ভারতে এবারের মাতৃদিবস উৎসর্গীকৃত হওয়া উচিত সেই মায়েদের প্রতি যাঁদের সন্তানরা এখন রণক্ষেত্রে। সন্তানের চিন্তায় তাঁরাও তো মনে মনে রণক্ষেত্রেই। যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে থাকা এই মায়ের গায়ে সেনার পোশাক নেই, অস্ত্রের ঝনঝনানি নেই, কিন্তু হৃদয়ে প্রতিটি মুহূর্তে রক্তক্ষরণ রয়েছে। লিখছেন সুতীর্থ চক্রবর্তী।
নতুন শতকে পা দেওয়ার পর যুদ্ধ ব্যাপারটা আমাদের মন থেকে অনেকটাই মুছে গিয়েছিল। অর্থনীতিকে বৃদ্ধির পথে নিয়ে যাওয়া, দারিদ্রর বিরুদ্ধে লড়াই করা, ইত্যাদি নতুন যুদ্ধ হিসেবে আমাদের সামনে হাজির হয়েছিল। আবার হঠাৎ করেই গোটা বিশ্বে সেই চিরাচরিত যুদ্ধের পরিবেশ ফিরে এসেছে। নানা প্রান্তে এখন যুদ্ধ চলছে। আমরা ভারতবাসীও বহুদিন পর একটা যুদ্ধের আবহে। ব্ল্যাকআউট, সাইরেন, বাঙ্কারে আশ্রয় নেওয়া ইত্যাদি উত্তর ও পশ্চিম ভারতের দৈনন্দিন জীবনে কয়েকদিন হল ফিরে এসেছে। কিন্তু দেশে যুদ্ধর পরিস্থিতি তৈরি হওয়া মানে তো শুধু তা এক প্রান্তেই সীমাবদ্ধ থাকা নয়। আমাদের সেনাবাহিনী ও আধা সামরিক বাহিনীগুলিতে তো দেশের সব এলাকার মানুষ রয়েছেন। তাঁদের সবার ছুটি বাতিল হয়েছে। অনেকেই ডিউটিতে চলেছেন জম্মু ও কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণ রেখা বা পাঞ্জাব, রাজস্থান ও গুজরাতের সীমান্তে। এইসব এলাকায় এখন যুদ্ধের আঁচ। যে মায়ের সন্তান এখন এইসব জায়গায় দেশের জন্য লড়াইয়ে ব্যস্ত সেই মায়ের প্রতিটি রাত কাটছে বিনিদ্র অবস্থায়। এ তো কথাতেই বলে, সন্তানের সঙ্গে যুদ্ধক্ষেত্রে হাজির থাকেন মায়েরাও। তাঁরা থাকেন যুদ্ধরত সন্তানের হৃদয়ের অন্তরে ভালোবাসার স্পর্শ হয়ে।
অপারেশন সিঁদুরে নারীশক্তিকে মুখ করা হয়েছে। অভিযানের বর্ণনা দিতে রোজ সামনে আসছেন সেনা বাহিনীর কর্নেল সোফিয়া কুরেশি। সংবাদ মাধ্যমের সামনে এসেছেন সোফিয়ার মাও। মেয়ে যখন যুদ্ধক্ষেত্রে যায় তখন মা হিসেবে তিনি তাঁর উদ্বেগ কীভাবে চেপে রাখেন সে কথা জানাচ্ছেন। সন্তানের সঙ্গে তিনিও কীভাবে মনে মনে রণভূমিতে বিচরণ করেন সেই অনুভূতি ব্যক্ত করছেন। ভারতে এবারের মাতৃদিবস উৎসর্গীকৃত হওয়া উচিত এই মায়েদের প্রতিই যাঁদের সন্তানরা এখন রণক্ষেত্রে। সন্তানের চিন্তায় চিন্তায় তাঁরাও তো মনে মনে রণক্ষেত্রেই।
রণক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে থাকা এই মায়ের গায়ে সেনার পোশাক নেই, অস্ত্রের ঝনঝনানি নেই কিন্তু হৃদয়ে প্রতিটি মুহূর্তে রক্তক্ষরণ রয়েছে। তাঁর হৃদয়ও যুদ্ধক্ষেত্রের মতো চঞ্চল। সারাদিন টানাপোড়েনে জর্জরিত। শত্রুপক্ষের অবিরত গোলায় কখনও তা কালো মেঘে ছেয়ে যাচ্ছে আবার কখনও শত্রুকে পরাস্ত করার আনন্দে আলোকোজ্জ্বল হয়ে উঠছে। মায়ের মন প্রতি মুহূর্তে ধাবিত হচ্ছে যুদ্ধক্ষেত্রের খবরের দিকে। এই কিছুদিন আগেও কার্গিল যুদ্ধের সময়ও পাহাড়ের যুদ্ধক্ষেত্র থেকে রোজকার খবর পাওয়ার ভরসা ছিল একমাত্র সংবাদপত্র। সেনাদের বাড়িতে পোস্টম্যানের ভূমিকায় থাকতেন যুদ্ধের খবর করতে যাওয়া সাংবাদিকরা। এখন মোবাইল ফোনের যুগে মায়ের মন ২৪ ঘণ্টা অপেক্ষায় থাকে সন্তানের কণ্ঠস্বরের জন্য। প্রযুক্তি যুদ্ধক্ষেত্রকে যত নিকট করেছে তত মায়েদের রক্তচাপ বেড়েছে।
শ্রীনগরে একসময় দেখেছিলাম রোজ সকালে সেনা বা আধা সামরিক বাহিনীর দপ্তরে রিদ লেইং সেরিমনি। এ যেন এক রুটিন ঘটনা। কিছু কফিন রোজই দেশের বিভিন্ন প্রান্তে চলে যেত। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে যে মায়ের সন্তান এইভাবে কফিন হয়ে ফেরে তাঁর যুদ্ধ কোনওদিনই শেষ হয় না। সন্তানের স্মৃতি বুকে বেঁচে থাকা তো এক অনন্ত যুদ্ধ। সব যুদ্ধ শেষ হলেও সেই যুদ্ধ চিরকালীন। সেই যুদ্ধের সেনানী তো একমাত্র মায়েরাই (Mothers of India)।
