেওয়া প্রখর দাবিতে’ বারবার পথে নেমেছে মানুষ। ইতিহাস তাই-ই বলে। বঞ্চিতকে তার কথা সোচ্চারে বলার জন্য বেছে নিতে হয়েছে রাজপথকেই। আর এমন সব আন্দোলন সভ্যতাকেই নতুন নতুন মাত্রা দিয়ে এসেছে যুগ যুগ ধরে। আজ থেকে প্রায় সাড়ে পাঁচ দশক আগে আমেরিকার নিউ জার্সিতে পথে নামতে দেখা গিয়েছিল যে মহিলাদের, তাঁরা ব্রা-এর বাঁধন থেকে নিজেদের মুক্ত করে তা হাতে নিয়ে মিছিলে পা মিলিয়েছিলেন। ছুঁড়ে দিয়েছিলেন শূন্যে। পরে সেই ব্রা তাঁরা ফেলে দিয়েছিলেন ‘ফ্রিডম ট্র্যাশ ক্যানে’। কার্যতই মিথে পরিণত হয়ে যাওয়া সেই আন্দোলন জন্ম দিয়েছে কল্পকথারও। বলা হয়েছিল, সেদিন আন্দোলনরত নারীরা নাকি তাঁদের অন্তর্বাস পুড়িয়ে দিয়েছিলেন! কিন্তু সত্য়িটা হল নারীবাদীরা সেদিন তাঁদের ব্রা পোড়াননি। তবে বাকিটা সত্য়ি। নিজেদের উপর হতে থাকা অবদমন ও পীড়নকে ছুঁড়ে ফেলে প্রকৃত স্বাধীনতার সন্ধানেই তাঁরা একত্রিত হয়েছিলেন।

Advertisement

ইতিহাস মনে রেখেছে সেই তারিখ। ১৯৬৮ সালের ৭ সেপ্টেম্বর। কেবল ব্রা নয়, হাই হিল জুতো থেকে লিপস্টিক কিংবা ঘর মোছার মপ- সবই সেদিন ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলেন নারীবাদীরা। জনমানসে বিপুল প্রভাব ফেলে দিয়েছিল সেদিনের সেই আন্দোলন। কিন্তু কেন এমন এক আন্দোলন দানা বাঁধল। কী তার প্রেক্ষাপট? এর পরিণতিই বা কী হয়েছিল? সেকথা বলার আগে একবার ছুঁয়ে দেখা যাক নারীবাদী আন্দোলনের সামগ্রিক রূপরেখাকে।

সৌজন্য: উইকিপিডিয়া

[আরও পড়ুন: ভূস্বর্গে বড়সড় দুর্ঘটনার কবলে কিরেন রিজিজু, কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর গাড়িতে ধাক্কা ট্রাকের]

‘নারীবাদ’ শব্দটির জন্ম ১৮৩৭ সালে। ফরাসি দার্শনিক চার্লস ফুয়েরার এই শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেছিলেন। ‘ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন অর দ্য মডার্ন প্রমিথিউস’ নামের বিখ্যাত বইয়ের লেখিকা মেরি শেলির মা মেরি উলস্টোনক্রাফটকেই আধুনিক নারীবাদের (Feminism) সূচনাকারী হিসেবে ধরা হয়। পাশ্চাত্যের আধুনিক নারীবাদী আন্দোলনকে ভাগ করা হয় মূলত তিনটি ঢেউয়ে। প্রথম ঢেউয়ের সময়কাল ঊনবিংশ শতক ও বিংশ শতকের প্রথম ভাগ। তৃতীয় ঢেউ বিংশ শতকের নয়ের দশক (১৯৯২ সাল নাগাদ)। দ্বিতীয় ঢেউয়ের কথাই আমরা এই লেখায় বলতে চাইছি। সেই সময় নারীর সামাজিক সমতালাভের দাবিতে সোচ্চার হয়েছিলেন নারীবাদীরা। যৌন স্বাধীনতা থেকে সম্পর্ক, আর্থিক বৈষম্য- এককথায় দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে যে নানাবিধ সমস্যায় দীর্ণ হতে হয় মেয়েদের, সেই সব কিছুর বিরুদ্ধেই রুখে দাঁড়ানোর সংকল্প করেছিলেন তাঁরা। কারও কারও মত, সেটাই ছিল নারীবাদী আন্দোলনের আসল ঢেউ।

এই আন্দোলনকে এককথায় বলা হয় ‘বার্ন দ্য ব্রা’ আন্দোলন (Burn the Bra movement)। সত্য়ি সত্য়ি ব্রা না পোড়ানো হলেও এমন নামকরণ থেকে সহজেই অনুমেয়, ব্রা অর্থাৎ বক্ষবন্ধনী এখানে একটি বন্ধনেরই প্রতীক হিসেবে দেখা হয়েছে। ছয়ের দশকে কিংবদন্তি নারীবাদী জারমাইন গ্রির বলেছিলেন, ”ব্রা একটি হাস্যকর উদ্ভাবন।” এই কথাটিই যেন হয়ে উঠেছিল ১৯৬৮ সালের আন্দোলনের মূলমন্ত্র।

মেরি উলস্টোনক্রাফট

 

[আরও পড়ুন: যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের পাশে দাঁড়ানোর আরজি জানাতে ইউক্রেনের মন্ত্রী আসছেন ভারতে]

আসলে প্রতিবাদটা শুরু হয়ে গিয়েছিল আগেই। দীর্ঘদিন ধরেই মার্কিন মুলুকের মহিলারা কারও লিভিং রুমে যখনই একত্রিত হতেন, উঠে আসত ‘মেয়েলি’ সমস্যার কথা। মাসিক বা সাপ্তাহিক সেই জমায়েতগুলি কার্যত মুখে মুখেই এত বড় আন্দোলনের রূপরেখা তৈরি করে ফেলেছিল। যা বুঝিয়ে দেয়, ভিতরে ভিতরে বৈষম্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর ইচ্ছেটা কতটা প্রবল হয়ে উঠেছিল সেদিনের মার্কিন নারীদের। ‘দ্য পার্সোনাল ইজ পলিটিক্যাল’ অর্থাৎ ‘ব্যক্তিগতই রাজনৈতিক’ কথাটা হয়ে উঠেছিল একটা বার্তা। যা কিছু ব্যক্তিগত বলে গোপন রাখাই শ্রেয় বলে মনে করা হত, সেটাই সকলের সঙ্গে ভাগ করে নিতে চাইলেন অবদমিত মহিলারা। আর তার ফলেই সেগুলি হয়ে উঠল সামাজিক। সেই সময় মার্কিন সমাজে অ্যাবরশন ছিল বেআইনি। পিল কিংবা আইইউডি ছিল নিরাপদ যৌনতার উপকরণ। কিন্তু তার ভারও ছিল মেয়েদের কাঁধেই। এভাবেই ক্রমান্বয়ে জমতে থাকা ক্ষোভের ফুলকি জমছিল। যা বিস্ফোরিত হল ৭ সেপ্টেম্বর, ১৯৬৮ তারিখে।

এই আন্দোলনের জন্য তাঁরা বেছে নিলেন সেই বছরের ‘মিস আমেরিকা’ প্রতিযোগিতার। আমেরিকার দুই-তৃতীয়াংশ টিভিতে সেই সময় ওই অনুষ্ঠানই চলছিল। নারীবাদীরা দেখলেন এটাই সঠিক ইভেন্ট, তাঁদের প্রতিবাদ দেখানোর জন্য। আন্দোলনকারীদের অধিকাংশেরই বয়স কুড়ির ঘরে কিংবা তিরিশের একেবারে গোড়ায়। কিন্তু তাঁদের সঙ্গেই তাঁদের মা-ঠাকুমারাও পা মিলিয়েছিলেন মিছিলে। ফ্লো কেনেডির মতো আইনজীবীও ছিলেন সেই আন্দোলনে। ১৯২১ সালে শুরু হওয়া ‘মিস আমেরিকা’ প্রতিযোগিতায় কেবল শ্বেতাঙ্গ ও সুস্বাস্থ্যের অধিকারিণীদেরই সুযোগ দেওয়া হত প্রথম দিকে। পরে সেই ট্যাবু ভাঙলেও কিন্তু অশ্বেতাঙ্গ কাউকে শিরোপা জিততে দেখা যায়নি সেই সময় পর্যন্ত। আর তাই প্রতিযোগিতার যেখানে আয়োজন হয়েছিল, তারই বাইরে পথে একটি অতিকায় পুতুল সঙ্গে নিয়ে হাজির হয়েছিলেন প্রায় চারশো নারীবাদী। সঙ্গে স্লোগান, ‘আমাদের এভাবে ব্যবহৃত হতে দেব না’।

কেবল মহিলা সাংবাদিকদের সঙ্গেই কথা বলেছিলেন আন্দোলনকারীরা

এখানেই শেষ নয়। একটি ভেড়াকে ‘মিস আমেরিকা’ সাজিয়েও মিছিলে নিয়ে আসা হয়েছিল। মহিলাদের নিছক ‘মাংস’ তথা ‘সেক্স অবজেক্ট’ হিসেবে ব্যবহার করার প্রতিবাদ হিসেবেই ভেড়ার অবতারণা। দেখা গেল মহিলারা তাঁদের ব্রা খুলে পোশাকের আড়াল থেকে বের করে এনে হাতে নিয়েই হাঁটছেন মিছিলে। তারপর একসময় সেগুলি তাঁরা ছুঁড়ে ফেলতে লাগলেন ‘ফ্রিডম ট্র্যাশ ক্যানে’। আশপাশে ভিড় করা কৌতূহলী জনতাকেও আন্দোলনে শামিল হওয়ার ডাক দেওয়া হয়েছিল। আন্দোলন কভার করতে আসা কোনও পুরুষ সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেননি আন্দোলনকারীরা। কেবল মহিলা সাংবাদিকদের সঙ্গেই কথা বলেছিলেন তাঁরা। আসলে নারীবাদীরা চেয়েছিলেন, এই খবর প্রকাশ পাক মহিলা সাংবাদিকদেরই বাই লাইনে।

সেদিনের সেই আন্দোলন জন্ম দিয়েছিল যে ঢেউয়ের, তা স্থায়ী হয়েছিল প্রায় দুই দশকের কাছাকাছি সময়ে। আটের দশকের শুরুতে নারীবাদীদের মতপার্থক্য হয় যৌনতাকে ঘিরে। এটি ‘ফেমিনিস্ট সেক্স ওয়ার্স’ নামে পরিচিত। যৌনতা ও পর্নোগ্রাফি চর্চাকে ঘিরে এই মতপার্থক্যের সূচনা। এরই ফলশ্রুতি হিসেবে ১৯৯২ সালে আন্দোলনের তৃতীয় ঢেউ। তবে সেটা অন্য আন্দোলন। 

গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল ‘মি টু’ আন্দোলন

বহু পরে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যখন ‘মি টু’ আন্দোলন শুরু হয়, তা যে উদ্দীপনা সৃষ্টি করেছিল তা মনে করিয়ে দিয়েছিল ১৯৬৮ সালের ৭ সেপ্টেম্বরের কথা। কিন্তু পাঁচ দশক পেরিয়ে এসেও কি নারীবাদীদের সেদিনের দাবিগুলি পূরণ হয়েছে? বিখ্যাত নারীবাদী পেগি ডবিন্সের কথায়, ”আমূলর পরিবর্তন ঘটিয়ে লিঙ্গসাম্যের প্রতিষ্ঠা করা কখনও রাতারাতি হওয়া সম্ভবপর নয়। মাত্র তো পঞ্চাশ বছরই পেরিয়েছে।”

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement