বাংলাদেশের মাত্রাহীন বর্বরতার লক্ষ্য ঠিক কী? কেন ঘটল সাংস্কৃতিক সংস্থা-নিধনের বাধাহীন তাণ্ডব? কী জবাব দেবেন মহম্মদ ইউনুস?
বাংলাদেশের এক সম্পূর্ণ মগজধৌত তরুণ সন্ত্রাসবাদী গভীর রাত্রে একটি হারমোনিয়াম আছাড় মেরে ভাঙছে, সংবাদপত্রে প্রকাশিত এই ছবির অশনিসংকেত যত দূর ত্রাসের, ততটাই বেদনার। এই হারমোনিয়াম ঢাকার সাংস্কৃতিক সংস্থা ‘ছায়ানট’-এর সম্পত্তি। এই হারমোনিয়ামের সুর সারা বিশ্বের। তাহলে এই সুরযন্ত্রের প্রতি কেন এত বিদ্বেষ? কারণ, এই যন্ত্রটি ‘ছায়ানট’ সাংস্কৃতিক সংস্থার, যে-সংস্থা বাংলাদেশে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল-চর্চার-বিরোধী পাকিস্তানি পরোয়ানা সত্ত্বেও বজায় রেখেছিল তার বুকে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের সুর। ধরে রেখেছিল বাংলা গানের সুর ও সাধনা।
এই অপরাধে ‘ছায়ানট’ ১৮ ডিসেম্বর রাত ১ টায় হামলাকারীদের তাণ্ডবে তছনছ। ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান হাদির হত্যা-সংবাদ পাওয়া মাত্র শুরু হয় বাংলাদেশ জুড়ে সন্ত্রাসের দিশাহীন তোলপাড়। এবং মাত্রাহীন বর্বরতা। ঘটনাক্রম এইরকম: এক, ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনের দফতরে হামলা। দুই, ‘প্রথম আলো’ সংবাদপত্রের দফতরে ভাঙচুর। তিন, ইংরেজি সংবাদপত্র ‘দ্য ডেলি স্টার’ সংবাদপত্রের দফতরে তোলপাড় ও অগ্নিসংযোগ। চার, চট্টগ্রামে ভারতীয় ডেপুটি হাইকমিশনের দফতরেও ব্যাপ্ত হামলা। পাঁচ, ধানমণ্ডি ৩২। এখানে বহুবার আক্রান্ত শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ির ধ্বংসস্তূপ। সেই ধ্বংসকে আরও একবার ধ্বংস করার পর সন্ত্রাসবাদীরা রাত ১টার পরে ঢুকে পড়ে ‘ছায়ানট’ ভবনে। এবং একই সঙ্গে ‘ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টার’-এ।
আধ ঘণ্টা ধরে সাংস্কৃতিক সংস্থা-নিধনের বাধাহীন তাণ্ডব! এই প্রসারিত এবং পরিব্যাপ্ত হননের লক্ষ্য কি কোনও ব্যক্তি? না, তার চেয়েও ভয়াবহ কিছু! এই হত্যার লক্ষ্য: বাংলা ভাষা, বাংলা গান, রবীন্দ্র-নজরুল-চর্চা, বাঙালির মুক্ত সংস্কৃতি! ঢাকার আরও এক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ‘উদীচী’, যার নামেই রাবীন্দ্রিক প্রতিধ্বনি, সেখানেও একই রাত্রে চলেছে লুট ও ধ্বংস। সবথেকে বেদনাদায়ক হল, সন্ত্রাসবাদীরা ‘ছায়ানট’-এর প্রতিষ্ঠাতা সনজীদা খাতুনের প্রতিকৃতিতেও
ছুরি বসিয়ে ফালা ফালা করে দেয়। কেননা তিনি রবীন্দ্র ও নজরুল-বিরোধী পাকিস্তানি শাসনের মধ্যে ‘ছায়ানট’-এ লুপ্ত হতে দেননি বাংলার এই দুই গায়ক-কবি, সুরসাধক এবং মুক্তি-ভাবনার ধারককে।
এমন প্রবল ও প্রসারিত ধ্বংসলীলার মধ্যে বাংলাদেশের অন্তবর্তীকালীন সরকার ও তার প্রধান মুহাম্মদ ইউনূসের আপাত নিষ্ক্রিয়তা কম বেদনা এবং হতাশা তৈরি করেনি। তিনি কিছু হিতবার্তা দিয়েছেন বটে। কিন্তু তা কি বলতে হয় বলেই বলা? কোথায় তঁার এই সন্ত্রাস ও ধ্বংসের প্রতি উৎক্ষেপিত বিপুল বিদ্বেষ, যার অতীব প্রয়োজন ছিল এই মুহূর্ত! তিনি যদি আরও দ্রুত প্রসারিত তাণ্ডব রুখতে তঁার বাহিনী পাঠাতেন, তাহলে এমন অপ্রতিহত গতিতে কি এগোতে পারত বিদ্বেষের এই অপরিণামদর্শী প্রকাশ?
ভারত এবং বাংলাদেশ– কোনও দেশেরই শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ চায় না এই পারস্পরিক ধর্মীয় বিদ্বেষ। মুক্তচিন্তার চর্চা হোক। প্রতিবেশী সুলভ মাঙ্গলিক ভাবনা বজায় থাকুক। খুব কি কঠিন কাজ?
