তাপসকুমার দত্ত: প্রতিবার পুজোয় যেমন ভ্রমণে বেরিয়ে পড়ি, এবারও তার কোনও ব্যতিক্রম হয়নি। আগে থেকে কোনও পরিকল্পনা না থাকলেও হরিদ্বার যাওয়া-আসার দূরপাল্লার ট্রেনের টিকিট চারমাস আগেই কেটে রেখেছিলাম। অবশেষে সবাই মিলে বসে একটা পরিকল্পনা করে ঠিক হল প্রথম রাত্রি হরিদ্বারে থেকে, পরের দিন বেরিয়ে পড়ব উখিমঠের উদ্দেশে। এখানে একরাত কাটিয়ে পরের দিন রওনা দেওয়া হবে সারি গ্রামে, এখান থেকেই ২‑৩ কিলোমিটার পথ বোল্ডার ফেলা রাস্তায় ট্রেক করে দেওরিয়াতালে পৌঁছনো যায়।
হাওড়া থেকে বেলা ১ টায় কুম্ভ এক্সপ্রেস ধরে পরের দিন সন্ধে ৭ টার সময় আমাদের ট্রেন হরিদ্বার পৌঁছল। ট্রেন অনেকটা সময়ই বিলম্ব ছিল। হরিদ্বার স্টেশন থেকে অটো ধরে সোজা চলে গেলাম কাঠিয়া বাবা সেবাশ্রমে। পরদিন ভোর পাঁচটা বাজতেই ঘুমটা ভেঙে গেল। সকাল সাড়ে সাতটায় আমাদের গাড়ি পাড়ি দিল উখিমঠের পথে। হরিদ্বার থেকে গাড়ি করে উখিমঠ যেতে প্রায় ২০৭ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হয়। প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য দেখতে দেখতে সন্ধ্যা গড়িয়ে পাহাড়ে অন্ধকার নেমে এল এবং একপশলা করে বৃষ্টিও শুরু হয়ে গেল। এইভাবে পথ চলতে চলতে প্রায় রাত সাতটার সময় উখিমঠে আমাদের গাড়ি এসে হাজির হল। উখিমঠের মন্দিরের কাছে একটা জায়গাতে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করা হল।
পরের দিন সকালবেলাতে উখিমঠ দর্শন সেরে সবাই মিলে মৌজ করে এক কাপ করে চা পান করে নিলাম। ঠান্ডার মধ্যে এক কাপ চায়ের আমেজ অসাধারণ ছিল। সকাল সাড়ে আটটার সময় আমাদের গাড়ি রওনা দিল সারি গ্রামের দিকে। সারি গ্রাম এখান থেকে মাত্র ১৫ কিলোমিটারের পথ। সাজানো গোছানো একটি ছোট গ্রাম, এখানেই আমাদের ঠিক হয়েছে লাখপথ সিং নেগির হোটেলে একরাত কাটানো। হোটেলে পৌঁছে মালপত্র গুছিয়ে রেখে এখানেই জলখাবার সেরে নিলাম। বেলা সাড়ে দশটার সময় রওনা দিলাম প্রায় আড়াই কিলোমিটার হাঁটাপথে দেওরিয়াতালের উদ্দেশে। পুরো রাস্তাটাই খুব চড়াই এবং বোল্ডার ফেলা। প্রকৃতির শোভা দেখতে দেখতে কোনও জায়গাতে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে, বিশ্রাম নিয়ে আবার পথ চলা, এইভাবে ঘণ্টা দুয়েক পরে অবশেষে দেওরিয়াতালে এসে পৌঁছলাম। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এই জায়গার উচ্চতা প্রায় ৭,৯৯৯ ফুট এবং চারদিক সবুজ বনানীতে ঘিরে আছে। এই সবুজ দেখতে দেখতে পথ চলার ক্লান্তি যেন অনেকটাই কেটে যায়। তারপর দূরে চৌখাম্বার চূড়ার দৃশ্য অসাধারণ এবং ভাগ্য ভাল থাকলে এই শৃঙ্গের প্রতিবিম্ব দেওরিয়াতালের জলেও দেখা যায়। এই দৃশ্য উপভোগ করতে হলে একটা রাত এখানকার তাঁবুতে কাটালে ভাল হয়। দেওরিয়াতালে প্রবেশ করার পর বনদপ্তর থেকে মাথাপিছু ১৫০ টাকা দিয়ে একটা টিকিট করাতে হয় এবং এই টিকিটের সময়সীমা তিনদিন থাকে।
[আরও পড়ুন: বেড়ানো ভুলেছে বাঙালি! পুজোর পরেও জমছে না পর্যটন ব্যবসা]
হিন্দুদের মতে দেবতা এখানে অবগাহন করেছেন বলে তাঁর এইরূপ নাম হয়েছে। একে আবার অনেকে ইন্দ্র সরোবরও বলে থাকেন। তবে এখানকার সাধারণ লোকের বিশ্বাস যে, যুধিষ্ঠিরের আদেশে ভীম এই সরোবর তৈরি করেন। কারণ পঞ্চপাণ্ডবের মধ্যে ভীমই ছিলেন সবথেকে বেশি শক্তিশালী। এই জায়গার প্রকৃতি অপরূপ সুন্দর। হিমালয়ের বিভিন্ন শৃঙ্গরাশির প্রতিবিম্ব এই জলে দেখার অভিজ্ঞতা ভোলার নয়। চারদিকে নীল আকাশ আর সবুজ গাছের ছড়াছড়ি। তার সঙ্গে উপরি পাওনা হল বিভিন্ন পাখির কলতান। পাখির কলতানে এই জায়গা সবসময় মুখর হয়ে থাকে। এখানকার সবুজ মাঠের গালিচায় গা টাকে এলিয়ে দিয়ে আকাশ আর তালের জলের পানে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মনটা যেন কোথাও হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। তারপর সবকিছুকে ফেলে দিয়ে আবার পিছনদিকে হাঁটাপথে সারি গ্রামে ফিরে আসা । ফিরে আসাটাই যেন বেদনাদায়ক।
কীভাবে যাবেন: হাওড়া থেকে ট্রেনে হরিদ্বার হয়ে গাড়ি ঠিক করে নিয়ে উখিমঠে পৌঁছে এখানে একরাত থেকে পরের দিন সারি গ্রামে আসা যেতে পারে।
The post পাহাড়ের বাঁকে মন হারাতে চান? কম খরচে এই জায়গাই হোক আপনার গন্তব্য appeared first on Sangbad Pratidin.