'হাই কমান্ড' হল ব্যক্তিত্বকেন্দ্রিক পদ যেখানে দলীয় সংস্কৃতি, অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র ও নিরঙ্কুশ ক্ষমতাকে সম্মান করে চলাই বিধান। একদা কংগ্রেসে 'হাই কমান্ড' সংস্কৃতির প্রচলন ছিল প্রবলভাবে। দীর্ঘ দিন কেন্দ্রীয় শাসনে না-থাকায় কংগ্রেসে 'হাই কমান্ড' এখন দুর্বল। বিপরীতে, বিজেপিতে দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে 'হাই কমান্ড' প্রথা। কারা বিজেপির 'হাই কমান্ড' এখন? লিখছেন রাজদীপ সরদেশাই
রাজনৈতিক অভিধানে ‘হাই কমান্ড’-এর মতো বহুল ব্যবহৃত (বা, বলা ভাল অপব্যবহৃত)
শব্দ খুঁজে পাওয়া ভার। ধারণাগতভাবে ‘হাই কমান্ড’-এর ধঁাচাটি সংসদীয় বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রতি ঘৃণা এবং ‘নির্বাচিত স্বৈরশাসক’-এর উত্থানকে প্রতিফলিত করে। ঐতিহ্যগতভাবে, শব্দবন্ধটি কংগ্রেস এবং নেহরু-গান্ধী পরিবারের সঙ্গে যুক্ত, যেখানে ইন্দিরা গান্ধীই ছিলেন দলের সর্বেসের্বা– ‘হাই কমান্ড’। কিন্তু গল্পের এক নতুন মোড়ে, সাম্প্রতিক হাই কমান্ড কংগ্রেস থেকে বিজেপিতে স্থানান্তরিত হয়েছে– ১০ জনপথ থেকে ৭ লোক কল্যাণ মার্গ এবং ৬এ কৃষ্ণ মেনন মার্গ এবং গুজরাতের বাসভবন এখন ভারতের পয়লা নম্বর রাজনৈতিক জুটি– প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর জিম্মায়।
ভেবে দেখুন– এই সপ্তাহেই, বিজেপি ৪৫ বছর বয়সি নীতীন নবীনের মতো একজনকে ‘জাতীয় কার্যনির্বাহী’ সভাপতি হিসাবে বেছে নিয়েছে। বিহারের বাইরে কেউই এই চারবারের বিধায়ক ও প্রতিমন্ত্রীর দিকে তেমন মনোযোগ দেয়নি, যঁাকে হালে বিজেপির ‘উদীয়মান তারকা’ হিসাবে বর্ণনা করা হচ্ছে। ‘কৌন বনেগা বিজেপি অধ্যক্ষ’ নিয়ে অবিরাম জল্পনা চলাকালীন কোনও রাজনৈতিক মন্তব্যে নবীনের নামও উল্লেখ করা হয়নি। হঠাৎ করেই নবীনের নাম ‘জাতীয় কার্যনির্বাহী’ সভাপতি রূপে ঘোষণা করা হল! বিশ্বস্ত বিজেপি কর্মকর্তা ও নেতারা নবীনকে স্বাগত জানাতে নয়া দিল্লিতে দলীয় সদর দপ্তরের বাইরে মালা পরানোর জন্য জড়ো হলেন, এবং কিছু কর্মী স্বীকার করেছেন যে, তঁাদের নবীনকে চিনে উঠতে খানিক বেগ পেতে হয়েছে! তা সত্ত্বেও নবীনের ‘নির্বাচন’ ঘিরে কেউ ভিন্নমত পোষণ করেননি। ‘আমরা একটি সুশৃঙ্খল দল’– দাবি করেছেন বিজেপির একজন দলীয় নেতা। সুশৃঙ্খল? হয়তো-বা। গণতান্ত্রিক? তেমন আদপেই নয়।
বলা বাহুল্য– বিজেপির ‘জাতীয় কার্যনির্বাহী’ সভাপতি হিসাবে নবীনের ‘নির্বাচন’ কোনও
কঠোর দলীয় অভ্যন্তরীণ পরামর্শের মাধ্যমে হয়নি, বরং তা প্রায় সম্পূর্ণত মোদি-শাহ জুটি, বিজেপির অপ্রতিদ্বন্দ্বী ‘হাই কমান্ড’ দ্বারা নির্ধারিত। পাশাপাশি,আরএসএস নেতৃত্বও এমন একজন গোঁড়া নেতার মনোনয়নে যারপরনাই আপ্লুত।
সিদ্দারামাইয়াই বেঙ্গালুরুর মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে বহাল থাকবেন, না কি ডি. কে. শিবকুমারকে তাঁর জায়গায় বসানো হবে, তা নিয়ে যখন কংগ্রেস নেতৃত্ব দ্বিধাগ্রস্ত ও নাজেহাল– তখন একবার বিজেপি হাই কমান্ডের প্রতাপ দেখুন– কেমন দৃঢ়, একরোখা তাদের মনোভাব। ২০২২ সালের কথা মনে করলে দেখবেন, কংগ্রেসের তথাকথিত ‘হাই কমান্ড’ অশোক গেহলটকে দলীয় সভাপতির পদ গ্রহণে রাজি করতে পারেনি। গেহলট রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী পদ থেকে ইস্তফা দিতে অস্বীকার করায়, দলীয় নেতৃত্বের পিছু হটা ছাড়া আর কোনও উপায়ও ছিল না। আবার হালে, যখন শশী থারুরের মতো একজন হাই-প্রোফাইল দলীয় সাংসদ বিবিধ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কংগ্রেসের প্রথম সারি থেকে ক্রমশ ফিকে হয়ে পড়ছেন, তখনও দলের ‘হাই কমান্ড’ প্রকাশ্য সংঘাত এড়িয়ে চলছে। এটাই কি তাহলে সুশৃঙ্খলার নমুনা? না। গণতন্ত্র? একরকম বটে। অবশ্য, হালে বিজেপির প্রতি অসন্তোষ প্রকাশের আগে কংগ্রেস ও গান্ধী পরিবারের প্রতি অসন্তোষ প্রকাশের জায়গাও ঢের বেশি।
কংগ্রেস রাতারাতি ‘গণতান্ত্রিক’ সংগঠনে রূপান্তরিত হয়েছে এমন নয়, অথবা বিজেপি অপ্রত্যাশিতভাবে পূর্ববর্তী যুগের কংগ্রেস-ধঁাচের সিদ্ধান্ত গ্রহণের কায়দা রপ্ত করেছে এমনও নয়। আদতে, ‘হাই কমান্ড’ হল ব্যক্তিত্বকেন্দ্রিক পদ যেখানে দলীয় সংস্কৃতি, অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র ও নিরঙ্কুশ ক্ষমতাকে সম্মান করে চলাই বিধান।
ভয় এবং চাটুকারিতার মিশেলে এই সামন্ততান্ত্রিক সংস্কৃতি চালিত হয় এমন এক রাজনৈতিক
নেতাকে কেন্দ্র করে– যিনি দলের ‘সুপ্রিমো’, এবং দলে যঁার কথাই শেষ কথা। এক দশকেরও বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় না-থাকা কংগ্রেসে ‘হাই কমান্ড’ এতটাই দুর্বল হয়ে পড়েছে যে, এখন আর দলের কোনও সদসে্যর মনে ভয়ের সঞ্চার করতে পারে না। বিপরীতে, বিজেপি এমন এক পরিবেশে দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে যেখানে তাদের পয়লা নম্বর জুটিকে ভয় ও প্রশংসা করা ছাড়া দলে কারও কোনও গতি নেই। যত দিন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নামে নির্বাচন জিতে অমিত শাহকে মিডিয়া-স্টাইলে চাণক্য হিসাবে দর্শানো হবে, তত দিন দলের ভিতরে আদতেই কোনও প্রকৃত অভ্যন্তরীণ সংলাপ আছে কি না, তা নিয়ে মাথা ঘামানোর লোক কোথায়? বিজেপি সংসদীয় বোর্ড– যা একসময় দলীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণের শীর্ষ সংস্থা হিসাবে বিবেচিত হত– শেষবার কবে, কোন জাতীয় ইস্যুতে, অর্থপূর্ণ আলোচনায় বসেছে মনে পড়ে? অথবা দলের জাতীয় কার্যনির্বাহী কমিটি কবে শেষ কোনও জোরালো বিতর্কের সম্মুখীন হয়েছে? মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচন থেকে শুরু করে দলীয় কৌশল প্রণয়ন– সমস্ত রাস্তা এখন পয়লা নম্বর জুটির করায়ত্তে।
এর একটি সর্বোত্তম উদাহরণ– ২০২৩ সালে রাজস্থানের দু’-বারের মুখ্যমন্ত্রী বসুন্ধরা রাজের বদলে ভজনলাল শর্মাকে মুখ্যমন্ত্রী করার সিদ্ধান্ত। বিধায়কদের মতামতের ভিত্তিতে যদি সুষ্ঠু ‘নির্বাচন’ হত, তাহলে বসুন্ধরার জয়লাভের সম্ভাবনা ছিল প্রবল। তবু পরিবর্তে, দিল্লির প্রথমবারের নির্বাচিত বিধায়ককেই মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে বেছে নেওয়া হল, এবং দলীয় আইনসভা দলকে কেবলমাত্র দায়সারা জানিয়ে দিল। এহেন ঘটনায় রাজে কেবল অবাক হয়েছিলেন এমন নয়– শর্মাও যারপরনাই বিস্মিত ছিলেন। এই প্রসঙ্গে আজগুবি মনে হলেও একটা গল্প না-বললে নয়: এই ভজনলাল শর্মা-ই জয়পুরে আইনসভা দলের বৈঠকের সময় খাবার এবং তঁাবু খাটানোর দায়িত্বে ছিলেন, সেই মিটিংয়েই আশ্চর্যজনকভাবে তঁার নাম শীর্ষপদের জন্য প্রস্তাবিত হয়। একইরকম চিত্র দেখা গিয়েছে গুজরাতেও। যখন প্রথমবারের জন্য নির্বাচিত
আর-একজন বিধায়ক ভূপেন্দ্র প্যাটেলকে আচমকা দলের পিছনের সারি থেকে তুলে সামনের সারিতে আনা হয়।
এক অর্থে, মোদি-শাহ ‘হাই কমান্ড’ ইন্দিরা গান্ধীর রাজনৈতিক খেলার বই থেকে কেবল একটি পাতা ছিঁড়ে এনেছেন। মনে রাখতে হবে, ইন্দিরাই দিল্লিতে মুখ্যমন্ত্রীদের অভিষেক করার ‘শিল্প’-কে নিখুঁত করে আশা রাখতেন তঁার কাজে আঞ্চলিক শাসকরা সঙ্গ দেবেন। ১৯৮২ সালে বাবাসাহেব ভোঁসলের মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার ঘটনা এখন রাজ্যের রাজনৈতিক লোককথার অংশ। ব্যারিস্টার ভোঁসলে ছিলেন এক সাধারণ ‘জুনিয়র’ মাপের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, যঁার না ছিল কোনও লোক টানার ক্ষমতা, না ছিল আকাশছোঁয়া উচ্চাকাঙ্ক্ষা। তবুও মুখ্যমন্ত্রীর পদে নির্বাচিত হন, যখন মহারাষ্ট্রের অনেক ‘সিনিয়র’ কংগ্রেস নেতা ইন্দিরা গান্ধীর দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হন। সে-সময় নবনির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রীর জন্য ৮০০ শব্দের একটি প্রোফাইল লেখাও হয়ে ওঠে দুরূহ। অভিজ্ঞ রাজনৈতিক সাংবাদিকরা তঁার সম্পর্কে পর্যাপ্ত তথ্য সংগ্রহ করতে হিমশিম খেয়ে যান।
তবুও, বিজেপি ও কংগ্রেসের ‘হাই কমান্ড’ মডেলে একটি পার্থক্য স্পষ্ট: বিজেপি মডেল
দয়া-মায়া-দাক্ষিণে্যর ধার ধারে না। এই কৌশলেই বিজেপির মধ্যে প্রজন্মগত পরিবর্তন আনতে সফল হয়েছেন দুই সুপ্রিমো। প্রায় সমস্ত বিজেপি মুখ্যমন্ত্রীর বয়স পঞ্চাশের কোঠায়, ফলে দলটি যুক্তিসংগতভাবে দাবি করতে পারে, তাদের দলীয় চেহারা মোটামুটি অল্পবয়সি ও ঝকঝকে। দলের প্রবীণদের অবলীলায় রাজভবনের সিনেকিউর বা মার্গদর্শক মণ্ডলে ফেলে দেওয়া হয়েছে।
অন্যদিকে, কংগ্রেস এখনও সত্তরোর্ধ নেতাদের নিয়েই লড়ে যাচ্ছে, তঁাদের কেউ স্বেচ্ছাবসরেও অাগ্রহী নয়, দলও তঁাদের জন্য ‘বিকল্প’ নিদান তৈরি করতে পারেনি। ফলে, কংগ্রেসের তরুণ ব্রিগেডের গালে হাত দিয়ে ‘মেরা নাম্বার কব আয়েগা’ ভাবা ছাড়া গতি নেই।
পুনশ্চ বিজেপির এই সাম্প্রতিক ‘হাই কমান্ড’ নীতির সৌজন্যেই ক্ষমতার অলিন্দে একটি কৌতূহলোদ্দীপক প্রশ্ন ঘোরাফেরা করছে: ‘মোদির পরে, কে?’ এ প্রশ্ন বিশেষ করে অমিত শাহর জন্য। কারণ বর্তমানে তঁার বয়স মাত্র ৬১ বছর, (রাজনীতির নিরিখে তিনি এখনও ‘প্রবীণ’ নন) এবং বয়সের তুলনায় তিনি অনেক বেশি ক্ষমতাধর! রাজ্য ও জাতীয় স্তরে, দলের গুরুত্বপূর্ণ পদে, তিনি ‘কাছের’ ব্যক্তিদের জায়গা নিশ্চিত করেছেন আগেই। জানেন, সম্ভাব্য উত্তরাধিকার মনোনয়নের লড়াইয়ের আপন রাজনৈতিক ভবিষ্যৎকে সুসংহত করার ক্ষেত্রে এমন কাজ কতখানি গুরুত্বপূর্ণ। উত্তরপ্রদেশে বিজেপির নতুন সভাপতি নিয়োগ করা হোক, বা হালে দলের জাতীয় কার্যনির্বাহী সভাপতির নির্বাচন, শাহ-র ভূমিকা অপরিহার্য। আর, এ কারণেই বিজেপির ‘হাই কমান্ড’ পরবর্তী সময়ে কী করবে তা ভবিষ্যদ্বাণী করার বেশ ঝুঁকির। গুজরাতের পয়লা নম্বর প্রভাবশালী জুটি ছাড়া কেউ-ই, এমনকী আরএসএস-ও– দলের ভবিষ্যতের বিষয়ে নিশ্চিত নয়।
