সদ্যোজাতের জন্মের পর তার যত্নের বিভিন্ন দিক নিয়ে অভিভাবকরা অনেক কিছু ভাবেন, তবে পরিচ্ছন্নতার সঠিক ধারণা অনেকেরই থাকে না। তাবিজ-মাদুলি পরানো, স্নানের পদ্ধতি, পোশাক ও খাবারে অসতর্কতা থেকে সংক্রমণ বা অসুখের ঝুঁকি বাড়ে। এই বিষয়ে সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন পেডিয়াট্রিশিয়ান ডা. অপূর্ব ঘোষ। লিখলেন কোয়েল মুখোপাধ্যায়।
হাসপাতালে নিউ বর্ন বিভাগে প্রবেশে দেখবেন, চারদিকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। ঝকঝকে-তকতকে। জুতো খুলে ঢুকতে হচ্ছে। হাত পরিষ্কার করে, বাচ্চাকে স্পর্শ করতে হচ্ছে। ডাক্তার-নার্স থেকে শুরু করে সকলে মাস্ক পরে আছেন। অর্থাৎ প্রথম থেকেই শিশুদের পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে বাবা-মা তথা পরিজনদের সতর্ক থাকতে হবে। তা সে সদ্যোজাত হোক বা একটু বড় বাচ্চা– পরিচ্ছন্নতা নিয়ে আপস চলবে না।
ছবি: সংগৃহীত
হাত সাফসুতরো রাখুন
শিশুদের সংস্পর্শে আমাদের যে অঙ্গটি সবার প্রথমে আসে, তা হাত। তাই তাদের স্পর্শ করার আগে হাত পরিষ্কার রাখুন। হ্যান্ডওয়াশ বা সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে নিন। স্যানিটাইজারও ভালো, কিন্তু হ্যান্ডওয়াশ ‘বেস্ট’। বহু ক্ষেত্রে হ্যান্ড স্যানিটাইজারের কোয়ালিটি খারাপ হয়। নানা ধরনের কেমিক্যাল থাকে। বাচ্চাদের হাতও যেন একইভাবে পরিষ্কার থাকে। অনেকে হাতে প্রচুর আংটি পরেন, নখ বড় বড়, তায় আবার অপরিচ্ছন্ন। এই অবস্থায় হাত ধুয়েও বিশেষ লাভ হওয়ার নয়। এই সব কিছু বাচ্চার পরিচ্ছন্নতার পথে অন্তরায় হয়ে ওঠে। বাচ্চার বাবা-মাকেই এদিকে দেখতে হবে। নোংরা হাতে বাচ্চাকে নিজেরা ধরবেন না, অন্যকেও ধরতে দেবেন না।
‘সুতো কালচারে’ সাবধান
আরও একটা বিষয় খুব চোখে পড়ে। অনেকের হাতে নানা ধরনের মন্ত্রপূত সুতো বাঁধা থাকে। কবচ-মাদুলি থাকে। বহু ক্ষেত্রে সদ্যোজাত বাচ্চার হাতে-কোমরেও এগুলো দেখা যায়। বড়রা বলেন, এগুলো বাচ্চাদের সুরক্ষার জন্য! বিষয়টি বিতর্কযোগ্য কিন্তু যেটা ঘটনা, সেটা হল এই সুতো-তাবিজ-মাদুলির কাপড় থেকে শিশুদের শরীরে জীবাণু সংক্রমণ হতে পারে। ইনফেকশন হতে পারে।
উদাহরণ দেওয়া যাক। বর্ষাকালে দেখবেন, ভিজে তোয়ালে বা গামছা সহজে শুকোয় না। কোনওভাবে শুকোলেও ভ্যাপসা দুর্গন্ধ বেরোয়। কারণ, সেখানে এক ধরনের ফাংগাস বেড়ে ওঠে। একই ঘটনা ঘটে হাতে সুতো, মাদুলির ক্ষেত্রেও। যাঁরা হাতে এসব পরেন, তাদের ওই ভিজে সুতোয় জীবাণু থাকে। তা নিয়েই বাচ্চাকে নিলে-ধরলে জীবাণু ছড়ায় দ্রুত। আবার অনেক সময় বাচ্চা হাসপাতাল থেকে বাড়িতে ফিরলেই তার গলায়-কোমরে-হাতে-পায়ে বেঁধে দেওয়া হয় কালো সুতো, মাদুলি, তাবিজ। এই সবই জীবাণুর আঁতুড়ঘর।
ছবি: সংগৃহীত
শিশু যখন মল-মূত্র ত্যাগ করে, তার ছিটে সেই মাদুলি বা সুতোর কাপড়ে লাগে। সেটা ভিজে যায়, শিশুর ত্বকের সংস্পর্শে আসে, পরে সেখানেই আবার শুকোয়। মল-মূত্র ত্যাগের পর বাচ্চার ত্বক পরিষ্কার করা হলেও সেই তাবিজ-মাদুলির কাপড় কিন্তু খুলিয়ে পরিষ্কার করা হয় না। খুব বেশি হলে মুছে দেওয়া হয়। ফলে জীবাণু থেকেই যায়। দিনের পর দিন এই রকম হওয়ায় শিশুর ব্যাকটিরিয়াল ইনফেকশন ছড়ায়। এই নিয়ে প্রতিটি মানুষের সচেতন হওয়া দরকার। বাবা-মাকেই এই দিকে নজর দিতে হবে। বাচ্চার তোয়ালে-গামছা আলাদা করুন। তা নিয়মিত পরিষ্কার করুন, শুকোন।
কাজল কি ভালো
কাজল হল পোড়া কার্বন। ক্ষতিকারক। নজর দেওয়া আটকাতে অনেকেই বাচ্চাকে কাজলের টিপ পরান। কিন্তু এটি অন্ধ কুসংস্কার ছাড়া আর কিছুই না। কুনজর কি আদৌ কাজল দিয়ে আটকানো সম্ভব? এর কোনও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই।
ঝকঝকে-তকতকে স্নান
বাচ্চাকে নিয়মিত স্নান করান। পরিচ্ছন্ন রাখুন। তার গায়ে সুতো-তাবিচ বেঁধে স্নান করালে সেই সব কিছু তো তার গায়েই শুকোবে। তার থেকে ঠান্ডা লাগবে, ইনফেকশনও ছড়াবে। কাজেই এ সব অভ্যাস যথাসম্ভব ত্যাগ করুন। অনেকে নির্দিষ্ট সময় পর-পরই বাচ্চার মাথা ন্যাড়া করে দেন। এটাও ঠিক নয়। এতে করে যেন আরও জীবাণু প্রবেশের পথ সহজ করে দেওয়া হয়! ঠিক নয়।
বাচ্চাকে সাবান মাখানো নিয়েও নানা মুনির নানা মত রয়েছে। কেউ বলেন ভালো, কেউ নিষেধ করেন। ডাক্তারদের মতে, শিশুকে স্নান করানোর সময় তার গায়ে সাবান দেওয়া যেতেই পারে, তবে ঘর বা বাথরুমের দরজা বন্ধ করে তাকে স্নান করান। যাতে বাইরের ঠান্ডা ঘরে না ঢোকে। দেখবেন, সাবানটি যেন শিশুর ত্বকের জন্য নরম হয়, উপযোগী হয়। আবার ডাক্তাররা বলেন না যে, তেলে কোনও অতিরিক্ত উপকারিতা আছে। তবুও অনেকেই শিশুকে সরষের তেল মালিশ করান। অনেক বাবা-মা আবার তেল মাখিয়ে বাচ্চাকে রোদে ফেলে রাখেন দীর্ঘ সময়। মনে করেন, এভাবে শিশুদের শরীরে সূর্যালোক থেকে ভিটামিন ডি প্রবেশ করে। কিন্তু এখন সব বাচ্চাকেই ভিটামিন ডি ওষুধ খাওয়ানো হয়। কাজেই রোদে ফেলে রেখে তা ‘ইনটেক’ করানো অর্থহীন।
বাচ্চাকে অনেকে শ্যাম্পু করাতে ভয় পান। ভুল অভ্যাস। বাচ্চার মাথা পরিষ্কার রাখতে সাবান-শ্যাম্পু ব্যবহার উপকারী। তবে যথেচ্ছ নয়। আমাদের গরমের দেশ, ঘামের দেশ। আমাদের দেশে সকলেরই পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখতে সাবান-শ্যাম্পু ব্যবহারের দরকার বেশি। সদ্যোজাত হোক বা তিন-চার বছর বয়সি, বাচ্চার জামা-কাপড়ও নিয়মিত পরিষ্কার করুন। নিজেরাও স্নান করুন নিয়মিত। যে বাটি-চামচ বা বোতলে শিশুকে দুধ খাওয়ান, সেটাও যেন রোজ পরিষ্কার করা হয়, গরম জলে ফোটানো হয়।
বাইরের খাবারে ‘না’
তিন-চার বছরের থেকে বড় বাচ্চা যারা, তাদের ক্ষেত্রেও পরিচ্ছন্নতা রক্ষার কিছু সাধারণ নিয়ম মেনে চলা উচিত। যেমন তাদের জামা-কাপড় যেন রোজ কাচা-ধোওয়া হয়, ঘাম বা ধুলোবালি না জমে, দেখতে হবে। দ্বিতীয়ত, বাইরের খাবার না খাওয়া হয়। বড় বাচ্চাদের রোগভোগের অন্যতম বড় কারণই হল বাইরের অস্বাস্থ্যকর খাওয়া দাওয়া। ওরা বাইরের জলও খাবে না। বাড়িতে জল ফুটিয়ে খেতে হবে।
হোম ‘ক্লিন’ হোম
বাড়িতে যে ঘরে বাচ্চা থাকছে, সেখানে জুতো পরে ঢুকবেন না। যাঁরা বাড়ির ভিতরে জুতো রাখেন, তাঁরা মেঝেতে না ফেলে রেখে নির্দিষ্ট র্যাকে রাখুন। বাইরের ময়লা-জীবাণু যেন ভিতরে না ঢোকে। বাবা-মা-দাদু-ঠাকুমা-সহ পরিবারের সকলের ‘ওরাল হাইজিন’ মেনটেন করা জরুরি। যারা বাচ্চাকে কোলে নিচ্ছে, চুমু খাচ্ছে, কানের কাছে-মুখের কাছে এসে কথা বলছে, তাদের সতর্ক থাকতে হবে।
সু-অভ্যাস করান
বাচ্চার বাবা-মাকে কয়েকটি স্বাস্থ্যবিধি সন্তানকে মেনে চলাতে হবে। যেমন, স্বাস্থ্যকর খাবারদাবার খাওয়ানোর অভ্যাস করান। এমন ডায়েট চার্ট হোক যেখানে চর্বি কম, চিনি কম। কালারড খাবার, ফ্লেভারড খাবার কম। প্যালিও ডায়েট আদর্শ। গুগল করে দেখে নিতে পারেন। জোর করে বাচ্চাদের খাওয়াবেন না। বাচ্চাদের নিজে হাতে খাওয়ানোর অভ্যাস করান। সব কিছুতে বাড়ির বড়দের কথা অন্ধভাবে অনুসরণ না করে, যুক্তি-বুদ্ধিতে মেপে, ডাক্তারের পরামর্শমতো এগোনোই শ্রেয়।