‘শান্তি’ আইন ভারতের পারমাণবিক শক্তি ক্ষেত্রে ঠিক কতটা লাভজনক? দায়বদ্ধতা, ক্ষতিপূরণ এবং নিয়ন্ত্রক-স্বাধীনতার প্রশ্নে স্পষ্ট এবং নমনীয় তো?
ভারতের পারমাণবিক শক্তি ক্ষেত্রে বেসরকারি অংশগ্রহণের পথ প্রশস্ত করতে ‘সাসটেইনেব্ল হার্নেসিং অ্যান্ড অ্যাডভান্সমেন্ট অফ নিউক্লিয়ার এনার্জি ফর ট্রান্সফর্মিং ইন্ডিয়া’ (শান্তি) আইন একদিকে যেমন কাঠামোগত সংস্কারের ইঙ্গিত, তেমনই কিছু গুরুতর প্রশ্ন উত্থাপন করে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতা বাড়াতে প্ল্যান্ট ডেলিভারি ও সরবরাহ শৃঙ্খলের নির্দিষ্ট অংশে বেসরকারি অংশগ্রহণের সুযোগ রেখে, পারমাণবিক বিস্তার বা সংবেদনশীল কার্যকলাপ রাষ্ট্রের হাতেই রাখার যে-নকশা এই বিলে প্রস্তাবিত, তা নীতিগতভাবে যুক্তিসংগত। একই আইনের আওতায় নিরাপত্তা, প্রয়োগব্যবস্থা, বিরোধ নিষ্পত্তি ও অংশগ্রহণের শর্ত নির্ধারণের ফলে নতুন বিনিয়োগকারীদের জন্য থাকা আইনি অনিশ্চয়তা কমতে পারে।
এর ফলে লেনদেন খরচ হ্রাস, সাইট অনুমোদন ও কমিশনিং প্রক্রিয়ার সময়সীমা সংক্ষিপ্ত হওয়ার সম্ভাবনাও তৈরি হবে, যা দীর্ঘ দিন ধরেই ভারতের পারমাণবিক প্রকল্পগুলির বড় বাধা। তবে এই ইতিবাচক দিকগুলির পাশাপাশি বিলের দায়বদ্ধতা ও প্রশাসন কাঠামো নিয়ে সতর্ক থাকা জরুরি। একটি পারমাণবিক দুর্ঘটনায় সংস্থাগুলির সর্বোচ্চ দায় নির্ধারণ করা হয়েছে ৩ হাজার কোটি টাকা। এই সীমার বাইরে ক্ষতির দায় কেন্দ্রীয় সরকারের উপর বর্তাবে এবং জনস্বার্থে প্রয়োজন হলে অ-সরকারি স্থাপনাতেও কেন্দ্র সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিতে পারবে। বিনিয়োগকারীদের দৃষ্টিতে এটি ঝুঁকি নির্ধারণ সহজ করলেও প্রশ্ন থেকে যায় যে, এই সীমিত দায় কি ভুক্তভোগীদের ন্যায্য ক্ষতিপূরণ এবং পরিবেশগত পুনরুদ্ধারের জন্য যথেষ্ট? পারমাণবিক দুর্ঘটনার পরিণতি যে দীর্ঘস্থায়ী ও বহুমাত্রিক, তা আমাদের অভিজ্ঞতা থেকেই জানা।
শান্তি আইনে সংস্থাগুলির জন্য বিমা বা অন্য আর্থিক সুরক্ষার বাধ্যবাধকতা রাখা হয়েছে। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারের পারমাণবিক স্থাপনাগুলিকে এই বাধ্যবাধকতা থেকে ছাড় দেওয়া হয়েছে। ফলে সরকারি ক্ষেত্রে স্বচ্ছ আর্থিক হিসাব ও জনসমক্ষে দায়বদ্ধতা আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। একই সঙ্গে, বেসরকারি সংস্থাগুলি রাষ্ট্র কেবলমাত্র তখনই ফিরিয়ে নিয়ে পারবে, যখন তা লিখিত চুক্তিতে স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকবে বা ইচ্ছাকৃতভাবে পারমাণবিক ক্ষতি ঘটানো হয়েছে এমন ক্ষেত্রে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি হল, পারমাণবিক নিয়ন্ত্রকের স্বাধীনতা নিয়ে। শান্তি একটি আইনি কাঠামো তৈরি করলেও নিয়োগ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে কেন্দ্র ও পরমাণু শক্তি কমিশনের প্রভাব বজায় রাখছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থার প্রকৃত স্বাধীনতা ছাড়া জনআস্থা তৈরি করা কঠিন, এবং একই সঙ্গে বিদেশি ও দেশীয় বিনিয়োগকারীদের আস্থাও নড়বড়ে হয়ে পড়তে পারে।
অতএব, শান্তি আইন ভারতের পারমাণবিক শক্তি ক্ষেত্রে বেসরকারি বিনিয়োগ ও কাঠামোগত সংস্কারের একটি গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ এনে দিলেও দায়বদ্ধতা, ক্ষতিপূরণ এবং নিয়ন্ত্রক স্বাধীনতার প্রশ্নে যদি এই অস্পষ্ট ও সীমাবদ্ধ বিধি সংশোধন না-করা হয়, তবে এই সংস্কার ভবিষ্যতে আস্থা সংকট ও সামাজিক বিরোধের জন্ম দিতে পারে।
