ভারতে ইলিশ রপ্তানি নিয়ে বাংলাদেশের টানাপোড়েনের অন্দরে আসলে কোন খেলা? আন্তর্জাতিক কূটনীতির ক্ষেত্রে এই ঘটনার তাৎপর্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের নতুন সরকারের সঙ্গে দিল্লির সাউথ ব্লকের সম্পর্কের সমীকরণ কোন দিকে যেতে পারে, তার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে কি? লিখছেন গৌতম সরকার।
উৎসবের মরশুমে বাঙালির রসনায় থাবা বসাতে চলেছিল বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের একটি সিদ্ধান্ত। কয়েক দিন আগে, ঢাকা থেকে সে-দেশের মৎস্য ও প্রাণীসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার জানিয়েছিলেন, দেশের মানুষকে বঞ্চিত করে এ-বছর ওপার বাংলায় পদ্মা-মেঘনার ইলিশ পাঠানোর সিদ্ধান্ত খারিজ করা হয়েছে। তঁার মতে, রফতানির ফলে দেশীয় বাজারে জোগান কমে যাওয়ার কারণে– দেশবাসীকে বেশি দাম দিয়ে ইলিশ খরিদ করতে হয়।
প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, পূর্ববর্তী আওয়ামি লিগ সরকার আভ্যন্তরীণ জোগান হ্রাসের কারণে ২০১২ সাল থেকে ইলিশ রফতানি বন্ধ করে দিয়েছিল। যদিও বিশেষজ্ঞদের মতে, আসল কারণ ছিল– তিস্তার জলবণ্টন সংক্রান্ত বিবাদ। পরে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৮ সাল থেকে সৌভ্রাতৃত্বের নজির স্বরূপ প্রতি বছর দুর্গাপুজো, পয়লা বৈশাখ এবং জামাইষষ্ঠীতে প্রায় ৫ হাজার টন ইলিশ রফতানির অনুমতি দিয়েছিলেন। বর্তমানের ইউনুস সরকার সেটাও বন্ধ করে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু হঠাৎ করে ২১ সেপ্টেম্বর সেই সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করে পুজোর আগে ৩ হাজার টন ইলিশ রফতানি করবে বলে সরকারি তরফে জানানো হয়েছে। কিন্তু কেন এই সিদ্ধান্ত বদল?
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কোয়াড সম্মেলনে যোগ দিতে এই মুহূর্তে আমেরিকায়। বাংলাদেশ অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান মুহাম্মদ ইউনুস আগামী ২৪ সেপ্টেম্বর আমেরিকা যাচ্ছেন। এক ঢিলে দুই পাখি মারার কৌশলে মোদির সঙ্গে একটা বৈঠকের আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। সেই প্রস্তাবে দিল্লি ‘না’ করতেই এই সিদ্ধান্ত বদল। গত ৫ আগস্ট ছাত্র আন্দোলন ও গণ-অভ্যুত্থানের জেরে নিজের দেশ ছেড়ে শেখ হাসিনার ভারতে আশ্রয় নেওয়ার পর থেকে দুই দেশের মধ্যে মন কষাকষি হয়েছে। তখন থেকেই বিভিন্নভাবে সে-দেশের সরকার ভারতের বিরুদ্ধে পুঞ্জীভূত রাগ উগরে দিচ্ছে। সর্বোপরি, সে-দেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান অর্থনীতিবিদ মুহাম্মদ ইউনুস সাংবাদিক সম্মেলনে যে বিবৃতি দিয়েছেন, সেটি আন্তর্জাতিক রাজনীতির একটি চর্চিত বিষয় ‘মেগাফোন কূটনীতি’-র প্রসঙ্গকেও উসকে দিয়েছে।
‘মেগাফোন কূটনীতি’ কী?
মেগাফোন হল একটি যন্ত্র, যা মানুষের কণ্ঠস্বরকে বেশ কয়েক মাত্রায় বাড়িয়ে দূরে থাকা অন্য মানুষের কানে পৌঁছে দেয়। এখান থেকেই ‘মেগাফোন কূটনীতি’ শব্দদ্বয়ের চয়ন। রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে, যদি কোনও দেশ বা সেই দেশের নেতা, দ্বিপাক্ষিক কূটনৈতিক আলোচনা ব্যতিরেকে নিজের বক্তব্য সরাসরি গণমাধ্যমে বা জনসমক্ষে প্রকাশ করে, তাহলে সেই আচরণকে ‘মেগাফোন কূটনীতি’ আখ্যা দেওয়া হয়।
এটি এমন একটি কৌশল, যার প্রয়োগে একদিকে বিপক্ষের উপর চাপ প্রয়োগ করা হয় এবং অন্যদিকে আমজনতার মনোযোগ আকর্ষণের মাধ্যমে নিজের অবস্থানকে জোরালো ও শক্তিশালী করে তোলা যায়। ঠিক এই ঘটনাটাই গত মাসে ঘটিয়েছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। কোনও আলোচনার মধ্যে না গিয়ে ভারতীয় সংবাদ সংস্থা ‘প্রেস ট্রাস্ট অফ ইন্ডিয়া’-কে বিবৃতি দেওয়ার নামে ভারতকে হুমকি দিয়েছেন– ‘বাংলাদেশ শেখ হাসিনাকে ফেরত চাওয়ার আগে পর্যন্ত ভারত যদি তাকে রাখতে চায়, তাহলে শর্ত হচ্ছে তাকে চুপ থাকতে হবে।’ ‘মেগাফোন কূটনীতি’-র চালে এই একপক্ষীয় শর্ত চাপিয়ে দেওয়ার অর্থ হল বিপক্ষ বা বিরুদ্ধ দেশকে বিব্রত করা। এই জায়গায় তিনি ১০০ শতাংশ সফল। বিষয়টিতে ভারত রীতিমতো বিব্রত।
বিশ্বের প্রেক্ষিতে ‘মেগাফোন কূটনীতি’
‘মেগাফোন কূটনীতি’ শব্দবন্ধের উৎপত্তির সময়কাল নিয়ে মতবিরোধ থাকলেও মোটামুটিভাবে ১৯৭০ এবং ১৯৮০-র সময়ে আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক প্রসঙ্গে এটি জনপ্রিয়তা লাভ করে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে চলতে থাকা শীতল যুদ্ধের সময় এটির চর্চা শুরু হয়েছিল। সেই সময় গণমাধ্যমে দুই দেশ একে-অপরকে চমকে বেসামাল করে দেওয়ার কূটনৈতিক খেলায় মেতে ওঠে। মূলত গণমাধ্যমের ক্রম-প্রসার, রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক আঙিনায় গণমাধ্যমের সক্রিয় অংশগ্রহণ, মেগাফোন কূটনীতির বিস্তার-লাভের প্রধান কারণ।
‘মেগাফোন কূটনীতি’ বনাম ইলিশ বিতর্ক
সেই বিতর্কিত সাক্ষাৎকারের পর এল ইলিশ রফতানি নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের একপাক্ষিক টালবাহানা। ঢাকার সংবাদ সংস্থার রিপোর্ট বলছে, সেই দেশের মৎস্যবিষয়ক উপদেষ্টা ফরিদা আখতার বাণিজ্যমন্ত্রীকে ভারতে একটিও ইলিশ না পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন। এ-ও কি এক ধরনের মেগাফোন কূটনীতি নয়? দুই দেশের মধ্যে বিভিন্ন কূটনৈতিক মতবিরোধ থাকলেও পূর্বতন প্রধানমন্ত্রী ভারতের সঙ্গে একটা প্রতিবেশীসুলভ সুস্থ সম্পর্ক রক্ষায় বিশ্বাসী ছিলেন। সে-কারণেই ২০১২ সালে বন্ধ হয়ে যাওয়া ইলিশ রপ্তানির চুক্তি ২০১৯ থেকে একটু শিথিল করেছিলেন।
বাঙালির, বিশেষ করে হিন্দুদের ধর্মীয় পার্বণের প্রতি সম্মান ও সহানুভূতি দেখিয়ে বছরে তিনবার ইলিশ রফতানির চুক্তি করেছিলেন, যদিও খাতায়-কলমে বাংলাদেশ সরকার সেটাকে পুজো, নববর্ষ ও জামাইষষ্ঠীর ‘উপহার’ হিসাবেই দেখাত। গত বছরও, পুজোর মুখে, হাসিনা সরকার ৪ হাজার টন পদ্মার ইলিশ পাঠিয়েছিল। সে-সময়ও হয়তো দেশীয় বাজারে জোগানে টান পড়ত, কিন্তু পড়শি রাজ্যের সর্ববৃহৎ অনুষ্ঠানে যাতে বাঙালির পাত পদ্মার ইলিশের সুবাস থেকে বঞ্চিত না-হয়, সেটা দরদের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। নতুন সরকার সেই শিষ্টাচার ধরে রাখতে কতটা সচেষ্ট হবে– তা নিয়েও ধন্দ থেকে যাচ্ছে।
তবে ইলিশ রপ্তানি নিয়ে টানাপোড়েন চললেও, ভারত থেকে ডিমের আমদানি অব্যাহত রেখেছে বাংলাদেশ। তার উপর তাদের তরফে আলু ও পেঁয়াজের রফতানি অন্য বছরের মতোই স্বাভাবিক রাখার জন্য অনুরোধ এসেছে। ভারত রফতানি না-করলে বাংলাদেশে আলুর দাম দঁাড়াবে কেজি প্রতি ৭০ টাকা এবং পেঁয়াজ ১৪০ টাকা। ভারত থেকে স্বাভাবিক রফতানি পৌঁছলে কেজি পিছু আলুর দাম কমে হবে ৪০ টাকা এবং পেঁয়াজের কিলো প্রতি দাম ১০০ টাকার নিচে পৌঁছবে। ফরিদা আখতারের বক্তব্যর পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, ভারতকে ইলিশ মাছ পাঠালে স্থানীয় বাজারে একজন বাংলাদেশিকে বেশি দাম দিয়ে ইলিশ কিনতে হয়; মুদ্রার উল্টোপিঠটা দেখলে চোখে পড়বে– ভারত থেকে আলু, পেঁয়াজ, ডিম পৌঁছলে একজন বাংলাদেশি দেশীয় বাজারে অর্ধেক দামে এই দ্রব্যগুলো কিনতে পারবে। অর্থনীতির তাত্ত্বিক জ্ঞান না থাকলেও সহজেই বোঝা যায়– ডিম, আলু, পেঁয়াজ হল জীবনধারণের আবশ্যিক অর্থাৎ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য, ইলিশ কিন্তু ততটা নয়।
বাংলাদেশ জানিয়েছিল, এ-বছর তারা কোনও দেশেই ইলিশ রপ্তানি করবে না। কিন্তু ভুললে চলবে না, ভারতে বাংলাদেশের ইলিশ রফতানি ‘স্বাভাবিক’ রপ্তানি নয়, ‘সৌজন্যমূলক’ (যদিও বাংলাদেশের সরকারি বিবৃতি বলছে, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতেই নাকি তারা ভারতে ইলিশ পাঠানোর সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করেছে)। এদিকে, ভারতকে যা ভাবাচ্ছে, তা হল, সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো শুধুমাত্র ইলিশ রফতানি বা মেগাফোন কূটনীতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে না। নয়া সরকার ক্ষমতায় আসার পরপরই, নিষিদ্ধ সন্ত্রাসী সংগঠন ‘আনসারুল্লাহ বাংলা’ দলের প্রধান জসীমউদ্দীন রহমানিকে গত মাসে জামিনে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। এই ব্যক্তি ২০১৫ সালে এক ব্লগারকে হত্যার অপরাধে জেল খাটছিলেন। ক’দিন আগে ন’জন মৌলবাদী জেল ভেঙে পালালে এখনও পর্যন্ত কেবলমাত্র চারজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গত মাসে কয়েকজন দণ্ডিত ইসলামি জঙ্গিকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। তার মধ্যে কয়েকজন ভয়ংকর ভারত-বিদ্বেষী বলে পরিচিত। কূটনীতি-বিশেষজ্ঞদের মতে– ইসলামি কট্টরপন্থীরা যদি বাংলাদেশে শক্ত বুনিয়াদ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে পারে, তবে তা দিল্লির সাউথ ব্লকের জন্য যথেষ্ট মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াবে।