রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়: লেবুই হোক কিংবা সম্পর্ক, কোনও কিছু নিয়ে অতিরিক্ত কিছু করলে, তা তেতো হয়ে যেতে বাধ্য! সে বিচারে অষ্টাদশ আইপিএলের প্রথম থেকে ইডেন বাইশ গজ নিয়ে যা চলছে, তাতে পুরো বিষয়টা এতদিনে নিমপাতা-সম তেতো হয়ে যাওয়া উচিত! এবং তা হচ্ছেও।

এটা এতক্ষণে সর্বজনবিদিত যে, ইডেন পিচ নিয়ে কেকেআর মোটেও তুষ্ট নয়। আরসিবি-র বিরুদ্ধে উদ্বোধনী ম্যাচ হারার পর থেকে পিচের ‘টার্ন’ নিয়ে যে হাহাকার তারা শুরু করেছে, তা ঘরের মাঠে তিনটে ম্যাচ খেলে ফেলার পরেও থামেনি। মাঝে ইডেন কিউরেটর সুজন মুখোপাধ্যায় পিচ নিয়ে মুখ খুলেছিলেন। স্পষ্ট বলে দিয়েছিলেন যে, ইডেনের পিচ চরিত্র বদলানো সম্ভব নয়। সাইমন ডুল, হর্ষ ভোগলেরা ইডেন কিউরেটরের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন (যার প্রতিবাদস্বরূপ বিসিসিআইকে চিঠিও দিয়েছে সিএবি)। আরসিবি-র পর ইডেনে সানরাইজার্স ম্যাচ কেকেআর জিতে যাওয়ায় মনে হয়েছিল, পিচ নাটকে যবনিকা পড়ল বুঝি। আন্দাজ করা যায়নি, এত দিন ধরে যা যা ঘটেছে পিচ নিয়ে, তা নিছকই ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরির উৎসমুখ মাত্র! প্রকৃত বিস্ফোরণের ঢের বাকি।
যে বিস্ফোরণ হল, মঙ্গলবার। লখনউ সুপার জায়ান্টসের বিরুদ্ধে কেকেআর ৪ রানে ম্যাচ হেরে যাওয়ার পর। কেকেআর অধিনায়ক অজিঙ্ক রাহানে সাংবাদিক সম্মেলনে ইডেন পিচ (Eden Gardens Pitch Controversy) নিয়ে, ইডেন কিউরেটর সুজন মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে কী কী প্রকাশ্যে বলে গিয়েছেন, তা কারও আর অজানা নয়। গত রাতে সাংবাদিক সম্মেলনে রাহানে বলে যান যে, পিচ নিয়ে, হোম অ্যাডভান্টেজ নিয়ে তিনি মুখ খুলবেন না। কারণ, তিনি বলতে শুরু করলে অশান্তি বেঁধে যাবে! তবে নির্দ্বিধায় ইডেন কিউরটেরকে ‘প্রচার প্রিয়’ বলতে তিনি দু’বার ভাবেননি! এটাও রাহানে বলে দেন, ‘‘আমাদের কিউরটের প্রচার পেতে পছন্দও করেন!’’ কিন্তু তার পিঠোপিঠি সময়ে ইডেনেও আর এক দফা নাটক হয়ে যায় পিচ নিয়ে। সমান্তরাল সময়ে। যার খবর পাওয়া গেল, এ দিন। বুধবার।
কী হয়েছে? শোনা গেল, খেলা শেষে তখন মাঠে সিএবি কর্তাদের সঙ্গে কেকেআর কর্তাদের কেউ কেউও মাঠে ছিলেন। তা, সেখানেই কেকেআরের এক উচ্চপদস্থ কর্তা সিএবির এক বর্তমান পদাধিকারীকে ‘অভিনন্দন’ জানিয়ে বসেন! সংশ্লিষ্ট সেই পদাধিকারী প্রথমে বুঝতে না পেরে নাকি, সেই নাইট কর্তার কাছে জানতে চান, কেন তাঁকে অভিনন্দন জানানো হচ্ছে? উত্তরে নাকি সেই উচ্চপদস্থ কেকেআর কর্তা বলে দেন যে, “আপনারাই তো জিতলেন ম্যাচটা! তাই অভিনন্দন জানাচ্ছি!” তা, সেই সিএবি পদাধিকারী এ দিন দাবি করলেন যে, তাঁকে নাকি কেকেআর কর্তা তির্যকভাবে এ-ও বলে যান, ম্যাচ সেরার পুরস্কার ইডেন কিউরেটরকে দিয়ে যেতে!
অনেকেরই মনে হচ্ছে, পুরো ঘটনাপ্রবাহ অত্যন্ত অপমানজনক। ভারতীয় ক্রিকেট সার্কিটের সঙ্গে ওতঃপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকা এক বঙ্গ ক্রিকেটার এ দিন দুপুরে উত্তেজিতভাবে বলছিলেন, এ সমস্ত অজুহাত দিয়ে-দিয়ে কেকেআর নিজেদের রাস্তা আরও বেশি কণ্টকাকীর্ণ করে ফেলছে! “ওরা একবারও বলছে না, ভুল ব্যাটিং অর্ডার নির্বাচনে লখনউয়ের বিরুদ্ধে হারল। এর ফলে প্লেয়াররা দিব্যি ছাড় পেয়ে যাচ্ছে। ওদের ব্যর্থতার দিকে আঙুল তোলার তো কেউ নেই। প্লেয়াররাও জেনে যাচ্ছে, ইডেনে ম্যাচ হেরে গেলে পিচকে কাঠগড়ায় তুলে দিলেই চলবে।” ক্ষুব্ধভাবে সেই প্রাক্তন বাংলা ক্রিকেটার আরও যোগ করলেন যে, বাংলার কাউকে টিমের সঙ্গে রাখে না কেকেআর। না প্লেয়ার, না সাপোর্ট স্টাফ। বছরের দু’মাস আইপিএলের সময়টুকু বাদ দিয়ে দেখতে গেলে কোনও যোগাযোগই থাকে না বাংলা ক্রিকেটের সঙ্গে কেকেআরের। বলা হল, কেকেআরের সাপোর্ট স্টাফে যদি বাংলার কেউ থাকতেন, তা হলে পিচ সমস্যা অনায়াসে মিটিয়ে ফেলা যেত। গত বার নাকি গুজরাত টাইটান্স পিচ নিয়ে একই সমস্যায় পড়েছিল। কিন্তু দ্রুত পার্থিব প্যাটেলকে তারা টিমের সঙ্গে জুড়ে নিয়ে সমস্যা মিটিয়ে নেয়। পিচ নিয়েও আর কোনও ঝামেলায় পড়তে হয়নি।
পিচ একটা বিষয়। মাঠের মাপ আর একটা। গতকাল লখনউ ম্যাচে ইডেনের মাপ একদিকে ৫৭ মিটার, আর একদিকে ৭০ মিটার ছিল বলে প্রচুর কথাবার্তা হয়েছে। কেকেআর অধিনায়কও টসের সময় সেই ইডেনের ‘ডায়মেনশন’ নিয়ে বলে যান। ইডেন কিউরেটর সুজন এ দিন বললেন যে, প্রথমত যে মাপ নিয়ে প্রচার চলছে, সেটা সম্পূর্ণ ভুল। ছোট দিকটা ছিল ৬৫ মিটারের। আর বড় দিকটা ৭২ মিটারের। লম্বায় দু’টোই সত্তর। এবং যে ক’টা ছক্কা গতকাল হয়েছে, তার প্রত্যেকটা কত দূর গিয়েছে, হিসেব নিয়ে রেখেছেন! কিউরেটর বললেন, একটা-দু’টো ছয় বাদ দিলে প্রতিটা ছয় নাকি পঁচাত্তর মিটার পার করেছে!
যাক কে যাক। ঘরের মাঠে কেকেআরের পরবর্তী ম্যাচ আগামী ২১ এপ্রিল। কেমন হবে, সেই ম্যাচের পিচ? কেকেআরের চাহিদা মতো টার্ন কি থাকবে এবার ইডেন পিচে? সিএবি-র কেউ কেউ বললেন যে, ইডেনে রাইট অ্যাঙ্গেল টার্ন অসম্ভব। তাতে পিচের ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। আগামী বছর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ রয়েছে। ইডেনে খেলা আছে। পিচ নিয়ে আইসিসি চটে গেলে তখন কী হবে? তবে দেখা হবে, পিচে জল-টল দেওয়া কমিয়ে, ‘রোল’ কম করে, যতটা সম্ভব টার্ন করা যায়। যাতে একটা রফা সূত্রে আসা যায়।
দেখা যাক এবার। শেষ পর্যন্ত কী হয়? আপাতত এটুক লেখা যাক, বুধবার কেকেআর শহর ছাড়ল। আগামী ১১ এপ্রিল চিপকে তাদের পরবর্তী প্রতিপক্ষ চেন্নাই সুপার কিংস। তবে কেকেআর শহর ছাড়ল ইডেন পিচকে ‘অভিনন্দন’ জানিয়ে!