বিশ্বদীপ দে: যত সময় যাচ্ছিল, ততই বাড়ছিল আশঙ্কা। কী হবে ওই ৪১ জন শ্রমিকের? সুড়ঙ্গের অন্ধকারে বসে থাকা মানুষেরা কি বেরিয়ে আসতে পারবেন আলোর পৃথিবীতে? শেষ পর্যন্ত মঙ্গলবার সন্ধেয় স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল গোটা দেশ। দেখল অন্ধকারের উৎস থেকে কীভাবে উৎসারিত হয় আলো। উত্তরকাশীর ঘটনা বুঝিয়ে দিয়ে গেল, মানুষের পাশে মানুষকেই থাকতে হবে। কোনও এআইয়ের সাধ্য নেই মানুষের শক্তিকে ক্ষুণ্ণ করার।
শক্তি চট্টোপাধ্যায় লিখেছিলেন, ‘মানুষ বড় কাঁদছে, তুমি মানুষ হয়ে পাশে দাঁড়াও।/ মানুষ বড় একলা, তুমি তাহার পাশে এসে দাঁড়াও।’ কবির এই চিরকালীন হয়ে যাওয়া আর্জিই যেন উত্তরকাশীর ঘটনাতেও অনুরণিত হল। আর সেই ডাকে সাড়া দিয়ে মানুষই এসে দাঁড়াল বিপন্ন মানুষের পাশে। অথচ শুরুতে ভরসা ছিল যন্ত্রেই। কাজ হয়নি ‘অত্যাধুনিক’ ড্রিলিং মেশিনে। সুড়ঙ্গের ভিতর বিকল হয়ে যায় শুরুতে আশা জাগানো ‘অগার’ মেশিন। শেষে হাত লাগাতে হল মানুষকেই। নেহাতই নিষিদ্ধ হয়ে যাওয়া এক খনন পদ্ধতিতেই এল সাফল্য। সোজা কথায় বললে, ইঁদুর যেভাবে মাটিতে গর্ত খোঁড়ে একেবারে সেই পদ্ধতিতেই গর্ত খুঁড়ে উদ্ধার করা হল বিপন্ন শ্রমিকদের।
[আরও পড়ুন: ‘খারাপ কিছু হয়ে গেলে যে কী হত!’, উত্তরকাশীর শ্রমিকদের সামনে আবেগপ্রবণ মোদি]
মঙ্গলবার সন্ধে থেকে কার্যত ‘হিরো’ হয়ে গিয়েছেন উদ্ধারকারীরা। তাঁদের সাফল্য যেন নতুন করে উসকে দিল এআই বনাম মানুষ বিতর্ককে। হাল আমলে বার বার উঠেছে এই প্রশ্ন। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কি মানব সভ্যতাকে ধ্বংস করে দেবে? ১৯৫০ সালে বিশ্ববন্দিত গবেষক অ্যালান টুরিং লিখেছিলেন তাঁর বিখ্যাত গবেষণাপত্র ‘কম্পিউটিং মেশিনারি অ্যান্ড ইন্টেলিজেন্স’। সেখানে তিনি প্রশ্ন তুলেছিলেন, কম্পিউটার কি সত্যি চিন্তা করতে পারে? সেই শুরু। কয়েক দশকের গবেষণার পর গত বছর চ্যাটজিপিটির (ChatGPT) আগমন ঘিরে দানা বাঁধে জল্পনা। এই চ্যাটবটের অসাধ্য নাকি কিছুই নেই! ম্যাক্স টেগমার্ক নামে এক শীর্ষস্থানীয় বিশেষজ্ঞ এআইয়ের সঙ্গে তুলনা করেছেন পৃথিবীর বুকে গ্রহাণু আছড়ে পড়ার মতো বিপদের সঙ্গে! এই আশঙ্কা স্বভাবতই কোথায় যেন এই নীল রঙের গ্রহে মানুষের দাপটের সামনে ঝুলিয়ে দিয়েছে এক বিরাট প্রশ্নচিহ্ন। তাহলে কি মানুষের দিন এবার শেষ?
তা যে নয়, সেই আশ্বাসই যেন দিয়ে গেল উত্তরকাশীর ঘটনা। বুঝিয়ে দিল, যন্ত্র তথা কৃত্রিম মেধা যতই শক্তিশালী হোক না কেন, মানুষ যদি নিজের শক্তিতে ভরসা রাখে, যদি একে অপরের হাতে হাত রেখে লড়াই চালায় তাহলে মনুষ্যত্বকে তার অভিমুখ থেকে সরানোর সাধ্য নেই কারও। তবে সেই সঙ্গে এটাও মাথায় রাখতে হবে, সারা পৃথিবী জুড়ে দক্ষিণপন্থীদের দাপটে যেভাবে বিভাজনের খেলা শুরু হয়েছে তা থেকেও সরে আসতে হবে। শঙ্খ ঘোষ লিখেছিলেন, ‘আয় আরও বেঁধে বেঁধে থাকি’। এই আহ্বানই হয়ে উঠুক সভ্যতার বীজমন্ত্র। উত্তরকাশীর (Uttarkashi) সুড়ঙ্গের মতো যে কোনও বিপদের অন্ধকার থেকেই তাহলে আলোয় ফেরা সম্ভব হবে।