shono
Advertisement
Uttam Kumar

'কী গো মেয়েরা আমাকে এত ভালোবাসে কেন?' আঁচল-খসা প্রেয়সীকে প্রশ্ন উত্তমের

উত্তম আবেদন! এমন বিপজ্জনক সুন্দর প্রেমিক আর কে আছে? লিখলেন রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়।
Published By: Suparna MajumderPosted: 09:59 AM Sep 03, 2024Updated: 10:02 AM Sep 03, 2024

রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়: আপনাকে মেয়েরা এমন হুমড়ি খেয়ে ভালোবাসে কেন? এ প্রশ্ন তাঁর ময়রা স্ট্রিটের বাড়িতে আমি উত্তমকুমারকে না করে পারিনি। মনে আছে, উত্তমের পরনে হিরের বোতামছুট-পাঞ্জাবি, ঢোলা পাজামা, আর মুখে গত রজনীর বাসি প্রলেপ। তবু, তাঁর উপস্থিতির সাবলীল বর্ণময়তা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের গদ্যের মতো। নিমাই ঘোষ বাঘের মতো কোনায় ওত পেতে অনর্গল ছবি তুলে যাচ্ছেন অব্যর্থ তৎপরতায় অবিস্মরণীয় মুহূর্তের। একটু দূরে, আমার এই প্রগলভ প্রশ্নের প্রতি বিরূপ কটাক্ষে, চকোলেট ছিপছিপেমি নিয়ে সুপ্রিয়া।

Advertisement

এই মুহূর্তে উত্তম একটি কাণ্ড করলেন, যা শুধু তিনিই পারেন, একমাত্র বাঙালি! তিনি তাকালেন না তাঁর বেণুর (সুপ্রিয়া) প্রতি। তাকালেন এক আঁচল-খসা রগরগে মুগ্ধার দিকে। প্রশ্ন করলেন, কোনও রকম অস্পষ্টতা ছাড়াই, "কী গো, তোমরা আমাকে এত ভালোবাসো কেন?" আর সেই আঁচল-উদাস সুন্দরী, যে সুন্দরী হয়েও বোধদীপ্ত, বলল, "কারণ তুমি ডেঞ্জারাসলি হ্যান্ডসাম। মেয়েরা ভালোবাসে ভালোমানুষ নির্ভরযোগ্য স্বামী আর বিপজ্জনক সুন্দর প্রেমিক।"

আজ থেকে প্রায় বিয়াল্লিশ—তেতাল্লিশ বছর আগের ঘটনা তো। তখন বাঙালি মেয়েরা অনেক আধুনিক ছিল। তারা পুরুষের টাকা ভালোবাসত না। ভালোবাসত পুরুষের বিপজ্জনক সেক্স অ্যাপিল। নেশা ধরানো ক্যারিশমা। উত্তমকুমার কোন গাড়ি চাপেন, সেটা কোনও ব্যাপার ছিল না তাদের কাছে। উত্তম যদি আদর করেন, কেমন হতে পারে সেই বেষ্টনী, সেই ঘেঁষটানি, সেই ঘেরন, সেই চক্রব্যূহ এবং সেই চাঁদমারি, এইসব ভেবে তখনকার বাঙালি আধুনিকা পৌঁছত তার চম্পূতে, তার চয়নিকায়, তার চরিতার্থতায়। শুধু এইটুকু ভেবেই ঘটে যেত তার শরীর-মনের চর্যাগীতি। তার মৌচাকে মধু ঝরত। সে সত্যিই ছুঁতে পারত নিধুবন ও রাগমোচন। আমার যৌবনের আধুনিকারা কখনও ভাবত না প্রেমিক-পুরুষটির ব্যাঙ্ক ব্যালেন্সের কথা। দীপ্ত সংলাপই যথেষ্ট ছিল সেই সব সুন্দরীর স্মরোদ্দীপনের জন্য।

জোঁকের মুখে যেমন নুন, রোমান্সের মুখে তেমনি ব্যস্ততা। এ যুগের কেরিয়ার-তাড়িত ব্যস্ততা রোমান্সের শরীর প্রৌঢ়ের ত্বকের মতো ভাঁজে ভাঁজে শিথিল করে দিয়েছে। রোমান্টিক প্রেম এখন লোলচর্ম। উত্তমকুমার তাই বাঙালির শেষ রোমান্টিক নায়ক। এ-যুগের বাঙালি মেয়ে এই রোম্যান্টিক-নায়কের যোগ্যতা অর্জনে একান্ত অপারগ। জীবনে যতবার আমি উত্তমকুমারের (Uttam Kumar) সঙ্গে কিছুক্ষণ কাটিয়েছি, প্রতিবার মনে হয়েছে, এই মানুষটির টান দুর্নিবার। বুঝতে পেরেছি, আমার যদি এই অবস্থা, বাঙালি মেয়েদের কী অবস্থা হয় তাঁর সামনে। সেলফোন ও সেলফির যুগ তখন অনেক দূরে। আমরা কেউ ভাবতেই পারি না, উত্তম-সুচিত্রা পরস্পরের মুখোমুখি, অথচ তারা পরস্পরের রাগ-অনুরাগে টলমল না করে সেলফোনের ফেসবুক-চর্চায় যে যার মতো ডুবে আছে।

[আরও পড়ুন: রাজস্থানে ভেঙে পড়ল বায়ুসেনার মিগ-২৯ বিমান, প্রাণরক্ষা পাইলটের]

উত্তমকুমার তার নায়িকাদের সঙ্গে দেখা হলেই তো শুধু বলে প্রেমের কথা, মান-অভিমানের কথা, প্রকাশ করে রতি ও শৃঙ্গারের নানা অব্যর্থ বিভা ও ভঙ্গি। উত্তমের সংলাপ লেখেন প্রেমেন্দ্র মিত্র, নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ, অচিন্ত্য সেনগুপ্ত, সুবোধ ঘোষ। ‘অগ্নিপরীক্ষা’র উত্তমকুমার থেকে ‘বিপাশা’-র উত্তমকুমার, ‘হার মানা হার’-এর উত্তম থেকে ‘প্রিয় বান্ধবী’-র উত্তম, বাঙালি পুরুষের রোম্যান্টিক আবেদনের ‘হারানো সুর’, যা কোনওদিন আর ফিরে আসবে না। যেমন হারিয়ে গেছে বাংলা আধুনিক গানের স্বর্ণযুগ, তেমনি হারিয়ে গেছে বাঙালি রোমান্সের সোনার সময়। বাঙালি মনের উড়ান থেকে একটি একটি করে ঝরে গেছে রঙিন পালক। বাঙালি নারীর মনে সেই রানওয়ে আর নেই যেখান থেকে সে উত্তমকুমারের মতো আদিগন্ত নায়কের আশ্লেষে পাড়ি দিতে পারে। বাঙালি নারীর জগৎ এখন বড্ড বেশি বস্তুবাদী। তার নায়ককে সে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে যায় পণ্যবস্তু-ভারাক্রান্ত কোনও না কোনও শপিং মলের অন্তঃপুরে। যেখানে দোকানে-দোকানে শুধু লোভের গায়ে, চাহিদার বুকে প্রাইস-ট্যাগ।

নায়কের কাছে বাঙালি নায়িকার একটিই ছলেবলে চতুর প্রার্থনা, আমার জন্য ফেলো কড়ি। তবেই তো মাখবে তেল। উত্তমকুমারের কাছে সে যুগের বাঙালি নায়িকার ছিল একটিই চাহিদা-স্বপ্ন। এই স্বপ্নের জন্য বাঙালি নারীর প্রেম বারবার উত্তমকে বলেছে, তোমার জন্য সব পারি আমি, হেলায় হারাতে পারি সমাজ-সংসার। তোমাকে বাঙালি নারীর মন ও শরীরকে সেভেন প্যাকে বাঁধতে হবে না। বাঁধো আমাদের সাত পাকে। সে বাঁধনে আমরা সর্বস্ব দিয়ে আটকে থাকতে চাই। উত্তমকুমার ছিলেন বাঙালি নারীকে টেনে নেওয়ার, আটকে রাখার এক অলৌকিক যন্ত্র।

আজকের বাঙালি পুরুষ এত পেয়েও উত্তমের সেই অরোধ্য সেক্স-অ্যাপিল হারিয়েছে। বাঙালি নায়ক শরীরচর্চায় বাহুবলী হচ্ছে বটে। তার স্মার্টনেসের তুলনা নেই। কিন্তু বাঙালির নরম গরম লাবণ্য যে হারিয়ে গেল পিনদ্ধ পেশির প্রদর্শনে। উত্তমকুমারের যৌন আবেদনে তিনি বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছিলেন বাঙালি পৌরুষের সহজাত লাবণ্য। তাঁর অভিনয়ে কোথাও সরব হয়ে ওঠেনি শরীরের শক্তি। তাঁর রোম্যান্সেও শরীরের টানটা সব সময়ে বিচরণ করেছে সাংকেতিক নেপথ্যে। সেটাই তো উত্তমের অননুকরণীয় অভিজ্ঞান। তিনি ‘ডাক’ ফুটিয়েছেন দৃষ্টিতে, ভঙ্গিতে, সংলাপে, গানে। আর বাঙালি নায়িকা ‘সাড়া’ ফুটিয়েছে আশ্লেষে, অভিমানে, বিরহে, সমর্পণে।

সেই বাঙালি মেয়ে তো আর নেই। কোথায় হারিয়ে গেল তার সুচিত্রা-মধুরিমা, সুপ্রিয়া-সোহাগ! বাঙালি নারীই তো বন্ধ করে দিল দরজা রোমান্সের প্রান্তিক প্রতীক উত্তমকুমারের মুখের উপর। চৌকাঠ থেকে ফিরিয়ে দিল তাঁকে। সেই সোনার হরিণ আর কোনওদিন ফিরবে না। তার হরিণী কোথায়? কার ডাকে, কার আছে সে ফিরবে?

[আরও পড়ুন: ‘লজ্জিত ও দুঃখিত…’, ‘বোনাস’ মন্তব্যে ক্ষমাপ্রার্থী কাঞ্চনের ভিডিও বার্তা]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

হাইলাইটস

Highlights Heading
  • উত্তম একটি কাণ্ড করলেন, যা শুধু তিনিই পারেন, একমাত্র বাঙালি! তিনি তাকালেন না তাঁর বেণুর (সুপ্রিয়া) প্রতি।
  • প্রশ্ন করলেন, কোনও রকম অস্পষ্টতা ছাড়াই, "কী গো, তোমরা আমাকে এত ভালোবাসো কেন?"
Advertisement