‘ভাড়াটে লেখক’ অর্থের বিনিময়ে, অন্যের জন্য লেখেন। নন-ফিকশনের জগতে ‘ঘোস্ট রাইটার’-এর উপস্থিতি আকছার চোখে পড়ে। সংসদে ‘ভাড়াটে লেখক’ কথাটি অন্য তাৎপর্যে প্রয়োগ করলেন সাংসদ জয়া বচ্চন।
‘থ্রি ইডিয়টস’ সিনেমায় আমরা দেখেছি– হস্টেলে র্যাঞ্চোর কাজকর্ম নিয়ে সতর্ক না-থেকে উপায় ছিল না। কখন সে কী করে বসে, বোঝা মুশকিল। বীরু সহস্রবুদ্ধি, যে কিনা র্যাঞ্চোর ইনস্টিটিউটের সর্বেসর্বা, তাকেও সবার সামনে অপদস্থ করতে দু’বার ভাবেনি সে। ‘চমৎকারী’ পুরুষ বা কৃতিত্ববান ব্যক্তিত্ব বোঝাতে সহস্রবুদ্ধি সম্বন্ধে যে-সব মোক্ষম বিশেষণ প্রয়োগ করেছিল সাইলেন্সার, তা সামান্য রদবদলের খেলায় ভয়াবহ পরিণতি ডেকে এনেছিল। ‘চমৎকার’ শব্দটিই বদলে যায় ‘বলাৎকার’-এ। সাইলেন্সার জনসমক্ষে তা পড়ার সময় ভ্রূক্ষেপ অবধি করে না, কারণ, তার হিন্দির জ্ঞান সীমিত। তাছাড়া, মানপত্রটিও তার লেখা নয়। অন্যের ভাবনা ও শ্রম চুরি করে সাইলেন্সার যে-ফঁাকিবাজি করছিল, তা লোকসমক্ষে ফঁাস করে দিতেই র্যাঞ্চো এমন পরিকল্পনা করেছিল!
‘ঘোস্ট রাইটার’ শব্দটির অর্থ: যে-ব্যক্তি অর্থের বিনিময়ে অন্যের জন্য লিখে দেয়। সেই লেখায় ঘোস্ট রাইটারের নাম যাবে না, এটিই এ-কাজের প্রধান শর্ত। নিজের আত্মপরিচয়ের ঊর্ধ্বে অন্যের নাম-স্বীকৃতিকে স্থান দেওয়া সহজ কথা নয়, তবে এজন্যই ‘ঘোস্ট রাইটিং’ কাজটি এত জটিল। নন-ফিকশনের জগতে ‘ঘোস্ট রাইটার’-এর উপস্থিতি আকছার চোখে পড়ে। সাংবাদিকতার পেশাতেও ঘোস্ট রাইটিং আবশ্যিক, পেশার স্বার্থে। বিশেষত, যারা ডেস্কে কাজ করেন, সেসব সাংবাদিককে কম-বেশি অন্যের নামে কপি এডিট করতেই হয়, এটিও এ-পেশার ধর্ম। বিখ্যাত ব্যক্তিদের জীবনী লেখা হয় ‘ঘোস্ট রাইটিং’ করে। সিনেমার স্ক্রিপ্টে সহায়তা করা বা রাজনৈতিক নেতানেত্রীদের বক্তৃতার বয়ান লিখে দেওয়া, নানা সময় ‘ঘোস্ট রাইটার’ আবির্ভূত হয়।
এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী যখন মঞ্চে বক্তব্য রাখেন, তিনি তখন শরীরী ভাষার সাহায্যে পুরো মঞ্চের দখল নিয়ে নেন। কণ্ঠস্বরে তারতম্য এনে, টানা সমার্থক শব্দ ব্যবহার করে, যুক্তি ও আবেগের মিশেলে তিনি যে-অভিভাষণ রাখেন, তা সব ধরনের মানুষকে স্পর্শ করতে পারে, প্রশংসা ও সমালোচনার বৃহত্তর পরিসর তৈরি হয়। তঁার বক্তব্য প্রদানের ঢং দেখলেই বোঝা যায়, তিনি যা বলছেন মন থেকে বলছেন, স্মৃতির সহায়তায় বলছেন, অভিজ্ঞতার সঙ্গে ঔচিত্য মিশিয়ে বলছেন। লিখিত বয়ান পড়ছেন না। আবার, কোনও-কোনও রাজনেতা ‘লিখিত’ বক্তব্য পাঠ করতে বা পূর্বপ্রস্তুতি-সহ ভাষণ দিতে পছন্দ করেন। যঁারা মেঘের আড়ালে থেকে, রাজনেতা-নেত্রীদের সহায়তা করেন, তঁারা কি নেহাতই ‘ভাড়াটে লেখক’?
সম্প্রতি ‘অপারেশন সিঁদুর’ নিয়ে সংসদে বক্তব্য রাখার সময় সপা-র সাংসদ জয়া বচ্চন প্রধানমন্ত্রীকে লক্ষ্য করে বলেন, এমন অসাধারণ নাম দেওয়ার জন্য ভাড়াটে লেখকদের ধন্যবাদ। বলা বাহুল্য, এটি প্রশংসার ছলে আদতে নিন্দেবাক্য। বহুত্ববাদী দেশে ‘সিঁদুর’-এর তাৎপর্যের সঙ্গে সব ধর্মের মানুষ একাত্ম নাও বোধ করতে পারে, কিন্তু প্রধানমন্ত্রী ধরেই নিয়েছেন, সিঁদুরখেলার গর্বে প্রত্যেক ভারতীবাসী গর্বিত হবে, প্রতীক অর্থের গভীরতা বুঝতে পারবে। তা কি বাস্তবে সম্ভব?
