তিনি এদেশে স্বাধীনোত্তর আদিবাসী আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ, বিরসা মুন্ডার উত্তরসূরি, সেই তিনিই চিরুডিহতে 'দিকু' (বহিরাগত) তথা 'অ-উপজাতীয়' হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্ত, ঝাড়খণ্ডিদের অধিকার রক্ষায় পৃথক রাজ্য গঠনে শিবুর ভূমিকা যেমন ভোলার নয়, সেই মানুষটাই আবার কেন্দ্রীয় মন্ত্রী থাকাকালীন কয়লা কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত। আসলে ভালোমন্দের 'দ্বিধা থরথর চূড়ে' গুলিয়ে যায় শিবু সোরেনের 'হিরো' কিংবা 'ভিলেন' চরিত্র। লিখছেন কিশোর ঘোষ।
"কে জানে গরল কিনা প্রকৃত পানীয়/ অমৃতই বিষ!" মেধাবী বাঙালি কবির মিথ হয়ে ওঠা এই পংক্তির সঙ্গে সদ্য প্রয়াত শিবু সোরেনের আশ্চর্য মিল! ঝাড়খণ্ডের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ও ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা প্রধানের জীবনের গতিজাড্য প্রথম থেকেই 'ফুল আউর কাঁটে' দর্শনে চলেছে। একদিকে তিনি এদেশে স্বাধীনোত্তর আদিবাসী আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ, বিরসা মুন্ডার উত্তরসূরি, সেই তিনিই চিরুডিহতে 'বহিরাগত' তথা 'অ-উপজাতীয়' হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্ত, ঝাড়খণ্ডিদের অধিকার রক্ষায় পৃথক ঝাড়খণ্ড রাজ্য গঠনে শিবুর ভূমিকা যেমন ভোলার নয়, সেই মানুষটাই আবার কেন্দ্রীয় মন্ত্রী থাকাকালীন কয়লা কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত। আসলে ভালোমন্দের 'দ্বিধা থরথর চূড়ে' শিবু সোরেন 'হিরো' ও 'ভিলেন'-এ গুলিয়ে যাওয়া চরিত্র। বঞ্চনার পৃথিবীতে জন্মেও অধিকার বুঝে নেওয়া প্রখর দাবির জীবন ঠিক কেমন ছিল?
স্বাধীন ভারতের প্রায় সমবয়সি শিবু। ১৯৪৪ সালের ১১ জানুয়ারি জন্ম, অখণ্ড বিহারের রামগড় জেলার নেমরা গ্রামে। তিনি যেন গত শতাব্দীর সাত ও আটের দশকে একাধিক হিন্দি ছবিতে অমিতাভ বচ্চন অভিনীত 'বিজয়' চরিত্র। পিছিয়ে পড়া সাঁওতাল উপজাতির সন্তান। স্কুলজীবন শেষ হতে না হতেই মহাজনদের গুন্ডারা শিবুর বাবাকে খুন করে। এরপর থেকেই অদৃশ্য ধনুকের ছিলায় বিষ মাখানো বদলার তীর! ১৮ বছর বয়সেই সাঁওতাল নবযুবক সঙ্ঘ গঠন করেন তিনি। পরে যা ঝাড়খণ্ড মুক্তির মোর্চার রূপ নেয়। আদিবাসীদের অধিকারের লড়াই ও পৃথক রাজ্যের দাবিতে তির-ধনুক হাতে নেমে পড়েন খনিজ সম্পদে ভরপুর ঝাড়খণ্ডে। সাঁওতাল, কুর্মি-মাহাতদের জমি পুনরুদ্ধারের জন্য আন্দোলন সংগঠিত করেন। সাঁওতালি ভাষায় স্লোগান ওঠে 'লাঙল যার, ফসল তার'।
সংঘর্ষের এই পথেই ঝাড়খণ্ডের পিছিয়ে পড়া মানুষের ভালোবাসার 'গুরুজি' বা 'দিশম গুরু' হয়ে ওঠেন শিবু সোরেন। কিন্তু তিনি তো রবিনহুড চরিত্র। ফলে এসে পড়ে ১৯৭৫ সালের ২৩ জানুয়ারি। তৎকালীন বিহারের জামাতারা জেলার চিরুডিহতে 'দিকু' (বহিরাগত) এবং 'অ-উপজাতীয়'দের উপর ভয়ংকর হামলা হয়। মৃত্যু হয় ১১ জনের। এদের মধ্যে ৯ জন মুসলিম। চিরুডিহ হত্যাকাণ্ডে উসকানি দেওয়ার অভিযোগ ওঠে শিবুর বিরুদ্ধে। গ্রেপ্তারি, মামলা, দীর্ঘ আইনি প্রক্রিয়ার পর ৬ মার্চ ২০০৮ তারিখে খালাস পান 'গুরুজি'। যদিও ইতিহাসের শরীরে প্রশ্নচিহ্নের কালশিটে কিন্তু থেকে যায়। অন্যদিকে রাজনৈতিক শক্তি বাড়ে শিবুর। ১৯৭৭-এ ভোটে দাঁড়িয়ে হারলেও ১৯৮০ সালে প্রথমবার দুমকা থেকে লোকসভায় নির্বাচিত হন।
পরবর্তী সময়েও ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা এবং শিবু সোরেনের জয়যাত্রা অব্যাহত থাকে। ১৯৮৯, ১৯৯১ এবং ১৯৯৬ সালেও লোকসভায় নির্বাচিত হন জেএমএম প্রধান। ২০০২ সালে রাজ্যসভায় নির্বাচিত হন তিনি। একই বছরে উপনির্বাচনে দুমকা লোকসভা আসনে জয়লাভ করে রাজ্যসভার আসন ছেড়ে দেন শিবু। ২০০৪ সালে তিনি পুনরায় নির্বাচিত হন। মূলত শিবুর আন্দোলনের জেরেই ২০০০ সালের ১৫ নভেম্বর ২৮তম রাজ্য হিসাবে পৃথক ঝাড়খণ্ড প্রতিষ্ঠিত হয়। ২০০৫ সালে প্রথমবার ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী হন তিনি। যদিও ১০ দিনের জন্য। পরে ২০০৮ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন শিবু সোরেন। এর আগেই কেন্দ্রে মনমোহন সিং সরকারের কয়লামন্ত্রী হন তিনি। ২০০৪ থেকে ২০০৬ সালের মধ্যে তিন দফায় কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হন। এবং কয়লা কেলেঙ্কারিতে নাম জড়ায় তাঁর।
ঝাড়খণ্ডের 'গুরুজি'র নাম কেবল চিরুডিহ হত্যাকাণ্ড আর কয়লা কেলেঙ্কারির সঙ্গেই জড়ায়নি, ২০০৬ সালের ২৮ নভেম্বর শিবুকে তাঁর প্রাক্তন ব্যক্তিগত সচিব শশীনাথ ঝাকে অপহরণ ও খুনের মামলায় দোষী সাব্যস্ত করা হয়। সিবিআই চার্জশিটে উল্লেখ করা হয়, ১৯৯৩ সালের জুলাই মাসে অনাস্থা প্রস্তাবের সময় পিভি নরসিমা রাও সরকারকে বাঁচাতে কংগ্রেস এবং জেএমএমের মধ্যে কথিত চুক্তি সম্পর্কে অনেক কিছু জানতেন ঝা। চার্জশিটে জোর দিয়ে বলা হয়, "ঝা অবৈধ লেনদেন সম্পর্কে জানতেন এবং শিবুর কাছে ওই অর্থের একটি অংশ দাবি করেন।" সেই কারণেই পথের কাঁটা সরানো হয়! ভারত সরকারের কোনও কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর খুনের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার এটিই প্রথম ঘটনা। যদিও শেষ পর্যন্ত ২০০৭ সালে দিল্লি হাই কোর্টের রায়ে খালাস পান শিবু।
অতএব, দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে শিবু সোরেন 'দস্যু রত্নাকর' না 'স্রষ্টা বাল্মিকী' তা গুলিয়ে যায়। বাঙালি কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের অমৃত ও বিষের বিভ্রান্তিই যেন ৮১ বছরের জীবন দিয়ে প্রমাণ করে গেলেন তিনি।
