ধনী এক শতাংশের দখলে যখন দেশের ৪০ শতাংশ সম্পদ, তখন বিশ্বের দ্রুততম অার্থিক বৃদ্ধির হার নিয়ে এত বড়াই করার অর্থ কী? দেশে বেকারত্বের হারও চরম জায়গায়। এআইয়ের যুগে কর্মসংস্থান কতখানি বৃদ্ধি করা সম্ভব? পণ্যের চাহিদা বাড়িয়েই কি বৈষম্য ও বেকারত্বের সুরাহা হবে? লিখলেন সুতীর্থ চক্রবর্তী।
আর্থিক বৃদ্ধির হার নিয়ে যখন হইচই চলছে, তখন সামনে চলে এল ২০২৬-এর বিশ্ব বৈষম্য রিপোর্ট। এতে ভারতের বিশেষ অগ্রগতি লক্ষ করা যাচ্ছে না। আর্থিক বৈষম্য নিয়ে গবেষণা করেন এমন অর্থনীতিবিদদের ২০০টি গবেষণাপত্রের ভিত্তিতে তৈরি হয়েছে এই রিপোর্ট। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ টমাস পিকেটি কয়েক বছর আগে আর্থিক বৈষম্য নিয়ে তঁার গবেষণায় দেখিয়েছিলেন, ভারতে আর্থিক বৈষম্যের চিত্র ব্রিটিশ আমলের চেয়েও খারাপ। সেই ছবি যে বিশেষ বদলায়নি, তা ২০২৬-এর রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে!
রিপোর্ট বলছে ভারতের জাতীয় আয়ের ৫৮ শতাংশ কুক্ষিগত করে রেখেছে অপেক্ষাকৃত ধনী ১০ শতাংশ। আয়ের সারণিতে নিচের ৫০ শতাংশে থাকা মানুষের ভাগে জাতীয় আয়ের মাত্র ১৫ শতাংশ পৌঁছয়। এটা কোনও অভিনব তথ্য নয়, দেশের দিকে তাকালে একটি শিশুও এই বৈষম্য বুঝতে পারে। সম্পদ বণ্টনের নিরিখে এই ছবি আরও ভয়াবহ। ধনী এক শতাংশের দখলে রয়েছে দেশের ৪০ শতাংশ সম্পদ। আয় সারণির উপরের ১০ শতাংশের হাতে রয়েছে দেশের ৬৫ শতাংশ সম্পদ। মধ্যবর্তী ৪০ শতাংশের হাতে রয়েছে দেশের ২৮.৬ শতাংশ সম্পদ। দেশের বাকি অর্ধেক মানুষের হাতে দেশের মোট সম্পদের মাত্র ৬.৪ শতাংশ রয়েছে। বলা বাহুল্য যে ব্রিটিশ আমলেও এই পরিমাণ বৈষম্য ছিল না। কয়েক বছর আগে ভারতের এই ‘সত্যি’ বিশ্বের সামনে তুলে ধরে শোরগোল ফেলেছিলেন পিকেটি।
এবারের বিশ্ব বৈষম্য রিপোর্ট অনুযায়ী, বার্ষিক মাথাপিছু আয়ের নিরিখে ভারতের বৈষম্যের ছবিটি কী, সেটাও দেখে নেওয়া যেতে পারে। রিপোর্টে বলা হচ্ছে, আয়ের সারণিতে নিচের দিকে থাকা দেশের ৫০ শতাংশ মানুষের বার্ষিক মাথাপিছু গড় আয় ৯৪০ ইউরো। মধ্যবর্তী ৪০ শতাংশের গড় বার্ষিক মাথাপিছু আয় চার হাজার ২৪৭ ইউরো। আয়ের সারণিতে শীর্ষে থাকা ১০ শতাংশ মানুষের গড় বার্ষিক মাথাপিছু আয়ের পরিমাণ ৩৫ হাজার ৯০১ ইউরো। দেশের সবচেয়ে ধনী এক শতাংশের গড় বার্ষিক মাথাপিছু আয় এক লক্ষ ৪০ হাজার ৬৪৯ ইউরো। ভারত প্রায় দেড়শো কোটি মানুষের দেশ। তার মানে দেশের প্রায় দেড় কোটি মানুষের গড় বার্ষিক মাথাপিছু আয় প্রায় দেড় কোটি টাকা। অন্যদিকে, দেশের অর্ধেক জনসংখ্যা, ৭৫ কোটির গড় বার্ষিক মাথাপিছু আয়ের পরিমাণ এক লক্ষ টাকার কম। এই পরিসংখ্যানে আবারও স্পষ্ট দেশের এক শতাংশ বড়লোক এখন কতটা ধনী। মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের মাথাপিছু আয়ের সঙ্গে ধনী মানুষদের আয়ের ব্যবধানটা ইদানীং চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে। একজন নিম্ন মধ্যবিত্ত মাসে ৮ হাজার টাকা রোজগার করলে একজন ধনীর মাসিক আয় ১২-১৩ লক্ষ টাকা।
বৈষম্যের এই ছবিটা স্বাধীনতার সময় তো ছিল না, এমনকী গত শতকের শেষের দিকেও ছিল না। দেশ গত শতকের নয়ের দশকের গোড়ার দিকে বিশ্বায়নের নীতি গ্রহণের সময়েই জানা ছিল যে, এই বিশ্বায়নের দু’টি বৈশিষ্ট্য। একদিকে এটি আর্থিক বৈষম্য তীব্র করবে, অন্যদিকে এটি কর্মসংস্থানহীন আর্থিক বৃদ্ধির পরিস্থিতি তৈরি করবে। গত সাড়ে তিন দশকে সেটাই ঘটে চলেছে। অর্থনীতিবিদদের গবেষণায় বারবার সেই ছবিটাই উঠে আসছে। যখনই সেইসব রিপোর্ট সামনে আসছে, তখনই তা সংবাদমাধ্যম তুলে ধরছে। বস্তুত সংবাদমাধ্যমের সেটাই কাজ। এর বিপ্রতীপে দেশের সরকার আর্থিক বৃদ্ধির হার ও জাতীয় আয়ের পরিমাণ নিয়ে ঢাক বাজিয়ে চলছে।
সম্প্রতি, একটি সর্বভারতীয় পাক্ষিকে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর সঞ্জয় মালহোত্রা জানিয়েছেন, ভারত এখন বিশ্বের দ্রুততম অার্থিক বৃদ্ধির দেশ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতি। তাদের বৃদ্ধির হার মাত্র ২ শতাংশ। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি চিন। তাদের বৃদ্ধির হার ৫ শতাংশ। জাপান ও ইউরোপীয় দেশগুলির বৃদ্ধির হার এক শতাংশের অাশপাশে। সেখানে ভারতের অার্থিক বৃদ্ধি গড়ে অাট শতাংশ। ভারতের ধারেকাছে একমাত্র রয়েছে ইন্দোনেশিয়া। যাদের অার্থিক বৃদ্ধির হার ৫ থেকে সাড়ে ৫ শতাংশ।
সরকারি কর্তাদের এই দাবির সঙ্গে কি কোনওভাবে ‘ওয়ার্ল্ড ইনইকুয়ালিটি ল্যাব’-এর সঙ্গে যুক্ত অর্থনীতিবিদদের বৈষমে্যর রিপোর্টের সংগতি পাওয়া যায়? একদিকে যখন বলা হচ্ছে জাতীয় সম্পদের ৪০ শতাংশ ধনী এক শতাংশের কুক্ষিগত, তখন বিশ্বের দ্রুততম অার্থিক বৃদ্ধির হার নিয়ে বড়াই করার অর্থ কী? শুধু অার্থিক বৈষম্যই নয়, দেশে বেকারত্বের হারও এক চরম জায়গায় পৌঁছেছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির অামলে দেশে বেকারত্বের হার ৪৫ বছরের মধে্য সর্বোচ্চ। অর্থাৎ, এই অার্থিক বৃদ্ধি কর্মসংস্থানহীন। ১৯৯১ সালে অার্থিক সংস্কার প্রক্রিয়া শুরুর সময়ই অর্থনীতিবিদদের ভবিষ্যদ্বাণী ছিল যে, এই সংস্কার তীব্র অার্থিক বৈষমে্যর সঙ্গে সঙ্গে এক কর্মসংস্থানহীন অার্থিক বৃদ্ধির পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে। গত সাড়ে তিন দশকে দেশের সংগঠিত ক্ষেত্র কার্যত বিলুপ্ত।
৯০ শতাংশের উপর মানুষ অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করে কোনওক্রমে গ্রাসাচ্ছাদন করে। সংগঠিত ক্ষেত্র কার্যত বিলোপের পথে যাওয়াতেই যে অার্থিক বৈষম্য অারও তীব্র হচ্ছে তা নিয়ে কোনও সংশয় নেই। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগে কর্মসংস্থান কতখানি বৃদ্ধি করা সম্ভব, সেই প্রশ্ন উঠবে। সরকারি স্তরে শুধু চাহিদা বৃদ্ধির কথা বলা হচ্ছে। পণে্যর চাহিদা বাড়িয়েই কি বৈষম্য ও বেকারত্বের সুরাহা সম্ভব? গত তিন দশক ধরে এর সদুত্তর মিলছে না। জিএসটি, নতুন শ্রম বিধি, শিল্পকে নানারকম উৎসাহ প্রদান, কর্পোরেট করের হার কমানো ইত্যাদি কোনও অার্থিক সংস্কারই কর্মসংস্থান বাড়াতে পারেনি।
বৈষমে্যর হার কমানোর জন্য সম্পদ কর বসানো, উচ্চ অায়ের উপর কর বৃদ্ধি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পুষ্টি ও অন্যান্য পরিকাঠামোয় বিপুল সরকারি ব্যয় ইত্যাদি পদক্ষেপগুলি জরুরি। এগুলি করলে বৈষম্য কমতে পারে ও সাধারণ মানুষের সমস্যার কিছুটা সুরাহা ঘটতে পারে। কিন্তু তাতে সরকারের বিশেষ উৎসাহ অাছে বলে মনে হয় না। সরকার তো বর্তমান সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পগুলিরই গুরুত্ব ক্রমাগত কমিয়ে চলেছে। এর সর্বশেষ উদাহরণ, ১০০ দিনের কাজের প্রকল্প নিয়ে সংসদে সরকারের অবস্থান। সংশোধিত অাইনে বলা হচ্ছে, ১০০ দিনের কাজ অার অধিকার বলে বিবেচিত হবে না। বিশ্ব বৈষম্য রিপোর্টকে ফের বাজে কাগজের ঝুড়িতে হয়তো মোদি সরকার নিক্ষেপ করবে। সেটা না-করে যদি সরকার একে তাদের নীতিনির্ধারণে কিছুটা ব্যবহার করে, তাহলে দেশের উপকার হয়।
