মার্ক টোয়েন বলেছিলেন, কাশী শহরটি ইতিহাসের চেয়েও বেশি প্রাচীন। বাবা বিশ্বনাথ মন্দির খোলনলচে বদলে নবকলেবরে আত্মপ্রকাশ ঘটেছে সম্প্রতি। উদ্দেশ্য হয়তো ভালই। বিদেশি বিলগ্নি আসবে। পর্যটন ব্যবসার রমরমা হবে। কিন্তু বিশালত্ব এলেও বিশ্বনাথ মন্দিরের প্রাচীন স্পিরিচুয়াল মেজাজ গরহাজির। লিখছেন জয়ন্ত ঘোষাল।
আজ মহাশিবরাত্রি। ফাল্গুনের কৃষ্ণ ত্রয়োদশী। কাশী অধিপতি বাবা বিশ্বনাথকে নিয়ে আজ এখানে চলছে এক ধুন্ধুমার কাণ্ড। শ্রীকাশী বিশ্বনাথের দরবার (Kashi Vishwanath Temple) ভক্ত-দর্শনার্থীর জন্য ৪৫ ঘণ্টা খোলা। ১৮ ফেব্রুয়ারি ভোর ২.১৫ থেকে শুরু মঙ্গলারতি। তার আগে দু’দিন ধরে চলল নানা লোকাচার। শিব-পার্বতীর বিয়ের অনুষ্ঠান, গায়ে হলুদ। তারপর মেয়েরা বাবার শরীর থেকে ভস্ম মুছে মুছে পরিষ্কার করল। শিবের বিয়ের বারাত রাজপথে। লোকে লোকারণ্য বারাণসী। আমাদের বাঙালিদের প্রিয় শহর বেনারস (Varanasi)। কালভৈরব সকল দেব-দেবী, অতিথিকে সাদর আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন এ শহরে।
বাবা বিশ্বনাথকে গর্ভগৃহে দর্শন সেই কোন ছোটবেলা থেকে করছি। পারিবারিকভাবেও এ আমার বাপ-ঠাকুরদার শহর। এখনও ফিরে ফিরে আসি ভারতীয় সভ্যতার অন্যতম প্রাচীন এই শহরে। মার্ক টোয়েন বলেছিলেন, কাশী ইতিহাসের চেয়েও বেশি প্রাচীন। বুদ্ধ-র সারনাথ, জৈন ধর্মে সপ্তম, অষ্টম, একাদশ এবং ২৩তম তীর্থঙ্করের জন্মস্থানও এই বেনারস। গোদোলিয়ায় ‘সেন্ট টমাস ক্যাথলিক গির্জা ঘর’– সব নিয়ে এই শহরের আবেদন! কিন্তু এবার বাবার মন্দিরে প্রবেশ করেই মনে হল, হঠাৎ যেন কোনও বিড়লা মন্দির অথবা নতুন কোনও পর্যটক স্থলে এসে পৌঁছেছি! প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির (PM Narendra Modi) নির্বাচন কেন্দ্র এই শহর। এই বিশ্বনাথ মন্দিরের নবকলেবরে আত্মপ্রকাশের পর এই প্রথম আমার আসা।
[আরও পড়ুন: আপস করেছে নির্বাচন কমিশনই! শিব সেনার প্রতীক শিণ্ডেরা পেতেই আক্রমণে উদ্ধব শিবির]
শুরু থেকেই মনকে বুঝিয়েছি– হে মন, নতুনকে স্বাগত জানাতে হবে, আধুনিকতাকে স্বাগত জানাতে হবে। এখন তো আমরা ইউটিউবে রামকৃষ্ণ মিশনের আরতি ‘খণ্ডন ভব বন্ধন জগ বন্দন’ শুনি। বিদেশে তো পুরোহিতরা ল্যাপটপ খুলে ভার্চুয়াল পুজো, পুষ্পাঞ্জলি, শ্রাদ্ধের পারলৌকিক কাজ পর্যন্ত করছে। তাই বিশ্বনাথ মন্দিরের খোলনলচে বদলে এই ‘নিউ লুক’-কে স্বাগত জানাব না কেন? এই মন্দিরের জন্য এখন দুনিয়ায় কাশী ভ্যাটিকান সিটির মতো প্রাচীনের বিশ্বমর্যাদা পাবে। কোটি কোটি টাকার বিদেশি লগ্নি আসবে। শুধু বেনারস নয়, ভারতে পর্যটন ব্যবসার রমরমা হবে। দশাশ্বমেধ ঘাট থেকে সরাসরি বিশ্বনাথ মন্দিরে আসার করিডর তৈরি হবে। অতএব বলো, ‘হর্ হর্ মহাদেব’। অথচ এই মন্দিরে প্রবেশের পর বাস্তব অভিজ্ঞতা কী হল?
প্রথমত, সমগ্র চত্বর ভেঙেচুরে নতুন করতে গিয়ে যেন আর একটা অক্ষরধাম মন্দিরে পরিণত হয়েছে। স্যান্ডস্টোন নির্মিত বিশাল চত্বর-করিডর। মনে হচ্ছে যেন, ‘বাহুবলী’ ছবির সেটে দাঁড়িয়ে আছি।
দ্বিতীয়ত, মানুষের ভিড় এখন কাতারে কাতারে। পরিবর্তন করতে গিয়ে বিশ্বনাথ মন্দিরের চারপাশে ছোট ছোট মন্দির ভ্যানিশ! স্থানান্তরিত হয়েছে। এমনকী, কোথাও একটা কোণঠাসা হয়ে গিয়েছে বড়বাবা শনিরাজের সেই ছোট মন্দির। বাবার গর্ভগৃহের আয়তন বাড়ানো যায়নি। ওই ছোট মন্দিরের ভিতর পান্ডা ও ক্ষমতাশালী পুরোহিততন্ত্রর কৃত্রিমভাবে তৈরি যে-ভিড়, ধস্তাধস্তি, বাবার উপর হুমড়ি খেয়ে পড়া মানুষ, তাদের ধাক্কা দিয়ে ‘চলিয়ে চলিয়ে’ বলতে থাকা পুরোহিতদের কৃত্রিম চাহিদার বাজার– এসব তো অপরিবর্তিত।
তৃতীয়ত, যারা ওখানে ছিল, যারা অজগর সাপের মতো লাইনে দণ্ডায়মান, বিদেশি পর্যটক-সহ বহু কাশীবাসীর মতামত-প্রতিক্রিয়া জানতে চেয়েছি। প্রত্যেকেই নানাভাবে ব্যাখ্যা করলেও, মর্মকথা হল– কতিপয় বিদেশি পর্যটক, ধনী-ভিভিআইপি-দের জন্য সুবন্দোবস্ত হয়েছে। কিন্তু কোটি কোটি সাধারণ মানুষ, গরিব প্রত্যন্ত ভারতীয় জনতা জনার্দনের জন্য খুবই আনন্দের কারণ হয়েছে, এমন নয়। যেমন, ভোর চারটের সময় মঙ্গলারতি দেখার জন্য আপনি এখন ‘অনলাইন বুকিং’ করতে পারেন। আগে হাতে হাতে কুপন দেওয়া হত ‘ফার্স্ট কাম ফার্স্ট সার্ভ’-এর ভিত্তিতে। তখনও দুর্নীতি ছিল, এখনও আছে। এখন আগে রাজনেতা, আমলা, বিচারকদের পৃথক চেয়ারের ব্যবস্থা করে মন্দিরের ঠিক বাইরে বসিয়ে মঙ্গলারতি দেখানো হয়। তারপর ডাক আসে ‘অনলাইন প্রাণী’দের। ততক্ষণে সময় শেষ হয়ে যায়, তাড়াহুড়ো করে সাধারণ মানুষদের কোনরওকমে দূর থেকে দেখিয়ে বের করে দেওয়া হয়।
[আরও পড়ুন: ‘জঙ্গিদের পুষলে এই পরিণতিই হয়’, করাচিতে তালিবানি হামলা নিয়ে পাকিস্তানকে তোপ প্রসাদের]
বিকেল চারটে থেকে ছ’টা– প্রায় দু’-ঘণ্টার জন্য গর্ভগৃহের ভিতর প্রবেশ করে বাবাকে স্পর্শ করার সুযোগ দেওয়া হয়। এজন্য সকাল থেকে লাইন, এই লাইনে পান্ডা মারফত আপনি আগে ঢুকে স্পর্শ করতে পারেন মোটা টাকার বিনিময়ে। আবার পান্ডারা মন্দিরের পুরোহিতদের ‘কাটমানি’ দেয় নিজেদের এই ক্ষমতা পাওয়ার জন্য। উলটে পুরোহিতরা বলে দিয়েছে, পুলিশ ভিতরে ঢুকতে পারবে না।
চতুর্থত, বাবা বিশ্বনাথের দর্শনের পরই আমরা মা অন্নপূর্ণার কাছে যেতাম। এখনও যাওয়া যায়। একটু ঘুরপথে। সে না হয় যেতে যেতে অভ্যাস হয়ে যাবে। কিন্তু অনেকে জানে, অনেকে জানে না– বাবা বিশ্বনাথের ট্রাস্ট আর মায়ের ট্রাস্ট কিন্তু আলাদা। বাবা বিশ্বনাথের মন্দির চত্বরে এত পরিবর্তন হলেও মা অন্নপূর্ণার মন্দিরের ভিতরও এবং বিনিপয়সায় প্রসাদের ব্যবসাও একইভাবে অবিকৃত। এখানেও ভেদজ্ঞান আছে আর সেই ভেদজ্ঞানে আছে রাজনীতি। যাই হোক, অন্নপূর্ণা মন্দিরে গিয়ে বেশ পুরনো পুরনো মেজাজ পেলাম। যাকে বলে ‘অ্যাট হোম’।
মরিশাস থেকে এসেছেন প্রকাশ পাছুয়া। বাবার অস্থিভস্ম বিসর্জন দেওয়ার উদ্দেশে আসা। লন্ডনে আন্তর্জাতিক আইনের অধ্যাপক। প্রকাশ পাছুয়ারা মরিশাসে আছেন ছ’-পুরুষ। আদি পিতৃপুরুষরা ছিল ঔপনিবেশিক যুগে দক্ষিণ ভারত থেকে আসা দাস (স্লেভ)। যাই হোক, ২০১৮ সালে প্রকাশ এসেছিলেন এই মন্দিরে। আবার এবার এলেন নতুন মন্দিরে। তিনি বললেন, আধুনিকত্ব এসেছে, বিশালত্ব এসেছে,
কিন্তু সেই স্পিরিচুয়াল মেজাজ পাচ্ছি না। হয়তো পাব, পরে। আমার প্রশ্ন, এই নবকলেবরের ঢক্কানিনাদে কী পরিবর্তন হল? গোদোলিয়া থেকে মন্দির আসার পথে দু’-ধারের দোকান রং হয়েছে, নতুন এসেছে হুইলচেয়ার। তবে ভিড়, ধাক্কাধাক্কি, ভিখারি, মোটর সাইকেল-স্কুটার, রাস্তার সামনে বেআইনি হকার সবই তো একইরকম। নরেন্দ্র মোদি বা ভিভিআইপি-রা এলে এই রাস্তা সম্পূর্ণ খালি করে দেওয়া হয়। মোদি দেখেন জনমানবশূন্য রাজপথ। আমরা সে ছবি দেখি ভাবি, ‘এক নতুন বারাণসী!’
আসলে আগে যেমন যে কোনও মানুষ হাঁটতে-হাঁটতে চলে যেতে পারত বাবার কাছে, এখন তা সম্ভব নয়। পুরোহিত-পান্ডাদের দৌরাত্ম্য আরও বেড়েছে। ৩,৫০০ টাকার একটা বার্ষিক ‘পাস’ করানো যায়, সেটি থাকলে আপনি যখন-তখন ঢুকতে পারেন মন্দিরে। তবে শিবরাত্রি বা শ্রাবণ স্নানের বিশেষ দিনে আবার সে ‘পাস’ কাজ করবে না। গ্রামের বহু মানুষের এখনও মোবাইল নেই, তারা ‘অনলাইন বুকিং’ করতে পারে না, ফলে বড় হেনস্তার শিকার।
রোম-ইতালির সভ্যতাকে রক্ষা করার আধুনিক প্রয়াস দেখেছি। সেখানে অতীতের স্থাপত্য, এমনকী, ভেঙে যাওয়া কলোসিয়ামকে ঠিক রক্ষা করার আধুনিক পুরাতাত্ত্বিক কৌশল দেখেছি। সেভাবেই কি এই মন্দিরের, এই কাশী অধিরাজের নিবাসস্থলের সংস্কার, সম্ভব ছিল না? নতুন করে মন্দিরের মাথায় কোনও ব্যবসায়ী আরও তাল-তাল সোনা যুক্ত করেছে, কিন্তু সামগ্রিক পরিবর্তন যত রাজসিক, তত সাত্ত্বিক মনে হচ্ছে না।
নরেন্দ্র মোদির ইচ্ছায় হয়তো সততা ছিল, কিন্তু একবার ভাবুন তো, সত্যজিৎ রায়ের অপুর সেই ঘাটের সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে যাওয়া, ‘জয়বাবা ফেলুনাথ’-এর সেই বারাণসীর গলি, সেই বাঙালি টোলার স্মৃতি, সেই বিসমিল্লার সানাইয়ের শহরে এই উচ্চকিত রজোগুণ কি কিঞ্চিৎ বেমানান নয়?
[আরও পড়ুন: কলকাতায় প্রথম AI কোর্স সেন্ট জেভিয়ার্সে, ক্যাম্পাসেই বিমানের ভিতর এভিয়েশনের ক্লাসরুম!]
মহাদেব তথাকথিত অনার্য দেবতা, লড়ে ব্রহ্মা-বিষ্ণুর পাশে এসে স্থান দখল করলেন ভগবানের পলিটব্যুরোতে। সেই ছাইমাখা সাব-অলটার্ন ভগবানকে এভাবে পর্যটকের বিষয় বানিয়ে দেওয়ায় স্বামীজি-কথিত সেই বার্ধক্যের বারাণসীতে কোথাও একটা চিনচিনে ব্যথা অনুভব করছি। গঙ্গায় জল নেই। বরুণা-অসিতে মাত্রাতিরিক্ত দূষণ। জনস্বার্থবাহী মামলায় নোটিস জারি করেছে হাই কোর্ট। উত্তরাখণ্ড থেকে জল আসছে না, বেনারসের গঙ্গায় চর পড়ে আছে। ‘নমামি গঙ্গা প্রকল্প’ দশ বছর পর আজ গোটা দেশে
কোথায় দাঁড়িয়ে?
সেসব অগ্রাধিকার ভুলে ভোলেবাবার মন্দিরের শরীরে আরও সোনা বসানো পুরোহিতদের আরও ক্ষমতাশালী করে তোলা হল। বদ্রিনাথের লেখায় পড়েছিলাম, কাশীর মন্দিরের সামনে এক রানি এলেন। গাড়ি থেকে নামলেন। পান্ডারা এসে তাঁর পা মোহর দিয়ে ঢেকে স্বাগত জানাল। বদ্রিনাথের মনে হয়েছিল, এই কি সভ্যতা?
সদ্য আবার বাবা বিশ্বনাথ মন্দিরে এসে মনে হচ্ছে– এ কীসের আধুনিকতা? সভ্যতা-সংস্কৃতির এ কোন ভারত চেতনা! করিডরে নতুন মূর্তি এক ভারতমাতার, তাতে কি আদি ভারতীয়ত্বর নবজাগরণ হল?