অসুস্থতার কারণে কিছু দিন ছবির কাজ বন্ধ ছিল, সেই অবকাশে পাবলো পিকাসো লেখেন ‘Le Désir attrapé par la queue’, তাঁর প্রথম নাটক। নির্দেশক ছিলেন আলবেয়ার কামু। যা প্রথম অভিনীত হয় ১৯৬৭ সালে। ‘ডিজায়ার’-এর বেশ কয়েক বছর পরে লেখা হয় পিকাসোর দ্বিতীয় নাটক ‘Les Quatre Petites Filles’ বা ‘ছোট্ট চার মেয়ে’। থিয়েটার আর পিকাসোর প্রতিশ্রুতিময় সম্পর্ক গড়িয়েছিল ৪৬ বছর। লিখছেন ঋত্বিক মল্লিক।
১৯ মার্চ, ১৯৪৪। নাৎসি দখল তখন গেড়ে বসেছে পারি শহরে, তবু শীত-সন্ধ্যা সেদিনও আমেজে উজ্জ্বল পারি-র নিজস্ব উষ্ণতায়। শহরেরই একপ্রান্তে একটি বাড়িতে জমে উঠেছে সান্ধ্য অধিবেশন, পড়া হচ্ছে নতুন নাট্যকারের সদ্য-লেখা-নাটক। শখের সাহিত্য আর বাঁধা হাততালির চেনা গল্প ভেবে ঠিক এইখানটায় থমকে যাবেন না, কারণ বিভিন্ন চরিত্র-ভূমিকায় অভিনয় করে নাটকটি সেদিন যাঁরা পাঠ করছিলেন, তাঁদের নাম যথাক্রমে জাঁ পল সার্ত্র, সিমন দ্য বোভোয়া, ডোরা মার, ভ্যালেনটাইন হুগো আর পাবলো পিকাসো– এই শেষজনই আবার নাট্যকার। কুশীলবরা বসে আছেন অর্ধবৃত্তাকার একটা স্টেজমাফিক প্ল্যাটফর্মে। মঞ্চের একেবারে কোণে দাঁড়িয়ে আছেন আলবেয়ার কামু, নাট্য নির্দেশক তথা প্রযোজক। বছর তিনেক আগে একবার অসুস্থতার কারণে কিছু দিন ছবির কাজ বন্ধ ছিল পিকাসোর, রং-তুলি সরিয়ে রেখে তখনই লিখে ফেললেন ‘Desire Caught by the Tail’ (Le Désir attrapé par la queue), তাঁর প্রথম নাটক। প্রণোদনাটা অবশ্য পুরনো, ১৯৩৫ সাল নাগাদ একটা বিশেষ পর্ব জুড়ে ছবি আঁকা একপ্রকার বন্ধ-ই করে দিয়েছিলেন তিনি, তখন থেকেই কিন্তু মাথায় চেপে বসেছিল লেখালিখির ভূত।
তবে মঞ্চর সঙ্গে পিকাসোর সম্পর্ক অনেক দিনের। জাঁ ককতো পরিচালিত ব্যালে নাটক ‘প্যারাড’-এর মঞ্চসজ্জা, পর্দার ডিজাইন, পোশাক পরিকল্পনার জন্য রীতিমতো কনট্র্যাক্ট সই করে কাজ করেছিলেন তিনি। এ নিয়ে রসিকতা করে গারট্রুড স্টেইন একবার বলেও ফেলেছিলেন, ‘…so, cubism was to be put on the stage!’। থিয়েটার আর পিকাসোর এই প্রতিশ্রুতিময় সম্পর্ক গড়িয়েছিল ৪৬ বছর।
পিকাসোর জীবনীকার রিচার্ডসনের মতে, পিকাসোর লেখালিখির ক্ষেত্রে আলফ্রেড জেরি-র প্রভাব সাংঘাতিক, বিশেষ করে জেরি-র কুখ্যাত নাটক ‘উবু রোই’ (১৮৯৬) বারবার ঘুরে-ফিরে এসেছে তাঁর চেতনায়। সমালোচকদের চোখ টেনেছিল এ নাটকে মিশে থাকা ডাডাইজম, সুররিয়ালিজম এবং ফিউচারিস্ট আন্দোলনের একেবারে প্রাথমিক কাঠামো। এই ক’টি কারণে পিকাসোরও আগ্রহের শেষ ছিল না ‘উবু রোই’-কে ঘিরে। তবে পিকাসোর উপরে একইসঙ্গে উৎকট প্রভাব ফেলেছিল জেরি-র স্ক্যাটোলজি চর্চা, বা মল-মূত্র নিয়ে উত্তেজক আসক্তি। ‘ডিজায়ার’ নাটকের একটি চরিত্রের মধ্যে এই ছাপ সরাসরি দেখা যায়। ‘দ্য টার্ট’ নামে এই চরিত্রটির ধরনধারণ নাটকের গোড়া থেকেই চূড়ান্ত অশালীন। একটি দৃশ্যে তো সে দর্শকের সামনে উবু হয়ে বসে প্রস্রাব পর্যন্ত করে আর তারপর ক্রমান্বয়ে বাতকর্ম করতে থাকে। ঠিক এখানেই ‘উবু রোই’-এর সঙ্গে এই নাটকের সরাসরি সাদৃশ্য মেলে।
[আরও পড়়ুন: তালিবান সরকারকে ‘কূটনৈতিক স্বীকৃতি’ চিনের, ভারতকে অশান্ত করার ছক?]
‘ডিজায়ার’ ছয় অঙ্কের নাটক, যদিও নাটক না-বলে একে প্রহসন বলাই সমীচীন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়টা জুড়ে খিদে, খাদ্য আর যৌনতার যে তিক্ত রসায়ন তৈরি হয়েছিল নাগরিক জটিলতার মধ্যে থেকে, এ নাটকে তারই এক উদ্ভট প্রতিফলন পাঠককে তুমুল অস্বস্তির মধ্যে ফেলে দেয়। অন্যান্য প্রথাগত মহান সৃষ্টির সঙ্গে নাটকটি আদৌ তুলনীয় নয়– কোনও জটিল মানবিক সম্পর্ক, নিয়তি, বিশেষ কোনও মনে রাখার মতো পরিস্থিতি বা রীতি-নীতি বলার ধার-কাছও মাড়ায় না এ নাটক। নাটকের চরিত্রগুলোও মানুষ নয়–
‘বিগ ফুট’, ‘ওনিয়ন’, ‘দ্য টার্ট’, ‘দ্য কুইজিন’, ‘রাউন্ড এন্ড’, ‘সাইলেন্স’, ‘ফ্যাট অ্যাংজাইটি’, ‘থিন অ্যাংজাইটি’,
‘দ্য কার্টন’। রয়েছে পশুচরিত্র ‘বাও-ওয়াও’। এ নাটকের কেন্দ্রে কিন্তু আছে খাবার; চরিত্র হিসেবে ‘ওনিয়ন’, ‘টার্ট’ বা ‘কুইজিন’-এর কথা তো ছেড়েই দিলাম, প্রায় সারাক্ষণই চলছে খাবারের কথা।
খেতে পাওয়া, না-পাওয়া ঘিরে আছে একগুচ্ছ অভিযোগ, এমনকী যে কোনও জিনিসকেই খাবারের সঙ্গে তুলনা করে অদ্ভুত সাদৃশ্য টেনে আনা হয়েছে। ‘থিন’ আর ‘ফ্যাট’ অ্যাংজাইটি নামে যে দুটো চরিত্র, তাদের এই অ্যাংজাইটি বা দুশ্চিন্তাও কিন্তু আদতে সেই বেশি খাওয়া আর কম খাওয়ার সঙ্গেই সম্পর্কিত। নাটকের তৃতীয় অঙ্কের তৃতীয় দৃশ্য জুড়ে আছে ‘রাউন্ড এন্ড’ আর ‘বিগ ফুট’-এর সংলাপ আর পুরো কথোপকথনটির বিষয় খাদ্য নিয়ে নানা উদ্ভট প্রচেষ্টা।
নাটকটি পড়লেই মাথার মধ্যে একের-পর-এক ভেসে আসবে পিকাসোর আঁকা কিউবিস্ট ছবি, পিকাসোর ছবিগুলোই যেন শব্দে-বাক্যে পেয়েছে নতুন চেহারা। নাটকের সামগ্রিক ভাষা, বিশেষত ‘বিগ ফুট’-এর সংলাপ বেশ কাব্যধর্মী; নাটকে সে অবশ্য কবি-ই, এক আর্টিস্টের স্টুডিওয় বসবাস। পিকাসোর বন্ধু এবং সেক্রেটারি মারিয়ানো মিগুয়েল মঁতেন-এর কথাটা
[আরও পড়়ুন: ইউনেস্কোর কালচারাল হেরিটেজে ভারতের আরও এক অনুষ্ঠান, দুর্গাপুজোর পর এবার কী?]
এ-বিষয়ে মনে রাখার মতো, “Picasso is a painter even when he’s writing!”। এমনকী, ছবির বিমূর্ততা নাটকের মতো দৃশ্যশ্রাব্য মাধ্যমেও নিজস্ব রীতির ছাপ রেখে গিয়েছে বেশ কিছু জায়গায়। যেমন, নাটকের একেবারে শেষে দেখা যায়, জানলা দিয়ে ঢুকে এসেছে প্রায় এক মানুষ সমান বড় একটা সোনালি গোলা। সেই আলোয় চোখ ঝলসে যায় সবার। প্রত্যেকে পকেট থেকে রুমাল বের করে চোখ ঢাকার চেষ্টা করছে আর চলছে এ-ওর দিকে আঙুল তুলে চিৎকার– ‘তুমি! তুমি! তুমি!’, ধীরে ধীরে সোনালি গোলার গায়ে ফুটে ওঠে একটাই শব্দ– ‘Nobody’। এমনই নানা বিচিত্র দৃশ্যের পরত সাজিয়ে গড়ে উঠেছে পিকাসোর ‘ডিজায়ার’-এর দুনিয়া।
যতবার এই নাটক পড়া হয়েছে, শয়ে-শয়ে মানুষ উপস্থিত হয়েছে। তবে প্রথম পেশাদার মঞ্চ প্রযোজনা হয় ১৯৬৭ সালের ২০ জুলাই। ফ্রান্সের সেন্ট ত্রোপেজ শহরে, একটি সার্কাসের তাঁবুতে সেদিন অভিনয় হয়েছিল। নির্দেশনায় ছিলেন আভাঁ-গার্দ চিত্রশিল্পী এবং কবি জাঁ জাক লেবেল। আবহসংগীতের দায়িত্বে ছিল রক ব্যান্ড ‘সফট মেশিন’। পরদিন ‘দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস’-এর রিপোর্ট বলছে, ‘The tent, accommodating 800 spectators, was packed…’!
‘ডিজায়ার’-এর বেশ কয়েক বছর পরে লেখা হয় পিকাসোর দ্বিতীয় নাটক ‘The Four Little Girls’ (Les Quatre Petites Filles) বা ‘ছোট্ট চার মেয়ে’। ছয় অঙ্কের নাটকটির প্রেক্ষাপট জুড়ে থাকে একটি কিচেন গার্ডেন, ছোট্ট চারটি মেয়ে খেলার ছলে নানা মজার কার্যকলাপ চালাতে থাকে সেখানে। কিন্তু তাদের কাজ আর কথার গভীরতা যেন প্রতি মুহূর্তে আহত করে চলে জীবনকে, ঝুঁকে থাকে ভয়াবহ মৃত্যুর দিকে। অদ্ভুত খেলাগুলো ক্রমশ নিষ্পাপ চরিত্রগুলোকে বদলে দিতে থাকে মারকুটে ঈর্ষার আদলে, যেভাবে হোক ছিনিয়ে নেওয়ার হিংসা দপদপ করতে থাকে নাটক জুড়ে।
ছোটবেলায় সবাই সাধারণত যা খেলে, এই খেলাগুলো তার চেয়ে খুব আলাদা ছিল না শুরুতে। লুকোচুরি, খেলনাবাটি কিংবা কারওর মতো সেজে অভিনয়—খেলা যা-ই হোক, সময় যত গড়াতে থাকে, তা কিন্তু আর বিনোদন থাকে না। প্রথম অঙ্কের শুরুতেই ‘প্রথম’ মেয়েটি যে ডাক দেয়– “Let’s play at hurting ourselves and hug each other with fury making horrible noises”, এটাও হয়তো দেখতে নেহাতই ছেলেমানুষি খেলার মতো, কিন্তু ‘hurting ourselves’ আর ‘horrible noises’ অস্বস্তি বিষয়টাকে আর সরলরৈখিক থাকতে দেয় না। লুকোচুরি খেলতে গিয়েও সেই একই ঘটনা, অন্য আর-এক মেয়ে বলছে, ‘তুমি যদি ফিরে না এসেছ, আমি তো চলে যাবই, নিজেকে মেরে ঝুলিয়ে দেব একেবারে।’ এই জিঘাংসা আর ব্ল্যাকমেলিং আক্রান্ত শৈশব নাটক জুড়ে আক্রমণ চালিয়েছে বারবার।
[আরও পড়ুন: মমতার ফরমুলা মানবে কি কংগ্রেস?]
পিকাসোর এই নাটকের প্রতিটি মুহূর্ত যেন তাঁর ছবিরই সম্প্রসারিত দৃশ্য। তৃতীয় অঙ্কে মঞ্চসজ্জা সম্পর্কে লেখা হয়েছিল, ‘সেই এক বাগান, কিন্তু সেখানে একটা খঁাচার ভেতরে নগ্ন অবস্থায় মেয়ে চারটিকে আটকে রাখা হয়েছে।’ যৌন কামনার ফাঁদে অবরুদ্ধ শৈশব-সারল্যের এই ইমেজ মঞ্চে দেখানোর পক্ষে কিন্তু ভয়ংকর।
নাটকের পরবর্তী দৃশ্যগুলির বর্ণনাও অস্বাভাবিকতায় ভরা। মঞ্চের মাঝখানে বিশাল একটা অ্যাকোয়ারিয়ামে সাঁতার কাটছে লাল, নীল, হলুদ, সবুজ, বেগুনি আর কমলা রঙের ছ’টা মাছ। অ্যাকোয়ারিয়াম থেকে উঠে আসছে আতশবাজির ফুলকি। আবার কখনও পুরো স্টেজ ঢেকে যাচ্ছে সাদা রঙে, দেখা যাচ্ছে শুধু কয়েকটা বর্ণমালা আর সংখ্যা। সমালোচকরা অনেকেই একে বলছেন ‘ইনোসেন্স’ আর ‘ইউথ’-এর আন্তঃসম্পর্ক, যদিও জটিল এই রূপকের শেকলে বঁাধা পড়ে আছে এ নাটকের অনেকখানি অংশ। শেষদিকে একের-পর-এক দৃশ্যাবলিতে ধরা আছে শৈশব থেকে নারীত্বে বদলে যাওয়ার গল্প। রক্ত যেন ধুয়ে দিচ্ছে অতীত, সেই রক্ত আর পোড়-খাওয়া মনের প্রতীক হয়ে এসেছে মদ। আপাত অর্থহীন শব্দ-দৃশ্যের কাঠামোয় অর্থকে ধরার চেষ্টা বারবার এ নাটককে টেনে নিয়ে গিয়েছে বাস্তব থেকে অবান্তরের দিকে।
পাবলো পিকাসো তাঁর বাকি জীবনে আর কখনও নাটক লেখেননি। কিন্তু মঞ্চে তঁার উপস্থিতি রয়ে গিয়েছে বহু দিন, হয়তো এখনও। কতবার নতুন নতুন চালে অভিনীত হয়েছে পিকাসোর নাটকের জটিল টেক্সট। পিকাসোকে নিয়েও লেখা হয়েছে বেশ কয়েকটি নাটক। তবে এখানে নয়, সে-গল্পের জন্য বরাদ্দ থাকবে নতুন কোনও কিস্তি।
দ্য ফোর লিট্ল গার্লস অ্যান্ড ডিজায়ার
কট বাই দ্য টেল
পাবলো পিকাসো
তরজমা: রোল্যান্ড পেনরোজ
আলমা ক্লাসিক্স, ২০১৯