কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী তাঁর বাজেটে খাদ্য ভরতুকি, ১০০ দিনের কাজের প্রকল্প, সারের ভরতুকি, মিড ডে মিল ইত্যাদি খাতে বরাদ্দ গত বছরের তুলনায় ছাঁটাই করেছেন। তার কোপ পড়ছে বাংলার জন্য বরাদ্দের ক্ষেত্রে। এর পিছনে যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য রয়েছে, তা কি অজানা বিষয়? লিখলেন সুতীর্থ চক্রবর্তী
বিক্রয়কর সংগ্রহের সাংবিধানিক অধিকার ছেড়ে দেওয়া যে রাজ্যগুলির একটি বড় ভুল ছিল, সেটা সম্প্রতি জানিয়েছেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (Mamata Banerjee)। ২০১৭ সালে জিএসটি ব্যবস্থা চালু করার আগে রাজ্যগুলির কাছ থেকে বিক্রয়কর বসানোর অধিকার কেন্দ্র নিয়ে নেয়। গোটা দেশে একটাই পরোক্ষ কর ব্যবস্থা চালুর লক্ষ্যে জিএসটি-র (GST) প্রবর্তন হয়। বিক্রয়কর ব্যবস্থায় রাজ্যগুলিতে ভিন্ন ভিন্ন কর কাঠামো ছিল। যেমনটা এখনও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে (US) রয়েছে।
জিএসটি ব্যবস্থা চালু হওয়ার পর রাজ্যগুলির আয়ে এক চূড়ান্ত সংকট তৈরি হয়েছে। আমাদের যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় খরচের প্রধান দায় রাজ্য সরকারগুলির। কিন্তু আয়ের হাতিয়ারগুলো সব কেন্দ্রের হাতে। প্রত্যক্ষ কর ব্যবস্থা বরাবর পুরোটাই কেন্দ্র নিয়ন্ত্রিত। সংবিধান প্রণয়নের সময় পরোক্ষ কর ব্যবস্থা রাজ্যের হাতে ছিল। ২০১৭-র সংবিধান সংশোধনের পর জিএসটি ব্যবস্থার মাধ্যমে সেটাও কার্যত কেন্দ্রের হাতে চলে গেল। ফলে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর ব্যবস্থার মাধ্যমে সব আয় এখন কেন্দ্র নিয়ন্ত্রণ করে। উপরন্তু কেন্দ্রের হাতে টাকা ছাপানোর ক্ষমতাও রয়েছে। ফলে রাজ্যগুলিকে আয়ের জন্য সম্পূর্ণ কেন্দ্রের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হয়।
[আরও পড়ুন: দিনভর বিঘ্নিত SBI-এর নেট ব্যাংকিং-সহ একাধিক পরিষেবা, ক্ষমা চাইল ব্যাংক]
আয়কর-সহ কেন্দ্রের তোলা প্রত্যক্ষ কর কোন রাজ্য কতটা পাবে তা ঠিক করে কেন্দ্রের তৈরি অর্থ কমিশন। প্রকল্পের বরাদ্দও ঠিক করে কেন্দ্র। জিএসটি পর্ষদের উপরেও নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের। অথচ জনকল্যাণের সিংহভাগ খরচের দায়িত্ব সাংবিধানিকভাবেই নিতে হয় রাজ্যকে। সেখানে কেন্দ্র পাশে না দাঁড়ালেও রাজ্যকে ধার করে টাকা জোগাড় করতে হয়।
এই মুহূর্তে এই সংকটে সবচেয়ে বেশি জর্জরিত বাংলা। রাজ্যের বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক প্রকল্পের প্রায় সব আর্থিক দায়িত্ব নিতে হচ্ছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। সঙ্গে কিছু কেন্দ্রীয় প্রকল্পের দায়িত্বও তাঁকে বহন করতে হচ্ছে। কিন্তু, তাঁর হাতে নিজস্ব আয় বাড়ানোর কোনও রাস্তা নেই। অতীতে বিক্রয়কর বা ভ্যাট বাড়িয়ে প্রয়োজনে রাজ্য নিজেদের আয় বাড়িয়ে নিতে পারত। জিএসটির ক্ষেত্রে তা সম্ভব নয়। জিএসটির হার ঠিক করে জিএসটি পর্ষদ, যেটা মেনে নিতে হয় রাজ্যকে। জিএসটি ব্যবস্থা চালুর পর সামগ্রিকভাবে পরোক্ষ কর আদায়ও কমেছে। জিএসটি ব্যবস্থা প্রবর্তনের সময় কেন্দ্র রাজ্যগুলিকে বলেছিল পরোক্ষ কর বার্ষিক ১৪ শতাংশ করে বাড়বে ধরে নিয়ে সবাইকে পাঁচ বছর ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে।
[আরও পড়ুন: ৪ বছর আগে নিরুদ্দেশ, মুম্বই থেকে নিউ আলিপুরের ছেলেকে ঘরে ফেরাচ্ছে সিবিআই]
কিন্তু, সেই ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ক্ষেত্রেও নানা টালবাহানা দেখাচ্ছে কেন্দ্র। একদিকে পাঁচ বছর অতিক্রান্ত এবং অন্যদিকে কাগজপত্র আটকে দিয়ে কার্যত প্রতিশ্রুত ক্ষতিপূরণ দিতেই চাইছে না তারা। রাজনৈতিক কারণে একটা অর্থনৈতিক অবরোধ গড়ে তোলার প্রচেষ্টা তো রয়েইছে। পুরনো ভ্যাট ব্যবস্থা চালু থাকলে রাজ্যগুলির এই হাল হত না। কেন্দ্র অবরোধ করলেও রাজ্য নিজের মতো বিক্রয়কর চাপিয়ে জনকল্যাণমূলক প্রকল্পের কিছু টাকা সংগ্রহ করতে পারত।
জনকল্যাণমূলক প্রকল্প নিয়ে কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদি সরকারের সঙ্গে একটা দৃষ্টিভঙ্গিজনিত তফাত রয়েছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যয়ের সরকারের। মুখে গরিব মানুষকে নিয়ে উন্নয়নের কথা বললেও মোদি সরকার ক্রমশ সামাজিক সুরক্ষা খাতে ব্যয় কমিয়ে চলেছে।
গত ১ ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমন ২০২৩-২৪-এর জন্য যে বাজেট প্রস্তাব রেখেছেন তাতে গরিব মানুষের সামাজিক সুরক্ষার দু’টি স্তম্ভ, খাদ্য ভরতুকি এবং ১০০ দিনের কাজের প্রকল্পে ব্যয় বরাদ্দ প্রচুর কমানো হয়েছে। পরিসংখ্যানগুলোর দিকে আরেকবার তাকালে বিষয়টি স্পষ্টতর হবে। কেন্দ্রীয় সরকার গত বছরের তুলনায় খাদ্যে ভরতুকি কমিয়েছে ৩১.৩ শতাংশ। লকডাউনের বছরে অর্থাৎ ২০২০-২১-এ কেন্দ্রীয় সরকার খাদ্যে ভরতুকিতে খরচ করেছিল ৫ লক্ষ ৪১ হাজার ৩৩০ কোটি টাকা। ২০২৩-২৪-এর বাজেট প্রস্তাবে সেই খরচটা কমিয়ে আনা হয়েছে ১ লক্ষ ৯৭ হাজার ৩৫০ কোটি টাকায়। অর্থাৎ, তিন বছরের মধ্যে সাড়ে ৩ লক্ষ কোটি টাকা ভরতুকি কেন্দ্র ছাঁটাই করেছে। ১০০ দিনের কাজের প্রকল্পে লকডাউনের বছরে কেন্দ্র খরচ করেছিল ১ লক্ষ ১১ হাজার ১৭০ কোটি টাকা। এবারের বাজেটে এই খাতে খরচ দেখানো হয়েছে মাত্র ৬০ হাজার কোটি টাকা। লকডাউনের আগের বছর অর্থাৎ, ২০১৯-২০ সালে কেন্দ্রীয় সরকার ১০০ দিনের প্রকল্পে খরচ করেছিল ৭১ হাজার ৬৮৭ কোটি টাকা। ৪ বছর পর কেন্দ্র ১০০ দিনের কাজের প্রকল্পে তার চেয়েও ১১ হাজার কোটি টাকা কম খরচ করতে চাইছে। অথচ, গত শনিবারই ‘সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকনমি’ যে রিপোর্ট দিয়েছে তাতে বলা হয়েছে মার্চে দেশে বেকারত্ব গত তিনমাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। গ্রামাঞ্চলে বেকারত্ব দূরীকরণে মহাত্মা গান্ধী ন্যাশনাল রুরাল এমপ্লয়মেন্ট গ্যারান্টি অ্যাক্ট তথা ১০০ দিনের প্রকল্পই সবচেয়ে বড় কর্মসূচি। কেন্দ্রীয় সরকার গরিব মানুষের জন্য সামাজিক সুরক্ষার প্রকল্পগুলিতে এইভাবে বরাদ্দ ছাঁটাই করলেও অধিকাংশ অ-বিজেপি রাজ্যই জনকল্যাণ প্রকল্পগুলিতে খরচ কমাতে রাজি নয়।
এ ব্যাপারে কেন্দ্রের নীতির সবচেয়ে বড় বিরোধী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি কোনওভাবেই গরিব কল্যাণে তাঁর সরকারের খরচ কমাতে রাজি নন। বরং এই ধরনের আরও প্রকল্প গ্রহণে তিনি আগ্রহী। উলটোদিকে, মোদি সরকার গরিব কল্যাণমূলক প্রকল্পে খরচ কমিয়ে পরিবহণ, যোগাযোগ প্রযুক্তি ও শক্তিক্ষেত্রে সরকারি খরচ বাড়িয়েছে। নির্মলা সীতারমনের এবারের বাজেট ভাষণে বলা হয়েছে, কেন্দ্রীয় সরকার আগামী এক বছরে মূলধনী খাতে ব্যয় ৩৭.৪ শতাংশ হারে বাড়াবে। টাকার অঙ্কে এটা ১০ লক্ষ কোটি টাকা। নির্মলা জানিয়েছেন, ২০২০ সালে কেন্দ্র জাতীয় আয়ের ১.৭ শতাংশ মূলধনী খাতে ব্যয় করেছিল। আগামী বছর সেটা হবে জাতীয় আয়ের ৩.৩ শতাংশ। মূলধনী আয়ের অতিরিক্ত এই টাকা কেন্দ্র কোথা থেকে সংগ্রহ করবে? পরিষ্কারভাবে নির্মলা তঁার বাজেটে খাদ্য ভরতুকি, ১০০ দিনের কাজের প্রকল্প, সারের ভরতুকি, মিড ডে মিল ইত্যাদি খাতে বরাদ্দ গতবছরের তুলনায় অনেকটাই ছাঁটাই করেছেন। কেন্দ্র যে অর্থ ছাঁটাই করছে, তার বড় কোপ আবার পড়ছে বাংলার জন্য বরাদ্দের ক্ষেত্রে। কেন্দ্রের জনকল্যাণমূলক প্রকল্পগুলি থেকে বাংলার বরাদ্দ কার্যত শূন্য করে দেওয়া হচ্ছে। এর পিছনে যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য রয়েছে, তা কোনও শিশুকে বুঝিয়ে দেওয়ারও প্রয়োজন নেই।
কেন্দ্রের সঙ্গে রাজ্যের এই সংঘাত কোথায় গিয়ে পৌঁছবে তা এখনই বলা যাচ্ছে না। আপাতত বিষয়টি ধরনা ও অবস্থানের মধ্যে সীমাবদ্ধ রয়েছে। ভবিষ্যতে রাজ্য জিএসটি ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার মতো কঠোর পদক্ষেপের দিকেও যেতে পারে বলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হুমকি দিয়েছেন। এক্ষেত্রে অন্যান্য অ-বিজেপি রাজ্য সরকারগুলি যে তাঁর পাশে দাঁড়াবে তা বলাই বাহুল্য। রাজ্যগুলি জিএসটি ব্যবস্থা পণ্ড করতে ঐক্যবদ্ধ হলে কিন্তু মুখ পড়বে মোদি সরকারের।