shono
Advertisement

তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি নেহাত পরিসংখ্যান নয় তো!

বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হওয়ার স্বপ্ন একটি পরিসংখ্যান ছাড়া দেশবাসীর কাছে অন্য কোনও বার্তা বয়ে আনবে না।
Posted: 11:41 AM Dec 29, 2020Updated: 11:41 AM Dec 29, 2020

সুতীর্থ চক্রবর্তী: ২০২০ শেষ হতে আর কিছু ঘণ্টা! কীভাবে ২০২০-কে বিদায় জানানো হবে, তা নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় বিস্তর চর্চা চলছে। নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে বিভিন্ন প্রথার চল রয়েছে। কোথাও আকাশ থেকে বল নামানো হয়, কোথাও বাজি পোড়ানো হয়, কোথাও সাইরেন বাজানো হয়। বছরকে বিদায় জানাতে এইরকম ‘প্রতীকী’ কিছু করতেই হলে নিশ্চয়ই ২০২০-কে ঝাঁটাপেটা বা জুতোপেটা করে বিদায় জানানো হত। এমন একটি অভিশপ্ত বছর মানবসভ্যতায় কখনও আসেনি। এইরকম একটি বছর যেন ভবিষ্যতে আর কখনও না আসে, সেই প্রার্থনাই চলছে দিকে দিকে। দোরগোড়ায় করোনার ভ্যাকসিন দাঁড়িয়ে। আমরা আশা করছি, ২০২১ হবে নতুন করে বেঁচে ওঠার বছর। এই প্রত্যাশার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বছর-শেষে ব্রিটিশ সংস্থা ‘সেন্টার ফর ইকোনমিক অ্যান্ড বিজনেস রিসার্চ’ ভবিষ্যদ্বাণী করেছে, ২০৩০ সালের মধ্যে ভারত বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হয়ে উঠবে। নতুন বছর শুরু হওয়ার মুখে এইরকম একটি আশাবাদ মনকে প্রফুল্ল করার কথা। কিন্তু এই প্রশ্নও জাগে, দারিদ্র ও বেকারত্বের বিপুল বোঝা কাঁধে নিয়ে তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির তকমা শুধু একটি সংখ্যাতত্ত্ব ছাড়া আর কী মূল্য বহন করবে দেশের সাধারণ মানুষের কাছে?

Advertisement

[আরও পড়ুন: শিকেয় মানবিকতা! উত্তরপ্রদেশে ব্যস্ত রাস্তায় পিটিয়ে খুন যুবককে, দেখেও উদাসীন জনতা]

২০২০ সাধারণ বিশ্ববাসীর কাছে যতটা খারাপ ও অভিশপ্ত বছর হয়ে থাকবে, ততটা মন্দ হিসাবে কিন্তু গণ্য হবে না একদল ধনী মানুষের কাছে। ‘আমাজন’-এর মালিক জেফ বেজোসের কাছে কেন ২০২০ খারাপ বছর হবে? অতিমারী ও লকডাউনের মধে্য তো তাঁর ব্যবসা ও মুনাফা কয়েক গুণ বেড়েছে। পৃথিবীর ধনী ব্যক্তিদের সদ্য যে-তালিকা প্রকাশিত হয়েছে, তাতে এই বছরও শীর্ষস্থানে রয়েছেন ১৮,৭০০ কোটি ডলারের মালিক বেজোস। বিশ্বের ১৪০টি দরিদ্র দেশের চেয়েও ‘বড়লোক’ তিনি। এই অতিমারীর বছরেও পৃথিবীর ধনীতম ৫০০ ব্যক্তির আয় বৃদ্ধি পেয়েছে মোট ১.৩০ লক্ষ কোটি ডলার। এর মধে্য শুধু বৈদ্যুতিন গাড়ি নির্মাতা টেসলা কোম্পানির সিইও এলন মাস্ক এক বছরে তাঁর আয় বাড়িয়েছেন ১০ হাজার কোটি ডলারের বেশি। টাকার অঙ্কে যা সাড়ে ১০ লক্ষ কোটি টাকার কাছাকাছি। এখন তিনি পৃথিবীর ধনীদের তালিকায় দু’নম্বরে। বেজোসের ঠিক পরেই। মাইক্রোসফ্‌টের বিল গেট্‌স আপাতত ধনীদের তালিকায় তিন নম্বরে চলে গেলেও তাঁর আয়ও অতিমারীর বছরে বেড়ে ১৩,১০০ কোটি ডলারে পৌঁছেছে। ফেসবুক-কর্তা মার্ক জুকেরবার্গ অতিমারীর বছরে তাঁর সম্পত্তি বাড়িয়ে ধনীদের তালিকায় পাঁচ নম্বরে। তাঁর মোট সম্পত্তির মূল্য ১০,৫০০ কোটি ডলার। এঁরা কি সাধারণ মানুষের মতো ঘৃণাভরে ভোলার চেষ্টা করবেন ২০২০-কে?

২০২০ মনে করলেই আমাদের চোখের সামনে করোনা ভাইরাসের মহা আতঙ্ক ছাড়াও ভেসে ওঠে দেশের লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিকের পথচলা। কাঁধে সন্তানসন্ততি-সহ জীবনের সবটুকু সম্বল নিয়ে অনির্দিষ্টের পথে অনন্তকাল হেঁটে চলেছেন তাঁরা। কতজন পরিযায়ী শ্রমিকের এইভাবে পথ হাঁটতে হাঁটতে যে মৃত্যু হয়েছে, সেই পরিসংখ্যান মিলবে না কোনও দিন। কেন্দ্রীয় সরকার জানিয়ে দিয়েছে, তাদের কাছেও এই পরিসংখ্যান নেই। কিন্তু বছরশেষে মুকেশ আম্বানির সম্পদ বৃদ্ধির পরিসংখ্যান আমাদের কাছে টাটকা। সদ্য পৃথিবীর প্রথম দশ ধনীর তালিকা থেকে ছিটকে গিয়ে একাদশতম স্থানে চলে গেলে কী হবে, মুকেশ এই বছর তাঁর সম্পত্তি বাড়িয়েছেন পুরনো সব রেকর্ড ভেঙে দিয়ে মোট ১ লক্ষ ৩২ হাজার কোটি টাকা। তাঁর মোট সম্পত্তির পরিমাণ এখন ৫ লক্ষ ৭২ হাজার কোটি টাকা। সম্পত্তির অঙ্কটা শেয়ার বাজারের সঙ্গে সবসময় ওঠা-নামা করে। কিন্তু সেটা কোনও বিষয় নয়। সংবাদমাধ্যমেই প্রকাশ পেয়েছে, যেদিন থেকে দেশে লকডাউন শুরু হয়েছিল, সেদিন থেকে ধরলে মুকেশের প্রতি ঘণ্টায় আয় ছিল ৯০ কোটি টাকা। অর্থাৎ একদিকে যখন আমরা দেখছিলাম জাতীয় সড়ক ধরে লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিকের অন্তহীন পথচলা, তখন অন্যদিকে আর সংস্থা জিও-র শেয়ার গুগল, ফেসবুকের কাছে বিক্রি করে মুকেশ আয় বাড়াচ্ছিলেন প্রতি ঘণ্টায় ৯০ কোটি টাকা। দেশের ধনীদের যে শেষ তালিকা প্রকাশিত হয়েছে তাতে যথারীতি শীর্ষস্থান মুকেশের দখলেই রয়েছে। আয় বেড়েছে দেশের অন্য ধনীদেরও। একেকটা ওষুধ কোম্পানির মালিক ফুলেফেঁপে উঠেছেন। উৎপাদন শিল্পেও ছবিটা খারাপ নয়। বহু পরিষেবা ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীরা আয় বাড়িয়েছেন। তাঁদের কাছে কি ২০২০ আশীর্বাদের বছর নয়?

দেশের অর্থনীতি লকডাউনের প্রথম তিনমাসে ২৩.৯ শতাংশ সংকুচিত হয়েছে। অর্থাৎ সাধারণ মানুষের এক-চতুর্থাংশ আয় গায়েব। এই বাস্তবতার সঙ্গে কিন্তু বড় বড় ধনীর আয়-বৃদ্ধির ছবি মোটেই সংগতিপূর্ণ নয়। ২০২০-তে দেশের আয় সংকোচনের সঙ্গে সঙ্গে বেকারত্ব বেড়েছে, দারিদ্র বেড়েছে এবং সবচেয়ে বেশি বেড়েছে বৈষম্য। বিশ্বজুড়েই এই বৈষম্য বেড়েছে। বেজোস, মাস্ক, জুকেরবার্গ এবং দেশে মুকেশ আম্বানিরা তাঁদের নিজের নিজের ব্যবসায়ে একচেটিয়া আধিপত্যের দৌলতে অতিমারীতে আয় বাড়িয়েছেন, সম্পদ বাড়িয়েছেন। অন্যদিকে ২০২০ নিঃস্ব করেছে কোটি কোটি মানুষকে। অতিমারীর বছর পৃথিবীতে বৈষম্য বৃদ্ধির বছর হিসেবেও চিহ্নিত হয়ে থাকবে।

লকডাউনের তিনমাসে দেশের ২৪ শতাংশ আয় খুইয়েও ২০৩০ সালে চিন ও আমেরিকার পর ভারত বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হবে, এই তথ্য তাই খুব একটা আলোড়ন তোলে না বছর শেষে। শুধুই একটা পরিসংখ্যান বলে মনে হয়। লকডাউনের পর ওই দুঃস্বপ্নের তিনমাসের কথা ভাবলে গায়ে কাঁটা দেয় সবার। তখন কোভিড যেন প্রত্যেককে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। বেহাল স্বাস্থ্য পরিকাঠামো নিয়ে কীভাবে এই অতিমারীর মোকাবিলা করা হবে, সে ব্যাপারে তখন দিশাহারা ছিল সরকারও। সংক্রমণের সঙ্গে সঙ্গে বিপর্যয় নেমে আসছিল একেকটি পরিবারে। অন্যদিকে, সংবাদমাধ্যমে পরিযায়ী শ্রমিকদের লাগাতার দুর্দশার ছবি। যা আমাদের পীড়িত করছিল। যাঁরা দেশের উন্নয়নের এত বড় ইমারতটি নির্মাণ করেছেন, তাঁরা কীরকম অসহায়ভাবে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছেন। একইসঙ্গে ঘরে ঘরে কাজ হারানোর, আয় কমে যাওয়ার হাহাকারও। অবশেষে ওই আতঙ্কের দিনগুলো পার করে অভিশপ্ত বছরটিকে যখন ঘৃণার সঙ্গে বিদায় জানানোর মুহূর্তে আমরা দাঁড়িয়ে, তখন এটাও জানতে পারা যাচ্ছে, ওই লকডাউনেই দেশের বড় বড় ব্যবসায়ীর একটি অংশের লাভের পরিমাণ শুধুই বেড়েছে। ২০২১ সালে অর্থনীতি হয়তো ঘুরে দাঁড়াবে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, বৈষম্য এইভাবে বাড়তে থাকলে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হওয়ার স্বপ্ন একটি পরিসংখ্যান ছাড়া দেশবাসীর কাছে অন্য কোনও বার্তা বয়ে আনবে না।

[আরও পড়ুন: দেশের দৈনিক করোনা সংক্রমণ কমলেও বাড়ছে উদ্বেগ, ৬ জনের দেহে নয়া স্ট্রেনের হদিশ]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement