পাশ্চাত্য যখন রতন থিয়ামের থিয়েটার দেখে ও ‘ভারতীয়ত্ব’ দিয়ে তার ব্যাখ্যা খুঁজতে চায়– তখন পাশ্চাত্য আসলে দেখেছিল– ‘ভারত’ নামের রাষ্ট্রের একটি আঞ্চলিক ভূখণ্ডের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও রাজনৈতিক বাস্তবতাকে অভিব্যক্ত হতে। আঞ্চলিকতা যে আন্তর্জাতিকতার সামীপ্যে যেতে পারে– তার দৃষ্টান্ত রতন থিয়াম স্বয়ং। লিখছেন ব্রাত্য বসু।
রতন থিয়াম এমন একজন নাট্যপথপ্রদর্শক, যিনি ভারতীয় থিয়েটারকে আন্তর্জাতিকতার আঙিনায় প্রতিষ্ঠা করেছেন, ‘ভারতীয়’ উপাদান অক্ষুণ্ণ রেখে। এখন প্রশ্ন উঠবে, ‘ভারতীয়’ বা ‘ভারতীয়ত্ব’ বলতে কী বোঝায়। ‘ভারতীয়ত্ব’ বলতে প্রাচ্য যা বোঝে, পাশ্চাত্য তা বোঝে না। আমরা ভারতের লোকেরা জানি, ভারত রাষ্ট্র আসলে একটিই মূলমন্ত্রের উপরে দাঁড়িয়ে আছে। তা হল: বিবিধের মাঝে দেখো মিলন মহান। ফলে, ভারত যেন গুণে ও উপাদানে মিনি মহাদেশ। যখন ভারত রাষ্ট্র ‘ভাগ’ হয়েছিল, তখন পাশ্চাত্যের কিছু ইতিহাসবেত্তা বলেছিলেন যে– স্পেনের সঙ্গে ফ্রান্সের যা তফাত, বা জার্মানির সঙ্গে ইংল্যান্ডের যে তফাত, তার থেকেও অনেক বেশি তফাত– কেরলের সঙ্গে অসমের। বা, বাংলার সঙ্গে তামিলনাড়ুর। ফলে, এ রাষ্ট্র টিকবে না। কিন্তু তাঁদের ভুল প্রমাণ করে ভারত রাষ্ট্র টিকে গিয়েছে।
কিন্তু যাঁরা ‘অখণ্ড’ ভারতীয়ত্ব খুঁজতে গিয়েছেন ভাষার দিক থেকে বা সংস্কৃতির দিক থেকে বা খাদ্যাভ্যাসের দিক থেকে– তাঁরা এক সময় বুঝতে পেরেছেন– আদতে অখণ্ড ভারতীয়ত্ব বলে কিছু হয় না। সে-কারণে যে মোমো খায় সে-ও ভারতীয়, যে ধোসা খায়, সে-ও ভারতীয়। আবার, যে মণিপুরি ভাষা বলে সে-ও ভারতীয়, যে কন্নড় ভাষা বলে সে-ও ভারতীয়। ‘ভারত’ তাই বিবিধ উপাদান ও ধারণার সমষ্টি। পাশ্চাত্য যখন রতন থিয়ামের থিয়েটার দেখল, ও ‘ভারতীয়ত্ব’ দিয়ে তার ব্যাখ্যা খুঁজতে চাইল– তখন পাশ্চাত্য আসলে দেখল–ভারত নামের রাষ্ট্রের একটি আঞ্চলিক ভূখণ্ডের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও রাজনৈতিক বাস্তবতাকে অভিব্যক্ত হতে। রতন থিয়ামের যদি কোনও মণিপুরি পূর্বপুরুষ থাকে, তাঁর নাম হেইসনাম কানহাইলাল। তাঁর সঙ্গে রতন থিয়ামের পার্থক্য এইভাবে বোঝানো যেতে পারে যে, কানহাইলাল হলেন গাভাসকর, রতন থিয়াম হলেন তেণ্ডুলকর। একজন ভারতীয় ক্রিকেটকে প্রথমবার আন্তর্জাতিক পরিসরে পরিচিতি দিয়েছেন, অন্যজন সেই পরিচিতিকে আরও বড় স্তরে উন্নীত করেছেন।
অর্থাৎ প্রথমজন যদি প্রচণ্ড পরিশ্রম করে একতলা ভিতের উপর একতলা বাড়ি বানিয়ে থাকেন, দ্বিতীয়জন মাল্টিস্টোরিড বিল্ডিং বানাচ্ছেন– একইরকম পরিশ্রম করে। কানহাইলাল যে প্রজ্ঞা ও ধীশক্তি দিয়ে থিয়েটারের নন্দনতত্ত্ব তৈরি করেছিলেন– আসমুদ্রভারত তা দেখে
চমকে গিয়েছিল। আর, রতন থিয়াম সেসব উপাদানকেই আরও প্রসারিত করে পাশ্চাত্যে নিয়ে গিয়েছিলেন।
রতন থিয়াম যখন সাতের দশকের মাঝামাঝি অল্পস্বল্প পরিচিত পেতে শুরু করেন, তখন ভারতীয় থিয়েটারে নানারকম কাণ্ডকারখানা চলছে। মারাঠি থিয়েটারে আবির্ভূত হয়েছেন বিজয় তেণ্ডুলকর। মহারাষ্ট্রের জাতপাতভিত্তিক সমাজব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করে, তাকে ভেঙে, ‘নতুন ন্যারেটিভ’ তৈরি করছেন তিনি। দক্ষিণে গিরীশ কারনাড মহাভারত ও পুরাণের নির্যাস আহরণ করে নতুন ভাষ্য রচনায় মনোযোগী। পূর্বে বাদল সরকার ‘থার্ড থিয়েটার’-এর কনসেপ্ট নিয়ে আসার তীব্র প্রস্তুতি নিচ্ছেন। অর্থাৎ ভারতীয় থিয়েটার তখন নানাবিধ নিরীক্ষার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল। রতন থিয়াম ক্রমে তাঁর শৈল্পিক অভিব্যক্তির শিখরে পৌঁছবেন আটের দশকে। মণিপুরি লোকশিল্প ও মেইতেই আঙ্গিকের মধ্যে তিনি ভারতীয় পুরাণকে ঢেলে ফেললেন। ভুললে হবে না, তিনি নিজে একজন দক্ষ চিত্রশিল্পী ও ‘এনএসডি’-র প্রাক্তনী।
গুরুদের থেকে শেখা বিদ্যের সঙ্গে নিজের সংস্কৃতির শিকড়কে তিনি সাঙ্গীভূত করলেন। পুরাণ ও মহাভারতের মতো মহাকাব্য তাঁর থিয়েটারে এমন আকার ও প্রকার নিল, যাকে আমরা বলব ‘আঞ্চলিক’, কিন্তু পাশ্চাত্য বলতে ‘ভারতীয়’। বা, আমরা হয়তো আরও একধাপ এগিয়ে বলব– আঞ্চলিক হয়েও ভারতীয়, এবং ভারতীয় হয়েও আন্তর্জাতিক। আঞ্চলিকতা যে আন্তর্জাতিকতার সামীপ্যে যেতে পারে– তার দৃষ্টান্ত রতন থিয়াম স্বয়ং। প্রকরণের থেকে বিষয়ের মৌলিকতা তাঁর কাছে বরাবর প্রাধান্য পেয়েছিল।
আবার, শৈলীতে ব্যবহার করেছিলেন আন্তর্জাতিক হয়ে ওঠার যাবতীয় উপাদান। এর মিলিত পরিণতি, রতন থিয়ামের নাট্যভাষ। সৈন্যদলের প্লাটুনের মতো করে নিবিড় ওয়ার্কশপের মাধ্যমে তিনি তা জারিত করে তুলেছিলেন। রতন থিয়াম কলকাতায় আসার শুরুর দিন থেকেই আমাদের নজর কাড়েন। আশ্চর্য অতীন্দ্রিয়তা তাঁর থিয়েটারের সম্পদ, অথচ তা সমকালীন বাস্তবতা-বহির্ভূত নয়। এই যুগলবন্দিতে না-মজে আমাদের উপায় ছিল না। তাই তো রতন থিয়াম তাঁর ‘ঋতুসংহার’-এ দেখাতে পারেন, প্রকৃতির সঙ্গে রাজনীতি কত নিবিড়ভাবে অন্বিত। মেইতেই বনাম কুকিদের আস্তিত্বিক অন্তর্দ্বন্দ্ব, যা এখন আরও গভীর ও প্রখর হয়েছে, তা-ও অভিব্যক্ত হয়েছে তাঁর প্রয়োজনায়। তির্যক চোখেই দেখেছেন সমতলকে, অথচ মেনস্ট্রিম থেকে বিচ্যুত হননি।
তাঁর থিয়েটার আমাদের কাছে এমন এক ‘পঞ্চম বেদ’, যা জ্যান্ত ও প্রাসঙ্গিক। ভারতীয় থিয়েটারে যত দিন ‘নাট্যভাষা’ শব্দটি থাকবে, যত দিন তাতে প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের উপাদান খোঁজা হবে, তত দিন রতন থিয়ামও বেঁচে থাকবেন– বিজয় তেণ্ডুলকর, বাদল সরকারের মতো– নক্ষত্রের ঔজ্জ্বল্য নিয়ে। ব্যক্তিগত স্তরে তাঁর সঙ্গে যতবারই আমার দেখা হয়েছে, তাঁকে আমার সত্যিকারের সৃজনশীল ও বৌদ্ধিক মানুষ বলে মনে হয়েছে।
যে সৃজনশীলতার মধ্যে নীরস, সন্দিগ্ধ বা অহৈতুকী জটিলতা নেই। বরং রয়েছে সরস প্রাণবন্ততা। যতবার তাঁর সঙ্গে থিয়েটার নিয়ে কথা হয়েছে– হতে পারে তা গ্রিনরুমে, বা ক্লাবে, বা উদ্দাম মজলিশে– সবসময় তাঁকে নিভৃত একটি কোণে বসে থাকতে দেখেছি। বুঝতে
পেরেছি, তিনি, ‘প্রাইভেট পার্সন’।
থিয়েটারি বিশ্বের নতুন-নতুন ভাবনার আলোকচ্ছটা পেতাম তাঁর কথায়, সেই থিয়েটারি আলোচনা কখনও কচাল বা ‘গসিপ’ পরিকীর্ণ হয়ে উঠত না, যা এখন দুর্লভ। এক সত্যকারের সমাহিত ঋষিকল্পতায় সমাচ্ছন্ন নাট্যপুরুষ। আমি অবাক হয়ে দেখতাম, তিনি আমার থিয়েটার-নিরীক্ষার খবর রাখেন। ‘রুদ্ধসংগীত’ নিয়ে তাঁর সঙ্গে বিস্তৃত আলোচনা হয়েছে। এমনকী, আমার ‘পেজ ফোর’ নাটকটি নিয়ে তিনি যে মূল্যবান মতামত দিয়েছিলেন, তা এখনও আমার স্মৃতির মণিকোঠায় অম্লান। আক্ষরিক অর্থেই ব্যতিক্রমী নাট্যব্যক্তিত্ব। তাঁর সঙ্গে দেখা হলে উষ্ণ করমর্দনে হাত ঝাঁকাতাম। কিন্তু আজ তাঁকে প্রণাম না-করে উপায় নেই।
(মতামত নিজস্ব)
লেখক বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব, ঔপন্যাসিক
bratyojon@gmail.com
