নির্বাচনের দিনক্ষণ ঠিক হওয়ার আগেই বাংলাদেশে জাতীয় সরকার গড়ার রব উঠছে উপরমহল থেকে– যেখানে প্রতিনিধি থাকবে সব দলের। এদিকে, সমীক্ষা বলছে সেখানকার জনগণের বিশ্বাসের ভিতও সমান নড়বড়ে। কাকে নির্বাচিত করলে দেশের-দশের মঙ্গল, ঠাহর করতে পারছে না পড়শি দেশ। লিখছেন সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়।
বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে জল্পনা অন্তহীন। দেশের ভিতর ও বাহির দু’ক্ষেত্রেই। বাইরের জল্পনা বলতে প্রধানত ভারত। প্রতিবেশীর ভাল থাকা-মন্দ থাকার সঙ্গে ভারতের ভাল-মন্দ ভালরকম জড়িয়ে। ভারত চায় দেশটা স্থিতিশীল ও ভাল থাকুক। সবার অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে দ্রুত নির্বাচন হোক। একটা নির্বাচিত সরকার আসুক যাতে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক এগিয়ে যেতে পারে। গুমট ভাবটা কেটে যাক।
কিন্তু বাংলাদেশের অভ্যন্তরের জল্পনা বহুমুখী। অন্তর্বর্তী সরকারের ভাবনা এক ধরনের। তারা চাইছে ক্ষমতায় যত দিন পারা যায়, টিকে থেকে পছন্দমতো সংস্কার করে যেতে, যাতে ভবিষ্যতে কোনও ‘স্বৈরাচারী’ দাপাদাপি করতে না-পারে। প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি-র ভাবনা আবার অন্যরকম। তারা দ্রুত নির্বাচন চায় যাতে নির্বাচিত সরকার দেশ শাসনের অধিকার পায়। দেড় দশক ক্ষমতার বাইরে থাকা এই দলটার কাছে পড়ে পাওয়া চোদ্দো আনার মতো মস্ত একটা সুযোগ এসেছে। তার সদ্ব্যবহার তারা করতে চাইবেই। এত বছর দেশ শাসনের পর নকড়া-ছকড়া হয়ে যাওয়া আওয়ামী লীগ বুঝে উঠতে পারছে না– কী হলে তাদের ভাল হতে পারে। প্রথম সারির সব নেতা দেশছাড়া। সমর্থকরা বোঝার চেষ্টা করছে ভোটে দাঁড়ানোর অধিকার তাদের থাকবে কি না। না থাকলে কাকে ভোট দেওয়া যায়– সেই ভাবনাও সবার সমান নয়। জামায়েতে ইসলামী আবার ভোট নিয়ে তেমন ভাবিত নয়। তারা সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের মতো করে শাখা-প্রশাখা বিস্তারে ব্যস্ত।
রাজনৈতিক দল ছাড়া বাংলাদেশের অন্য বড় প্লেয়ার সে-দেশের সেনাবাহিনী। এই বছরের শেষে ভোট করানোর উপর বারবার জোর দিয়ে আসছেন সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। বাহিনীকে ঘিরে বড় হয়ে ঝুলে আছে এক বিরাট প্রশ্নবোধক চিহ্ন। এই টালমাটাল পরিস্থিতিতে প্রতিটি ঘটনা ও পদক্ষেপই তাৎপর্যপূর্ণ। রাজনৈতিক মন্তব্যগুলিও অর্থবহ।
তার মধ্য দিয়ে বোঝা যায়, অনাগত ভবিষ্যতে কী আসতে চলেছে। দেশবাসীর মন বুঝতে সমীক্ষা হচ্ছে। সবাই একটা আন্দাজ পেতে উৎসুক।
এই অবস্থায় গত ক’দিনে কিছু ঘটনা ঘটেছে। সরকারের শরিক ও সমর্থক তিনজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি একই সময় এক ধরনের মন্তব্য করেছেন, যা নিছক কাকতালীয় বলে মনে করা ঠিক হবে না। তিন মন্তব্যের মধ্যে একটা প্যাটার্নের আভাস যেন পাওয়া যাচ্ছে। প্রথমে সেই বিশ্লেষণ। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা এবং নতুন দল জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম সামাজিক মাধ্যমে একটা ‘পোস্ট’ করেছেন। পোস্টটা সেই সময় করা যখন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনুসের চিন সফরের ‘সাফল্য’ নিয়ে অনেকেই গদগদ। সারজিস লিখেছেন, ‘প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মতো একজন স্টেটসম্যানকে পাঁচ বছরের জন্য বাংলাদেশের একটি নির্বাচিত সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা আমার আজীবন থাকবে।’
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনীতির গতিপ্রকৃতি যাঁরা নজর করেন, তঁারা জানেন, জনমত গঠনে বেশ কয়েকজন ইউটিউবারের ভূমিকা কী। এঁদের মধ্যে কেউ কেউ প্রবাসী, হাসিনার আমলে যাঁরা বিদেশে রাজনৈতিক আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন। যেমন, পিনাকী ভট্টাচার্য। ফ্রান্সে থাকা প্রবাসী এই ডাক্তার হাসিনার পতনের কিছুটা কৃতিত্ব দাবি করেন।
৩২, ধানমন্ডি গুঁড়িয়ে দেওয়ার পিছনে তঁার ভূমিকা কম ছিল না। সারজিসের পোস্ট যে-সময়, ঠিক তখন পিনাকীও একটা প্রস্তাব দেন। তিনি বলেন, ইউনুস সাহেবকে মাথায় রেখে একটা জাতীয় সরকার গড়া দরকার। সেই সরকারের উপ-প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন বিএনপি-র তারেক রহমান। অন্তর্বর্তী সরকারের যোগ্য উপদেষ্টাদের রাখা যেতে পারে। থাকবেন অন্য রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরাও। জাতীয় সরকারের মেয়াদ হবে ২০২৯ সাল পর্যন্ত, কারণ, হাসিনা থাকলে পরের ভোট ওই সময়ই হত।
কী আশ্চর্য, একই সময় একই কথা শোনা গেল ইউনুস সরকারের ধর্ম উপদেষ্টা খালিদ হোসেনের কণ্ঠেও। তাঁর বক্তব্য, একটা সরকারের পতন ঘটেছে। সেই সরকারের অবশিষ্ট সময় পূরণের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। দেশে এখন সংস্কার প্রয়োজন। সংস্কার না করে ভোট হলে রাষ্ট্র ফের নড়বড়ে হয়ে যাবে। ইউনূস সরকারের তাই ২০২৯ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকা দরকার।
হাসিনা ও আওয়ামী লীগ বিরোধী তিনজনের বক্তব্য, যুক্তি ও টাইমিং লক্ষণীয়। এই মিল নিছক কাকতালীয় ভাবা ঠিক নয় বলেই শুরু হয়েছে প্রবল চর্চা। দাবিগুলোর মধ্য থেকে বেশ কয়েকটি বিষয় ভেসে উঠছে। প্রথমত, সরকার যারা চালাচ্ছে, তারা এত দ্রুত দায়িত্ব ছেড়ে ভোটে যেতে চাইছে না। দ্বিতীয়ত, নতুন দল গড়া ছাত্ররাও চাইছে না দ্রুত ভোটে গিয়ে একমাত্র সংগঠিত দল বিএনপি-র কাছে হেরে যেতে। তারা মনে করে, দেড়-দু’বছরের মধ্যে ভোট হওয়ার অর্থ বিএনপি-র ক্ষমতায় আসা এবং সেই ‘থোড় বড়ি খাড়া, খাড়া বড়ি থোড়’। তৃতীয়ত, এই মহলের মত, মুহাম্মদ ইউনুস বাংলাদেশের একমাত্র ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর। আন্তর্জাতিক পরিচিতি সম্পন্ন ব্যক্তি। নেতৃত্ব দেওয়ার একমাত্র অধিকারী। ইতিমধ্যেই তিনি ব্যাঙ্কিং
সেক্টর শুধরে দিয়েছেন। অন্য সংস্কারও এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। দ্রুত ভোটে গিয়ে তঁাকে হারানো দেশের ভবিষ্যতের পক্ষে ক্ষতিকর।
আলোচনা চলছে ইউনুসকে নিয়েও। বলাবলি হচ্ছে, তিনি নিজেই নাকি ক্ষমতা ছাড়তে চান না। ক্ষমতাকে তিনি চিরকাল ভালবেসেছেন। আইন অনুযায়ী গ্রামীণ ব্যাঙ্কের এমডি-র বয়সের মেয়াদ ৬০ বছর হলেও তিনি ৭১ বছর বয়স পর্যন্ত সেই পদে বহাল ছিলেন। পদ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন আদালতের রায়ে ও হাসিনার তাগিদে। সেটাই ছিল তাঁর সঙ্গে হাসিনার বিরোধের প্রথম কারণ। কেউ কেউ মনে করছেন, ইউনুস নিজেই চাইছেন প্রধান উপদেষ্টা কিংবা রাষ্ট্রপতি, কোনও এক পদে আসীন থাকতে। এই প্রস্তাব তাই তাঁরই। যদিও মুখে বলছেন, সরকার চালানো তাঁর কাজ নয়। সব ছেড়েছুড়ে নির্বাসন নিয়ে চলে যেতে চান।
এই প্রস্তাব বিএনপি-র পক্ষে বিপজ্জনক। ভোটে জিতে যারা ক্ষমতায় আসার খোয়াব দেখছে, তারা কেন জাতীয় সরকারের শরিক হতে চাইবে? একমাত্র তারা-ই তাই দ্রুত নির্বাচনের জন্য সওয়াল করে চলেছে। ইদের দিন সরকারকে সতর্ক করে বলেছে, ডিসেম্বরের মধ্যে ভোট না-হলে দেশ অস্থির হবে। প্রস্তাবকরা যদিও মনে করেন, বিএনপি সম্মত হলে ভাল, না হলেও ভাল। সেক্ষেত্রে তাদের ছাড়াই জাতীয় সরকার গড়তে হবে। জাতীয় সরকার হলে ইউনূসের লাভ। ছাত্রদের নতুন দলের লাভ। জামায়েতের লাভ। অন্য দলেরও লাভ। সর্বোপরি দেশের লাভ। মানুষ স্বস্তিতে থাকবে।
বিএনপি কি আন্দোলনের মধ্য দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারকে ভোটে যেতে বাধ্য করতে পারবে? সেই ক্ষমতা তাদের আছে? এটা প্রথম প্রশ্ন। দ্বিতীয় প্রশ্ন, সেনা কী করবে? যে সেনাপ্রধান বারবার ডিসেম্বরের মধ্যে ভোট করানোর উপর জোর দিয়েছেন, তিনি এভাবে ২০২৯ পর্যন্ত অনির্বাচিতদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা মেনে নেবেন? দু’টি উত্তরই অজানা।
এসব চর্চার একটা ব্যাকগ্রাউন্ড রয়েছে। সম্ভাব্য ভোট নিয়ে ‘ইনোভিশন’ নামে বাংলাদেশের এক সংস্থার সমীক্ষা দেখাচ্ছে, মোট স্যাম্পল সাইজের ২৯.৪ শতাংশ মানুষ এখনও ঠিক করেনি কাকে ভোট দেবে। ঠিক করলেও তা প্রকাশ্যে জানাবে না এমন মানুষ ২১.৩ শতাংশ। কাকে ভোট দেবে, তা বলতে চায় না ৮.৬ শতাংশ। অর্থাৎ, ৫৯ শতাংশ মানুষ ভোট দেওয়া না-দেওয়া নিয়ে নির্বাক। বাকি ৪১ শতাংশর মধ্যে বিএনপিকে ভোট দেবে বলেছে ৪১.৭ শতাংশ, জামায়েতেকে ৩১.৬ শতাংশ, আওয়ামী লীগকে ১৩.৯ শতাংশ ও ছাত্রদের নতুন দল এনসিপিকে ভোট দেবে বলেছে ৫.১ শতাংশ। পালাবদলের সাত মাস পর বাংলাদেশের মুড কেমন– এই সমীক্ষায় তার কিছুটা আঁচ পাওয়া যাচ্ছে। সেটাই কি দেওয়াল লিখন? ইউনূসকে বহাল রেখে পরবর্তী চার বছরের জন্য জাতীয় সরকার গড়ার তাগিদও কি সেটাই?