সত্যপাল মালিকের বিস্ফোরক সাক্ষাৎকার প্রকাশ্যে আসার পর ২৪ ঘণ্টা কাটতে না কাটতেই এলাহাবাদে ঘটেছে প্রাক্তন সাংসদ ও গ্যাংস্টার আতিক আহমেদের হত্যাকাণ্ড। আতিকের হত্যাকাণ্ড দেশে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে কিছু গূঢ় প্রশ্ন সামনে নিয়ে এসেছে, যাতে এই জোড়া হত্যাকাণ্ডের পিছনে পুলিশ প্রশাসনের ভূমিকাকেও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। লোকসভা ভোটে যে এই দুই ইস্যুর ছায়া পড়বে, তা নিয়ে সংশয় নেই। লিখলেন সুতীর্থ চক্রবর্তী
জম্মু ও কাশ্মীরের প্রাক্তন রাজ্যপাল সত্যপাল মালিকের সাম্প্রতিক বিস্ফোরক সাক্ষাৎকার এবং গ্যাংস্টার আতিক আহমেদের রহস্যজনক খুন অস্বস্তি বাড়াল বিজেপির। মাস দুয়েক বাদেই সংসদের বাদল অধিবেশন শুরু হবে। বাজেট অধিবেশন আদানি ইস্যুকে সামনে রেখে হইহট্টগোলে শেষ হয়েছে। বাদল অধিবেশন সত্যপাল মালিকের সাক্ষাৎকার এবং আতিক আহমেদের হত্যাকাণ্ডকে ঘিরে যে উত্তপ্ত হবে, তা এখন থেকেই বলে দেওয়া যায়।
লোকসভা ভোট ঠিক এক বছর দূরে। লোকসভা ভোটেও যে এই দুই ইস্যুর ছায়া পড়বে, তা নিয়ে সংশয় নেই। পুলওয়ামার ঘটনা নিয়ে বিরোধীরা অতীতে বহু প্রশ্ন তুলেছে। কিন্তু সত্যপাল মালিক একেবারে হাটে হাঁড়ি ভেঙে দিয়েছেন। মালিকের অভিযোগ, প্রধানমন্ত্রী (PM Modi) তাঁকে পুলওয়ামার ঘটনার পর ফোনে বলেছিলেন, ‘‘তুম আভি চুপ রহো, ইয়ে কুছ অউর চিজ হ্যায়।’’ পুলওয়ামায় সিআরপিএফের বাসে যখন আত্মঘাতী হামলা হচ্ছিল, তখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন করবেট পার্কে। খবর পেয়ে সেখান থেকেই সত্যপাল মালিককে তিনি ফোন করেছিলেন। সত্যপাল তৎক্ষণাৎ প্রধানমন্ত্রীকে অভিযোগ করতে থাকেন, বাসে করে সিআরপিএফকে সরানোর পরিকল্পনাই ভুল ছিল। উত্তরে প্রধানমন্ত্রী নাকি মালিককে চুপ থাকতে বলেন। বিরোধীদের প্রশ্ন, ‘কুছ অউর চিজ’ কেন বলেছিলেন নরেন্দ্র মোদি? সত্যপাল মালিক তাঁর সাক্ষাৎকারে মিথ্যা বলেছেন, এমন দাবি বিজেপি বা প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের তরফে করা হয়নি। পুলওয়ামা নিয়ে মালিক যে সমস্ত মন্তব্য করেছেন, তা একজন সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিকে দিয়ে তদন্ত করে দেখা হোক বলে দাবি করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। একই রকম দাবি দেশজুড়ে অন্যান্য বিরোধী দলও তুলতে শুরু করেছে। ফলে এ ব্যাপারে আজ বা কাল বিজেপি বা প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরকে মুখ খুলতেই হবে।
[আরও পড়ুন: AI ব্যবহারের ফল, এবার পর্ন ছবিতে দেখা যেতে পারে আপনার মুখও! আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের]
সত্যপাল মালিকের বিস্ফোরক সাক্ষাৎকার প্রকাশ্যে আসার পর ২৪ ঘণ্টা কাটতে-না-কাটতেই এলাহাবাদে ঘটে যায় প্রাক্তন সাংসদ ও গ্যাংস্টার আতিক আহমেদের হত্যাকাণ্ড। আতিকের (Atique Ahmad) হত্যাকাণ্ড দেশে গণতন্ত্রর ভবিষ্যৎ নিয়ে কিছু গূঢ় প্রশ্ন সামনে নিয়ে এসেছে। যোগী সরকারের কাণ্ডকারখানা বিচার-ব্যবস্থাকে লাটে তোলার দিকে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ কি না, সেই প্রশ্ন জোরালো করছে প্রাক্তন সাংসদের হত্যাকাণ্ড। কেউ কেউ আশঙ্কা করছে, আতিক হত্যাকাণ্ডের ব্যাপ্তি সত্যপাল মালিকের বিস্ফোরক মন্তব্যকে পিছনে ঠেলে দেবে। সংসদ চালু হলে বোঝা যাবে, বিরোধীরা দু’টি ইস্যুকে সমান গুরুত্ব দিয়ে সামনে রেখে সরকারকে বিপাকে ফেলতে কতটা তৎপর। গণতন্ত্র বাঁচানোর স্বার্থে দু’টি ইস্যুর কোনওটাই যে ফেলনা নয়, তা বলা বাহুল্য।
২০১৯-এর লোকসভা ভোটের প্রচারে পুলওয়ামার ঘটনার একটা বিরাট প্রভাব ছিল। বস্তুত, পুলওয়ামার ঘটনা এবং তার জেরে বালাকোটে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ‘সার্জিকাল স্ট্রাইক’ ২০১৯-এর লোকসভা ভোটে গেমচেঞ্জারের ভূমিকা পালন করেছিল। পুলওয়ামা কাণ্ড এবং বালাকোটে প্রত্যাঘাত যে জাতীয়তাবাদী আবেগ উসকে দিয়েছিল, তা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির তরণিকে জয়ের ঘাটে পৌঁছতে সাহায্য করেছিল। এই প্রেক্ষিতে ‘কুছ অউর চিজ’-এর ব্যাখ্যা প্রকাশ্যে আসা জরুরি বলে মনে করছেন বিরোধীরা।
[আরও পড়ুন: ‘বাবাকে দিল্লি নিয়ে যাওয়ার পিছনে বড় টাকার খেলা’, মুকুল উধাও কাণ্ডে ‘রহস্য’ দেখছেন শুভ্রাংশু]
আতিক খুন হওয়ার ৪৮ ঘণ্টা আগে তার পুত্র আসাদ পুলিশের এনকাউন্টারে খতম হয়। তখন উত্তরপ্রদেশ (Uttar Pradesh) পুলিশের তরফে বলা হয়েছিল, আসাদ তার বাবার কনভয় উড়িয়ে দেওয়ার ছক কষেছিল। আতিকের আশঙ্কা ছিল, উত্তরপ্রদেশে ঢুকলে তাকে পুলিশের মদতে খতম করা হবে। গুজরাতের সবরমতী জেল থেকে বেরনোর সময় পর্যন্ত আতিক তার জীবন নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছিল। বিষয়টি সে সর্বোচ্চ আদালতের নজরেও এনেছিল। আতিকের আশঙ্কা কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই বিস্ময়করভাবে সত্যে পরিণত হয়েছে। উত্তরপ্রদেশ পুলিশ যে আশঙ্কার কথা জানিয়ে কয়েক ঘণ্টা আগে আতিকের পুত্রকে এনকাউন্টারে খতম করেছিল, সেটাও বিশাল পুলিশবাহিনীর উপস্থিতি সত্ত্বেও সত্যে পরিণত হয়েছে। এলাহাবাদের হাসপাতালের সামনে যেভাবে তিন দুষ্কৃতী আতিক ও তার ভাইকে টিভি ক্যামেরা এবং ৬০ জন পুলিশের সামনে গুলি করে হত্যা করে, তা একমাত্র হিন্দি ছবিতেই কল্পনা করা যায়। ঠান্ডা মাথার পরিকল্পনা ছাড়া এই কাজ ঘটাও সম্ভব নয়।
যোগী আদিত্যনাথ মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারে বসার পর উত্তরপ্রদেশে গত ছ’বছরে ১০ হাজারের বেশি এনকাউন্টার হয়েছে। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত একটি হিসাবে বলা হচ্ছে, যোগী-রাজ্যে প্রতি ১৩ দিন অন্তর এনকাউন্টারে একটি করে মৃত্যু হয়। একটা সময় গুজরাটে নরেন্দ্র মোদি ও অমিত শাহ এনকাউন্টারকে জলভাত করেছিলেন। কিন্তু যোগী-রাজ্যে পরপর এনকাউন্টারের ঘটনা তাঁদের স্বস্তি দিচ্ছে না। কারণ, বিশ্বে মুখ পুড়ছে ভারতের। ‘নির্বাচনী স্বৈরতন্ত্র’ বলে অাখ্যায়িত করা হচ্ছে ভারতের রাষ্ট্রব্যবস্থাকে।
আতিক ও তার ভাই আশরফের হত্যাকাণ্ডকে সরাসরি ‘এনকাউন্টার’ বলার উপায় নেই। কিন্তু ঘটনাক্রমই এমন কিছু প্রশ্নর জন্ম দিচ্ছে, তাতে এই জোড়া হত্যাকাণ্ডর নেপথ্যে পুলিশ প্রশাসনের ভূমিকাকে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। কেন আতিক ও আশরফের মতো দুই হাই প্রোফাইল গ্যাংস্টারকে গভীর রাতে একটি অন্ধকার অঞ্চলে হাঁটিয়ে হাঁটিয়ে হাসপাতালে রুটিন চেক আপের জন্য নিয়ে যাওয়া হল, তার কোনও জবাব নেই।
যে তিন দুষ্কৃতী বিনা বাধায় খুনের পর ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান দিতে দিতে পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করল, তারা কীভাবে ওই সময় আতিক ও তার ভাইয়ের যাওয়ার খবর পেল, প্রশ্ন সেখানেও। তিন দুষ্কৃতী উত্তরপ্রদেশের তিন এলাকার বাসিন্দা। এই হত্যাকাণ্ড সংগঠিত করার জন্য কে বা কারা তাদের মধ্যে সমন্বয় ঘটাল? তাদের হাতে অতি দামি তুরস্কে তৈরি পিস্তলই-বা এল কীভাবে? এইসব প্রশ্নর উত্তরের দাবিও উঠেছে। পুলিশ সূত্রে খুনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে দাবি করা হয়েছে, আত্মসমর্পণ করার পর দুষ্কৃতীরা নাকি বলেছে, নিজেদের বড় গ্যাংস্টার হিসাবে তুলে ধরতেই তারা এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে।
এমন হাস্যকর সাফাই কেন পুলিশের তরফে দেওয়া হল, প্রশ্ন তাতেও। যোগী আদিত্যনাথ আতিক-হত্যাকাণ্ডে বিচারবিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। সেই তদন্তের রিপোর্ট আদৌ কোনও দিন প্রকাশে্য আসবে কি না, কেউ জানে না। সেই তদন্তে যা-ই উঠে আসুক না কেন, গোটা ঘটনাটি যে পুলিশের মদতেই হয়েছে, আপাতত সেই সন্দেহ মানুষের মন থেকে দূর হচ্ছে না। ফলে এই ঘটনার ক্ষেত্রে যোগীর এনকাউন্টার তত্ত্বকে নিয়েই প্রশ্নের মুখে পড়তে হবে বিজেপিকে।
গণতন্ত্রে সরকারের পক্ষে বিচার-ব্যবস্থাকে এড়িয়ে এনকাউন্টারের মতো কোনও শর্টকাট পথ গ্রহণের প্রশ্ন থাকতেই পারে না। অথচ, যোগী-রাজ্যের ক্ষেত্রে সরকারকে এই শর্টকাটের পথ নিতেই বারবার দেখা যাচ্ছে। এনকাউন্টার করে অপরাধীকে নিকেষ বা বুলডোজার দিয়ে অভিযুক্তর বাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়া কোনও সভ্য সমাজেও চলতে পারে না। যোগী সরকারের এনকাউন্টার ও বুলডোজার নীতির কোনও জুতসই জবাব মোদি ও শাহর কাছেও নেই। আতিক হত্যাকাণ্ডর পর বিরোধীরা যোগীর অপসারণের দাবিতে সোচ্চার হয়েছে। সংসদ চালু হলে এই দাবি যে আরও সোচ্চার হবে, তা বলা বাহুল্য। সামনে লোকসভা ভোটের কথা মাথায় রেখে যোগীর বিরুদ্ধে কি এবার কঠোর হবেন মোদি-শাহরা? জাতীয় রাজনীতিতে এটাই আপাতত অন্যতম চর্চার বিষয় হতে চলেছে।
bapi.pratidin@gmail.com