বিশ্বদীপ দে: 'বহু ব্যয়' করে দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়িয়েছেন? এবার বরং তাকান আমাদের বঙ্গভূমির কোনায় কোনায় লুকিয়ে থাকা ইতিহাস ও অনন্য নিসর্গের দিকে। 'ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া' কর্ণগড়েই মিলবে এই দুইয়ের এক অসামান্য সম্মিলন। যাঁরা 'পকেট-ফ্রেন্ডলি' ট্যুরে মনের অন্দরকে ভরিয়ে তুলতে চান, তাঁদের জন্যও পশ্চিম মেদিনীপুরের শালবনি ব্লকে অবস্থিত এই ঐতিহাসিক স্থান হতেই পারে এক চমৎকার 'ডেস্টিনেশন'। এখানে ইতিহাস এক প্রত্নচিহ্ন ধারণ করে আছে। আর আছে লাল মাটির আশ্চর্য প্রকৃতি। উদার, উদাস। মাত্র দিন দুয়েকের বেশি ছুটি নেওয়ারও দরকার পড়বে না।
ইতিহাস কথা বলে
ঝাঁসির রানি লক্ষ্মীবাইয়ের কথা সকলেরই জানা। কিন্তু তাঁরও ছয় দশক আগে কর্ণগড়ের রানি শিরোমণি রুখে দাঁড়িয়েছিলেন ব্রিটিশ সিংহের বিরুদ্ধে! চুয়াড় বিদ্রোহের অবিসংবাদী এই নেত্রীই এদেশের প্রথম রাজনৈতিক বন্দিনী। স্বামী ছিলেন রাজা অজিত সিং। তাঁর মৃত্যুর পরে ইংরেজরা চেয়েছিল কর্ণগড়ে কবজা করতে। কিন্তু রানি শিরোমণি তা মেনে নেননি। অবশ্যম্ভাবী ভাবে শুরু হয় লড়াই। তবে রানি শিরোমণি সরাসরি যুদ্ধ করেননি। কিন্তু 'কূটনৈতিক' লড়াই অবশ্যই লড়েছিলেন। ইংরেজদের বুঝিয়েছিলেন চুয়ারদের যুদ্ধে তিনি মদত দিচ্ছেন না। বরং তিনিই আক্রান্ত হতে পারেন। এসবই ছিল 'আড়াল'। ভিতরে ভিতরে তিনিই প্রাণিত করেন বিদ্রোহীদের।
শেষপর্যন্ত অবশ্য ব্রিটিশদের হাতে বন্দি হন রানি। মুক্তি পাওয়ার পরে জীবনের শেষ বারো বছর আবাসগড়ের দুর্গে কাটান। শোনা যায়, তিনি নজরবন্দি ছিলেন। বন্দি অবস্থাতেই নাকি রহস্যমৃত্যু হয়েছিল ব্রিটিশদের শোষণমূলক ভূমি রাজস্ব নীতির বিরুদ্ধে কৃষকদের সংগঠিত করা এই নেত্রীর। ইংরেজদের হাতে ধরা পড়ে যাওয়ার পিছনেও রয়েছে বিশ্বাসঘাতকতার মিথ।
ধ্বংসাবশেষে চলছে সংস্কারের কাজ। ছবি: কিশোর ঘোষ
১৮১২ সালে মৃত্যু হয়েছিল রানির। এরপর কেটে গিয়েছে দুশো বছরেরও বেশি সময়। আজও সেই বিদ্রোহের অগ্নিতে ভাস্বর ইতিহাস জেগে রয়েছে কর্ণগড়ের ধ্বংসাবশেষে। রানির প্রাসাদ, হাওয়া মহল তথা জলহরি, আটচালা রীতির মন্দির, শিবমন্দির থেকে শুরু করে নানা ধ্বংসাবশেষের সংস্কার চলছে। এখানে এলেই দেখতে পাবেন কেমন করে নির্জন প্রকৃতির বুকে জেগে রয়েছে সেই বিপ্লবের আগুনে শানিত ইতিহাসের স্মারক!
ধর্ম ও ইতিহাসকে মেলায় মহামায়া মন্দির
কর্ণগড়ের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ প্রাচীন মহামায়া মন্দির ও দণ্ডেশ্বর শিব মন্দির। দশম শতকের স্থাপত্যের নিদর্শন বহন করে এই মন্দির দু'টি। রাজপরিবারের দেবতা মহামায়া আজও পূজিত হন এখানে। মন্দিরের পিছনে রয়েছে পবিত্র শিব কুণ্ড। তবে কেবল ধর্মীয় স্থান হিসেবেই নয়, ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকেও এর গুরুত্ব অপরিসীম। জানা যায়, এই মন্দির প্রাঙ্গনে বসেই মঙ্গলকাব্য শিবায়ন কাব্যের রচয়িতা রামেশ্বর চক্রবর্তী লিখতেন। আবার তন্ত্রসাধনাও করতেন। দণ্ডেশ্বর মন্দিরে দেবতার পরিবর্তে রয়েছে ৪ ফুট গর্ত, যা যোনিপীঠ হিসেবেই অভিহিত। এখানে যোনির ভেতরেও রয়েছে লিঙ্গ।
কর্ণগড়ের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ প্রাচীন মহামায়া মন্দির। ছবি: কিশোর ঘোষ
শান্ত নদীটি, পটে আঁকা ছবিটি...
কংসাবতীর শাখানদী পারাং একদা ছিল গড়ের পরিখা! এখন তা শান্ত প্রকৃতির বুকে কুলকুল করে বয়ে চলে। সেই জলের শব্দ পাখির কলকাকলির সঙ্গে মিশে চারপাশের নিসর্গকে আরও মনোরম করে তোলে। বর্ষায় অবশ্য নদী ফুলেফেঁপে ওঠে। তখন জল উঠে আসে নদীর উপরে নির্মিত সেতুকে ছাপিয়ে। কিন্তু বছরের অন্য সময়ে বিশেষ করে শীতকালে এই নদী এক ছিপছিপে তন্বী সুন্দরীর মতো প্রকৃতির বুকে শুয়ে থাকে। পারাং-এর জলে পা ডোবালে শীতলতা যেন আত্মাকে ধুইয়ে দেবে।
কংসাবতীর শাখানদী পারাং ছিল গড়ের পরিখা। ছবি: কিশোর ঘোষ
গ্রামছাড়া ওই রাঙামাটির পথ
পারাং নদীর কোল ঘেঁষে গ্রাম। চারপাশে জঙ্গল। রাতবিরেতে ভেসে আসে শিয়ালের সমবেত স্বর। কত অচেনা পাখি ঘুরে বেড়ায় জঙ্গলে। রোদ্দুর ভেঙে হাঁটতে হাঁটতে ঢুকে পড়ুন গ্রামে। দেখতে পাবেন কত আশ্চর্য দৃশ্য সেখানে জেগে আছে। হয়তো তিনতলা-দোতলা মাটির বাড়ি ছড়িয়ে ছিটিয়ে। একতলা তো আছেই। এক-আধটা বাড়ি কেবল পাকা বাড়ি। হয়তো দেখলেন বাচ্চার দল লুকোচুরি খেলছে পথের ধারের এক বাড়ির বারান্দায়৷ তাদের সম্মিলিত হাসি মন ভরিয়ে তুলবে। গোয়াল থেকে ডাকবে গবাদি পশু। ছোট্ট কোনও দোকানে বসে চা খেতে খেতে উপভোগ করুন স্থানীয় মানুষের সঙ্গ। সরল গ্রাম্য জীবনের ভিতরে নিজেকে হারিয়ে ফেলবেনই।
পারাং নদীর কোল ঘেঁষে গ্রাম। ছবি: শুভদীপ মল্লিক
কীভাবে যাবেন
হাওড়া থেকে ট্রেনে মেদিনীপুরে গিয়ে সেখান থেকে গাড়িতে বা বাসে। কলকাতা থেকে সরাসরি গাড়িতেও যেতে পারেন। আবার ট্রেনে গোদাপিয়াশাল গিয়ে সেখান থেকেও টোটোতে যাওয়া যায়। এছাড়া সরাসরি কলকাতা থেকেই বাসেও যেতে পারেন।
ছবি: শুভদীপ মল্লিক
কোথায় থাকবেন
মেদিনীপুরে থেকেও গাড়ি নিয়ে কর্ণগড়ে যেতে পারেন। কিন্তু তার চেয়েও অসাধারণ অভিজ্ঞতা হবে যদি শিরোমণির প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষের কাছেই অবস্থিত সরকারি কটেজে থাকা যায়। স্পট বুকিং করতে পারেন। খুব শিগগিরি রাজ্য পর্যটন দপ্তরের ওয়েবসাইট থেকে আগাম বুকিও করা যাবে বলে জানা যাচ্ছে। কটেজের নিজস্ব এলাকায় রয়েছে ৩৫ বিঘের দিঘি, ছোটদের পার্কের মতো নানা আকর্ষণ। এছাড়া থাকতে পারেন আশপাশের লজ বা মন্দির কর্তৃপক্ষের বিশ্রামাগারে। সপরিবারে কিংবা বন্ধুদের সঙ্গেও আসতে পারেন। কর্ণগড় আপনার মন ভরিয়ে দেবেই। ঘরের এত কাছে ইতিহাস ও প্রকৃতির এমন মেলবন্ধন সত্যিই অভূতপূর্ব।
