সুপর্ণা মজুমদার: মালকোঁচা মেরে পরা ধুতি। নিজস্ব ছন্দে উঠে গেলেন সিঁড়ি বেয়ে। নেপথ্যে চলছে ঘোষণা, সেরা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমূলক ছবি ‘ইথোস অফ ডার্কনেস’-এর (Ethos of Darkness) জন্য পুরস্কার পাচ্ছেন নির্মাতা-নির্দেশক অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়। স্মিত হাসি মুখে নিয়ে নমস্কার করে নিলেন পুরস্কার। জাতীয় মঞ্চে সেরা বাঙালি। কেন সেরা হলেন তিনি? সিনেমার অন্ধকার গলিতে আলোকপাত করে। সেই সমস্ত মানুষের কথা বলে যাঁরা সিনেমার জন্য জীবন পাত করে দিয়েও ন্যূনতম স্বীকৃতিটুকু পাননি।
ফোনে কথা বলতে গিয়ে প্রথমেই উঠল ধুতির প্রসঙ্গ। শুনেই অট্টহাসি। বাঙালির তো এমন সাজই হবে। তা দেখে নাকি আবার ‘গাঙ্গুবাঈ কাঠিয়াওয়াড়ি’র কস্টিউম ডিজাইনার মুগ্ধ। এমন সাজ তিনি পরবর্তী কাজেও ব্যবহার করতে চান। পোশাকের প্রসঙ্গ শেষ হতেই শুরু হল ‘ইথোস অফ ডার্কনেস’-এর কথা। কীভাবে শুরু হল সব? “৩৫ বছর আগে যখন কাজ শুরু করেছিলাম অ্যাসিস্ট্যান্ট অবজারভার হিসেবে”, উত্তর পরিচালক-প্রযোজকের। তিন দশক ধরে চলমান চিত্রের নানা চড়াই-উতরাইয়ের সাক্ষী তিনি। সেই অভিজ্ঞতার নির্যাস ‘ইথোস অফ ডার্কনেস’। সেই মানুষগুলোর কথা, যাঁরা অন্ধকার এক ঘরে ক্ষতিকারক রাসায়নিক ঘেঁটে ডেভলপ করতেন রিল। যে রিল থেকে তৈরি হয়েছে সুপারহিট, মেগাহিট, ব্লকবাস্টার ছবি। দর্শকদের হাততালিতে ফেটে পড়েছে সিনেমা হল। অভিনেতা হয়েছেন স্টার।
[আরও পড়ুন: নতুন নয়, বিয়ের পুরনো শাড়ি পরেই জাতীয় পুরস্কার নিলেন আলিয়া ভাট, কিন্তু কেন?]
কিন্তু সেই মানুষগুলো যাঁদের ডেভলপার বলা হতো কিংবা টেকনিশিয়ান বলা হতো? তাঁদের কথা কি কেউ জানেন বা জানতে চেয়েছেন? কীভাবে দিনের পর দিন রাসায়নিকের মধ্যে কাজ করে অসুস্থ হয়েছেন। বিনিময়ে কী পেয়েছেন? অল্প কিছু মূল্য। সিনেমার ক্রেডিট লিস্টেও তো জায়গা পাননি! সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক কিংবা উত্তমকুমারের গ্ল্যামারের বাইরেও তো চলমান চিত্রের একটা ইতিহাস আছে। কারিগরদের ইতিহাস, সাধারণ মানুষের ইতিহাস, পরিশ্রমের ইতিহাস, রাজার নয় প্রজার ইতিহাসকে ‘ইথোস অফ ডার্কনেস’ ছবির মাধ্যমে ছোঁয়ার চেষ্টা করেছেন অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়।
লকডাউনের সময় এই পরিকল্পনা পরিচালকের মাথায় আসে। তারপর শ্যাম বেনেগল, রাজকুমার হিরানি থেকে স্বপন নন্দী, শীতল চট্টোপাধ্যায়ের মতো কারিগরদের সঙ্গে কথা বলেছেন। তারপর শুটিং। তার জন্য আবার ল্যাব পাওয়া দুষ্কর ছিল। শেষে মুম্বইয়ে পুরনো আমলের দু’টি স্টুডিও পাওয়া যায় যাতে ‘ডার্করুম’ রয়েছে। তারপর একে একে ক্যামেরাম্যান সোমনাথ হালদার, এডিটর অভিজিৎ ঘোষ, কো-ডিরেক্টর দেবযানী হালদার, সংগীত পরিচালক ইন্দ্রজিৎ আদগিরি ও সাউন্ডের বিশ্বদেব বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা হয়। কেউ সামান্য পারিশ্রমিক পেয়েছেন, কেউ পারিশ্রমিক নেননি। শুধু সিনেমার সেই সমস্ত কুশীলবদের জন্য যাঁরা নিজেদের প্রাপ্য সম্মানটুকু পাননি। তাই এই জাতীয় স্বীকৃতিকে শুধুমাত্র নিজের বলতে নারাজ অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর মুখে একটাই কথা, “আমার নাম বাদ গেলে যাক, ওঁরা আলোকিত হন।”