সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: খেলায় যেমন হার-জিত আছে নির্বাচনেও তেমন। ভুভারতে হেন কোনও নেতা নেই, যিনি বুক বাজিয়ে বলতে পারেন, কোনওদিন ভোটে হারিনি বা হারব না। সব নেতাই ভোটে হারেন, আবার ঘুরে দাঁড়িয়ে জেতেনও। কোনও নির্বাচনে হার বড় নেতার জন্য সাময়িক ধাক্কা হতে পারে, কিন্তু একটা ভোটে হারা মানেই তাঁর প্রাসঙ্গিকতাকে প্রশ্নের মুখে তুলে দেওয়াটা মুর্খামি। যদি না সেই নেতার নাম হয় অরবিন্দ কেজরিওয়াল। আসলে কেজরিওয়ালের সমস্যাটা হল, তিনি আর পাঁচজন সাধারণ রাজনীতিবিদের মতো নন। বলা ভালো, আর পাঁচজন সাধারণ রাজনীতিবিদের মতো রাজনীতির আঙিনায় পা রাখেননি 'মাফলারম্যান'।
ভারতীয় রাজনীতিতে কেজরির আমদানি অনেকটা 'অনুপ্রবেশের' মতো। মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক। আইআইটি থেকে পাশ করা। রাজনীতির সঙ্গে দূর-দুরান্ত পর্যন্ত যার সম্পর্ক নেই। তিনি আন্না হাজারেরে মঞ্চে আন্দোলন শুরু করলেন। 'ইন্ডিয়া এগেন্সট কোরাপশন' নামক মঞ্চ থেকে একের পর এক ভাষণে গোটা দেশের নজর টানলেন। বুঝিয়ে দিলেন গোটা সিস্টেম দুর্নীতিতে ভরা। সেই দুর্নীতি মুক্ত করতে দরকার আম আদমির সরকার। রাতারাতি হাজার হাজার অনুগামী জুটে গেল। যে সাফল্য অর্জন করতে গড়পড়তা রাজনীতিবিদের বছরের পর বছর সময় লেগে যায় সেই সাফল্য তিনি পেয়ে গেলেন সামান্য কয়েক মাসে। সোজা বসে গেলেন দিল্লির মুখ্যমন্ত্রীর কুরসিতে। দেশজুড়ে বিস্তার শুরু আপের। দিল্লি পেরিয়ে পাঞ্জাবে সরকার, গোয়া, গুজরাট, অসম, হিমাচল, হরিয়ানা এমনকী উত্তরপ্রদেশেও সংগঠন। মাত্র ১০ বছরে জাতীয় দলের তকমা। জাতীয় রাজনীতিতে কেজরিওয়ালের এই উল্কাগতির উত্থানের কারণ মূলত দুটো। এক, তাঁর স্বচ্ছ্ব দুর্নীতিমুক্ত ভাবমূর্তি। দুই বিকল্প রাজনীতির স্বপ্ন দেখানো।
দিল্লি এবং কেন্দ্রে কংগ্রেস আমলে যখন ভূরি ভূরি দুর্নীতির অভিযোগ, তখন অরবিন্দ কেজরিওয়াল একমুঠো খোলা হাওয়ার মতো অন্য ধারার রাজনীতির কথা বলতেন, সংস্কারের কথা বলতেন, মানুষের কথা বলতেন, দুর্নীতিহীন সিস্টেমের কথা বলতেন। সেই আবেদন জনমানসে আরও গ্রহণযোগ্য হয় তাঁর ভাবমূর্তির জন্য। নিপাট ভদ্রলোক, উদ্ধত নন, বিনয়ী, সাধারণ মানুষের কথা সহজ ভাষায় বলেন, নীতি আদর্শের জ্ঞান না কপচে বাস্তবমুখী কথা বলেন। এই দুইয়ের মিশেলেই অল্প সময়ে অভাবনীয় সাফল্য। সমস্যা হল, দুর্নীতিমুক্ত স্বচ্ছ, আম আদমির প্রতিনিধি, এই ভাবমূর্তি ছাড়া কেজরির আর কোনও রাজনৈতিক পুঁজি কখনও তৈরিই হয়নি। তাঁর সাফল্যের নেপথ্যে বড় কোনও রাজনৈতিক আন্দোলনের ইতিহাস নেই। যে ইন্ডিয়া এগেন্সট কোরাপশন কেজরিকে লাইম-লাইটে আনল, সেটাও ছিল অরাজনৈতিক আন্দোলন। কেজরি নিজেকে কোনও নির্দিষ্ট জাত বা ধর্মের প্রতিনিধি হিসাবে তুলে ধরতে পারেননি। সমাজের নির্দিষ্ট শ্রেণির প্রতিনিধি হিসাবে তুলে ধরতে পারেননি। তাঁর সমর্থক ছিলেন সব জাতের, সব ধর্মের, সব শ্রেণির। কারও সঙ্গেই আবেগের টান তৈরি হয়নি। সেটাই এতদিন তাঁর শক্তি ছিল, এবার সেটাই দুর্বলতায় পরিণত হল। ভাবমূর্তি নষ্ট হয়ে যাওয়ায় সেই সমর্থকরাই এবার দূরে সরে যাচ্ছেন।
২০২৫ বিধানসভা নির্বাচনে কেজরিওয়াল শুধু হারলেন না। তিনি নিজের ওই যৎসামান্য রাজনৈতিক পুঁজি হারালেনও। ২০১৩ সালে অরবিন্দ কেজরিওয়াল ছিলেন সত্যিকারের আমআদমি। নিম্ন মধ্যবিত্ত এবং মধ্যবিত্তরা তাঁকে নিজেদের প্রতিনিধি মনে করতেন। কিন্তু দিল্লি ভোটের আগে আবগারি দুর্নীতি, শিশমহল বিতর্ক, অতিমাত্রায় খয়রাতি, জাতপাতের সমীকরণ তৈরির চেষ্টা, কেজরির সেই ভাবমূর্তি গুঁড়িয়ে দিয়েছে। বস্তুত ২০২৫-এর দিল্লি ভোট কেজরিওয়ালের এতদিনের রাজনৈতিক পুঁজির শক্তিপরীক্ষার মঞ্চ ছিল। বিজেপির বিরুদ্ধে এক এবং অদ্বিতীয় প্রতিপক্ষ হিসাবে নিজেকেই তুলে ধরেন কেজরি। বলা বাহুল্য সেই পরীক্ষায় ডাহা ফেল করলেন কেজরি। তাঁর ভাবমূর্তি গুঁড়িয়ে গিয়েছে, তাঁর রাজনৈতিক পুঁজিও শেষ। সামনে শুধুই কঠিন রাস্তা।
আপাতত দিল্লিতে আপের হাতে ২২ বিধায়ক। পাঞ্জাবে দল ক্ষমতায়। সেরাজ্যে বছর দুই বাদে ভোট। গুজরাটে জনা কয়েক বিধায়ক আছেন। এর বাইরে গোয়া, হরিয়ানা, হিমাচল, ছত্তিশগড়, অসমে নামমাত্র সংগঠন রয়েছে। সমস্যা হল দিল্লিতে ক্ষমতায় না থাকার দরুন আগামী কয়েক বছর এই ২২ জন বিধায়ককে ধরে রাখা বিরাট চ্যালেঞ্জ হবে আপের জন্য। রাজধানীতে ক্ষমতা হারানোর অর্থ দলের বিশাল আয়ের উৎস রাতারাতি সংকুচিত হয়ে যাবে। স্বাভাবিকভাবেই ভিন রাজ্যের সংগঠনে সংকট তৈরি হবে। পাশাপাশি যে কেজরিওয়াল এতদিন দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন, তিনি এখন শুধুই একজন 'পরাজিত নেতা'। ফলে তাঁর নেতৃত্ব তথা তাঁর অনুশাসন দলে আর প্রশ্নাতীত নয়। ফলে আপের অন্দরে শৃঙ্খলার অভাবও ক্রমশ প্রকট হতে পারে। যার প্রথম প্রভাব পড়বে পাঞ্জাবে। বিজেপি দিল্লির পর পাঞ্জাবকে টার্গেট করছে, সেক্ষেত্রে পাঞ্জাবের আপ বিধায়কদের ধরে রাখাটা বিরাট চ্যালঞ্জ হতে চলেছে কেজরির জন্য। তাছাড়া যে ভগবন্ত মান এতদিন কেজরির 'আজ্ঞাবহ' হয়ে ছিলেন, এবার তিনিও উচ্চাকাঙ্খী হয়ে স্বাধীনভাবে কাজ করতে চাইলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। অতএব, এরপর কেজরিওয়াল দলের উপর কতটা নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারবেন, সেটাও একটা বড় প্রশ্ন।
তাছাড়া কেজরিওয়াল এতদিন অন্য রাজ্যে গিয়ে দিল্লি মডেলকে হাতিয়ার করে সংগঠন বাড়ানোর চেষ্টা করছিলেন। সব রাজ্যে গিয়েই তিনি দিল্লির শিক্ষা ব্যবস্থা, দিল্লির স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বড়াই করতেন, সেই দিল্লি মডেলই তাঁর হাতছাড়া। এর পর অন্য রাজ্যে সংগঠন বাড়ানোর বা ধরে রাখার জন্য নতুন কোনও অস্ত্র খুঁজতে হবে তাঁকে। সেই কাজটা আপের পক্ষে কঠিন, কারণ আপের কোনও আদর্শগত ভিত্তি নেই। এসবের বাইরে আরও একটা বড় চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে হবে কেজরিকে। সেটা হল আইনি লড়াই। জামিন পেলেও আবগারি দুর্নীতি মামলায় এখনও তিনি নির্দোষ প্রমাণিত হননি। তাছাড়া গাদাখানেক মানহানির মামলাও পড়ে রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। মামলা যে শুধু তাঁর বিরুদ্ধেই রয়েছে, তা-ই নয়। তাঁর দলের অন্য নেতাদের বিরুদ্ধেও রয়েছে। সেই নেতারা যে ভয় পেয়ে কেজরির হাত ছেড়ে বিজেপির সঙ্গ দেবেন না, কে বলতে পারে। এসবের মধ্যে আরও একটা বড় সমস্যা কেজরিওয়াল তথা আপের রয়েছে। আপের শুরুর দিকে সমাজের বিশিষ্টজনেরা, বুদ্ধিজীবীরা কেজরিকে অকুন্ঠ সহযোগিতা করে গিয়েছেন। কুমার বিশ্বাস, প্রশান্ত ভূষণ, যোগেন্দ্র যাদব, আশুতোষ। আজ তাঁরা হয় আপ থেকে বহিষ্কৃত নয়তো স্বেচ্ছায় দলত্যাগী। বস্তুত আর পাঁচটা মূল ধারার রাজনৈতিক দলের মতো আপও এখন দুর্নীতির অভিযোগে বিদ্ধ, 'অপরাধে'র সঙ্গে যুক্ত নেতায় ভর্তি। কেজরিওয়াল যে বিকল্প রাজনীতির স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন, সে স্বপ্ন মাঠে মারা গিয়েছে।
অতএব চ্যালেঞ্জ অনেক। সেই চ্যালেঞ্জ প্রতিহত করার মতো রাজনৈতিক পুঁজিও বিশেষ নেই। স্বাভাবিকভাবেই আগামী দিনে প্রাসঙ্গিকতা ধরে রাখাটা বড় চ্যালেঞ্জ কেজরিওয়ালের জন্য। তবে একই সঙ্গে এটাও ঠিক কেজরিওয়ালের রাজনৈতিক জীবনের শুরুতেও তাঁর কোনও রাজনৈতিক পুঁজি ছিল না। তখনও বহু চ্যালেঞ্জ ছিল। সেখান থেকে তিনি আপ সাম্রাজ্য গড়তে পেরেছিলেন। আবারও পারবেন কি? অন্ধ কেজরি ভক্তরা মাফলারম্যানের উপর ভরসা রাখতেই পারেন। কিন্তু এবার কেজরির পথ সত্যিই বন্ধুর।
