এই শরৎ বড় দরদহীন। মহাষষ্ঠীর আগেই বিসর্জনের বাজনা বাজিয়ে দিল সংবাদ প্রতিদিন পরিবারে। আমরা হারালাম অমল চক্রবর্তীকে। যত বড় শিল্পী, তত বড় মনের মানুষ। বাইরে অন্তর্মুখী, কিন্তু চেনা মহলে মাঝে মাঝেই খোলস ভেঙে বেরিয়ে আসতেন একজন হাস্যমুখর, পরিহাসপ্রিয় ব্যক্তি– যিনি ‘তির্যক’ চোখে এই জগতের রহস্য ও লীলা বুঝতে চান। কার্টুনের স্বার্থে। শিল্পের সিদ্ধির জন্য। তবে বক্র-দৃষ্টির সিনিক মনোভাব ‘ব্যক্তি’ অমল চক্রবর্তীকে কখনও স্পর্শ করেনি। সংবাদ প্রতিদিন প্রতিষ্ঠার প্রথম দিন থেকে তাঁর কার্টুন প্রকাশিত হয়েছে। কখনও প্রথম পাতায়। কখনও সম্পাদকীয় পাতায়। ধারে-ভারে-ঔজ্জ্বল্যে তা পাঠককে হাসিয়েছে, নির্মলতায় সমৃদ্ধ করেছে। হাসানোর মধ্যে দিয়েই অমল চক্রবর্তী মানুষের ভিতরের অসুর-সত্তাকে বাইরে আনতে ও চেনাতে চেয়েছিলেন। ‘অমল আলোয়’ তার প্রমাণ। আজকের দিনের ‘অমল আলোয়’ শিল্পের স্থানে আমরা শিল্পীকে অভিষিক্ত করলাম। এই মোদের শেষ প্রণাম। লিখলেন সৃঞ্জয় বোস।
হাসপাতালের সঙ্গে শেষ কমাসে ঘনিষ্ঠতা বাড়ছিল কার্টুনিস্ট অমল চক্রবর্তীর (Amal Chakraborty)। খবর পেতাম। উৎকণ্ঠা হত। মৃত্যু এড়িয়ে কেই বা অমর হতে পেরেছে! কিন্তু মন যেন বাগ মানত না। সংবাদ প্রতিদিন পরিবারের সঙ্গে অমলদার নাড়ির যোগ। কাগজ প্রতিষ্ঠার প্রথম দিন থেকে উনি জড়িয়ে আছেন। ফলে শুধু বয়সে নয়, অভিজ্ঞতা এবং অভিজ্ঞানেও তিনি অভিভাবক তুল্য। পরিবারের অভিভাবকদের কেউ কি হারাতে চায় কখনও? উদ্বেগ হত এজন্যই।
ঘনিষ্ঠদের কাছে নিজের স্বপ্ন গোপন রাখেননি। একশো বছর বয়স অবধি কার্টুন (Cartoon) করে যাওয়ার বাসনা ছিল। আমরা দুর্ভাগা, পারলাম না তাঁকে ধরে রাখতে। সহযোগিতার বাঁধ তৈরি করে তাঁকে সেঞ্চুরি-উত্তীর্ণ করাতে। কত বড় মাপের শিল্পী ছিলেন, তা নতুন করে নাই বা বললাম আমি। যাঁরা এই বিষয়ে যোগ্য, তাঁরা নিশ্চয়ই মার্গ দেখাবেন। আমার মনে পড়ছে তাঁর পরিশীলিত ব্যবহার, মন আলো করা হাসি, নম্রভাবে কথা বলার ধরনটি। আমার মনে পড়ছে রাজনৈতিক কার্টুনের প্রতি তাঁর অপার উৎসাহের কথা। আমার মনে পড়ছে উপান্তে এসেও প্রবল জীবনীশক্তিতে মনের জানালা-দরজা খুলে রাখার চেষ্টা করে যাওয়া, যাতে মুক্ত বাতাস ঢোকে ভিতরে।
[আরও পড়ুন: মামলা বেশি, লোকবল কম! চাপ সামলাতে রাজ্য পুলিশের কর্মী চাইছে CBI]
২০২১ সালের ৬ জুন অমল চক্রবর্তীকে নিয়ে একটি সংখ্যা ‘রোববার’ করেছিল ‘অমল আলো’ নামে। সেখানে বলেছিলাম যে, মানুষটি পেশাদারিত্বের সঙ্গে কখনও আপস করেননি। প্রচারের আলো থেকে দূরে থাকতেন সবসময়। তাঁর প্রয়াণের পরে এই কথাগুলি আরও একবার মনে করিয়ে দেব পাঠকদের। সেই সঙ্গে বলব, ভগ্ন স্বাস্থ্যের বিরুদ্ধে তাঁর তুমুল সংগ্রামের কথাও। এত আত্মবিমুখ ছিলেন, নিজে মুখে কখনও কিছু বলেননি। কখনও কিছু চাননি।
[আরও পড়ুন: স্ত্রীকে খুন করে আগুন লাগিয়ে প্রমাণ লোপাটের চেষ্টা! বউবাজারে গ্রেপ্তার স্বামী]
সম্প্রতি গুরুতর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে যখন ভর্তি হলেন, আমরা বদ্ধপরিকর ছিলাম চোয়াল চাপা লড়াই করে তাঁকে ফিরিয়ে আনব। কিন্তু সেই সুযোগ দিলেন কোথায় অমলদা? অনেকখানি শারীরিক যাতনা ভোগ করে বিদায় নিলেন নিশ্চুপে। তাঁর কার্টুনে যেমন লেগে থাকত একরাশ অনুযোগহীন প্রীতির সুর রোদ্দুরের মতো, বিদায়বেলাতেও তা অনুরণিত হল।
হাতে-হাতে স্ট্রেচারে বহন করে আমরা তাঁকে নিয়ে এসেছিলাম সংবাদ প্রতিদিন অফিসে। বুধবার বিকেলে। আবার হাতে-হাতে স্ট্রেচারে বহন করে তাঁকে যখন তুলে দিলাম শববাহী গাড়ির ঘেরাটোপে মন বলছিল, যেতে নাহি দিব। কিন্তু তবু হায়, যেতে দিতে হয়। অমলদার মৃত্যুতে একটি যুগের অবসান হল, সত্যি। তবে ‘সংবাদ প্রতিদিন’-এর পাতায় পাতায় যেসব মণিমানিক্য রেখে গেলেন, তা নতুন প্রজন্মের পাথেয়।
যেখানেই থাকুন, ভাল থাকুন অমলদা।