হরিয়ানার ভোটের ফল পক্ষে যেতেই কি ফের গলার সুর চড়েছে গেরুয়া শিবিরের? আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবত বিজয়া দশমীর দিন যে বার্তা দিয়েছেন, তা কি নতুন করে গেরুয়া শিবিরকে রাজনীতির দিশা দেখাতে পারবে? লিখছেন সুতীর্থ চক্রবর্তী।
হরিয়ানার ভোটের ফল পক্ষে যেতেই কি ফের নখ-দঁাত বের করা শুরু করল গেরুয়া শিবির? এই প্রশ্ন এখন ঘুরপাক খাচ্ছে দেশের রাজনৈতিক মহলে। লোকসভা ভোটের ফল বেরিয়েছিল এই বছরের ৪ জুন। তারপর গত চারটে মাস সংঘ পরিবারের স্বর গত এক দশকের তুলনায় যে অনেকটাই ক্ষীণ ছিল, তা বলা বাহুল্য। নরেন্দ্র মোদি তো কিছুটা অন্তরালেই ছিলেন। হরিয়ানায় ভরাডুবি হবে বলে বিজেপির অভ্যন্তরীণ সমীক্ষায় তথ্য উঠে এসেছিল। জম্মু-কাশ্মীরে দল জেতার জায়গায় নেই তা বিজেপি নেতারা জানতেন। নরেন্দ্র মোদি, অমিত শাহরা অাশঙ্কা করছিলেন লোকসভা ভোটে যে-পতনের সূচনা ঘটেছে, তাকে অারও ত্বরান্বিত করতে পারে হরিয়ানা বিধানসভা নির্বাচনের ফল। কিন্তু অপ্রত্যাশিত জয় এসেছে হরিয়ানায়। জম্মুতে হিন্দু ভোটারদের সার্বিক সমর্থন মিলেছে। অার, তাতেই যেন ফের সিংহগর্জন শুরু হয়েছে নাগপুরের সদর দপ্তর থেকে।
বিজয়া দশমীর দিন নাগপুর থেকে অারএসএসের প্রধান তথা সরসংঘচালক যে বার্তা দেন, তা গেরুয়া শিবিরকে রাজনীতির দিশা দেখায় বলে রাজনৈতিক মহল মনে করে। এবারের বিজয়া দশমীতে অারএসএস-প্রধান মোহন ভাগবতের ভাষণটির তাৎপর্য অারও বেশি রয়েছে এই কারণে যে, অাগামী বছর তাদের সংগঠনের শতবর্ষ উদ্যাপন শুরু হচ্ছে। সংঘের প্রাক্-শতবর্ষ ভাষণে যে ভাগবত আরও সুদূরপ্রসারী রাজনৈতিক ভাবনাকে সামনে রেখে কর্মীদের দিশা দেখানোর চেষ্টা করবেন, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করা অবান্তর। ঘটনাচক্রে হরিয়ানা ও জম্মু-কাশ্মীরের বিধানসভা ভোটের ফল ঘোষণা ও ভাগবতের বিজয়া দশমীর বার্তা প্রদানটি চারদিনের ব্যবধানে ঘটল। হরিয়ানার জয় এবং হিন্দু অধু্যষিত জম্মুতে বিজেপির তুলনামূলক ভাল ফল ভাগবতকে তঁার নিজস্ব রাজনীতির চেনা ছকে ফিরে যেতে সাহায্য করেছে।
ভাগবতের এক ঘণ্টার ভাষণ বাংলাদেশে হিন্দুদের উপর নির্যাতন, অনুপ্রবেশ, সীমান্তে পাকিস্তানের অস্থিরতার চেষ্টা, বামপন্থীদের দেশবিরোধী যড়যন্ত্র, সংখ্যালঘু তোষণ ইত্যাদি সংঘ পরিবারের চিরাচরিত ইসু্যগুলিকে সামনে এনেছে।
হরিয়ানায় বিজেপির জয়ের কারণ হিসাবে লোকসভা ভোটে হাতছাড়া হয়ে যাওয়া দলিত ভোটের কিছুটা প্রত্যাবর্তনকে দেখা হচ্ছে। জাঠ ভোট বিজেপির সম্পূর্ণ বিরুদ্ধে ছিল। ফসলের ‘নূ্যনতম সহায়ক মূল্য’ নিয়ে কেন্দ্রের বিরুদ্ধে কৃষকদের ক্ষোভ, অগ্নিপথ প্রকল্প নিয়ে সেনা-জওয়ানদের বিরক্তি এবং ব্রিজভূষণের ঘটনায় বিজেপির বিরুদ্ধে পালোয়ানদের ঘৃণা– এই তিন মুদ্দা তাদের পক্ষে বাজিমাত করবে বলে কংগ্রেস আশা করে বসেছিল। হরিয়ানায় কিষান, জওয়ান এবং পালোয়ানদের বড় অংশ জাঠ সম্প্রদায়ভুক্ত।
আবার এই জাঠরাই হরিয়ানার জনসংখ্যার প্রায় সিকিভাগ। ভোটারদের এই বৃহৎ অংশের সমর্থন নিশ্চিত ভেবে কংগ্রেস হরিয়ানা জয়ের ব্যাপারে অতিমাত্রায় আত্মবিশ্বাসী ছিল। কিন্তু বিজেপি নানারকম কৌশল করে এই জাঠ ভোটকে ভাঙতে সক্ষম হয়েছে। দলিত ভোট ফেরানো ছাড়াও হরিয়ানার সাফল্যের পিছনে সংঘ পরিবারের ঐক্যবদ্ধ থাকাকেও রাজনৈতিক মহল সাফলে্যর একটি কারণ হিসাবে চিহ্নিত করছে। লোকসভা ভোটের সময় বিজেপি ও আরএসএসের দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে ছিল। আরএসএস কর্মীদের সক্রিয়তা ছাড়াও ভোট জেতা যাবে– এই মনোভাব লোকসভা ভোটের সময় বিজেপির নেতা-কর্মীদের ছিল। যা দলের সর্বভারতীয় সভাপতি জগৎ প্রকাশ নাড্ডা প্রকাশে্য বলেও ফেলেছিলেন। হরিয়ানায় অনেক দিন পর অারএসএস কর্মীদের পুরোমাত্রায় প্রচারে দেখা গিয়েছিল বলে দাবি রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের।
নাগপুরের ভাষণ থেকে এবার আরএসএসের প্রধান হরিয়ানার এই নির্বাচনী সাফল্যের বার্তাকেও এগিয়ে নিয়ে যেতে চেয়েছেন বলে বিশ্লেষকদের অভিমত। এককথায়, ভাগবতের বক্তৃতা শুধু অাগামিদিনের জন্য সংঘ পরিবারের রাজনীতির ন্যারেটিভ তৈরি করার চেষ্টা নয়, ভোটকে সামনে রেখেও দেওয়া। সামনে মহারাষ্ট্র ও ঝাড়খণ্ডের ভোট। তাই ভাগবতের ভাষণে সমাজ-সংস্কারক হিসাবে শুধুমাত্র চারটি চরিত্র উঠে এসেছে। যেটা খুবই হাস্যকর। ভাগবত এককালের মারাঠা রানি অহল্যাবাই হোলকারের কথা বলেছেন, যিনি দেশে অসংখ্য মন্দিরের সংস্কার করেছিলেন। ভাগবত আর্য সমাজের প্রতিষ্ঠাতা দয়ানন্দ সরস্বতীর প্রসঙ্গ টেনেছেন। দয়ানন্দ গুজরাতের মানুষ হলেও আর্য সমাজের প্রথম সভা বম্বেতে হয়েছিল। এছা়ড়াও অারএসএস প্রধান বলেছেন বিরসা মুন্ডা ও অনুকূল ঠাকুরের কথা। বিরসা মুন্ডা ঝাড়খণ্ডনিবাসী অাদিবাসীদের একাংশের কাছে ভগবান। অনুকূল ঠাকুরের আশ্রম দেওঘরে অবস্থিত। যা বর্তমানে ঝাড়খণ্ডের মধ্যেই পড়ে।
কিন্তু ভাগবতের ভাষণের মূল প্রতিপাদ্যটি যদি বিচার করতে হয়, তাহলে সংঘ পরিবারের উগ্র জাতীয়তাবাদ ও িহন্দুত্বের রাজনীতি ছাড়াও বিরোধী স্বরকে দমন করার প্রসঙ্গটি অাসবে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে মানুষের অধিকার, দাবিদাওয়ার অান্দোলনকে নৈরাজ্য সৃষ্টির চেষ্টা বলে সংঘপ্রধান যেভাবে দাগিয়ে দিয়েছেন তা খুব তাৎপর্যপূর্ণ বিশ্লেষকদের কাছে। ভাগবত তঁার ভাষণে বাংলাদেশের ঘটনাবলির প্রসঙ্গ টেনে বলেছেন, ভারতে এই ধরনের অস্থিরতা ও নৈরাজ্য সৃষ্টির প্রয়াস রয়েছে। সামান্য অসন্তোষকে কাজে লাগিয়ে মানুষকে অাইন-অাদালত সহ সিস্টেমটির বিরুদ্ধে খেপিয়ে তোলার চেষ্টা হচ্ছে। বাংলাদেশ প্রসঙ্গে তঁার ইঙ্গিত, এত দ্রুত সরকার ফেলে দেওয়ার মতো নৈরাজ্য-সৃষ্টির নেপথ্যে বিদেশি শক্তির মদত রয়েছে। এই প্রসঙ্গে তিনি ‘ডিপ স্টেট’, ‘ওয়াকিজম’, ‘সাংস্কৃতিক মার্কসবাদ’ ইত্যাদি শব্দের ব্যবহার করেছেন। অর্থাৎ মোদি ও অমিত শাহরা যেভাবে বিরোধী স্বরকে দমন করতে এত দিন ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব সামনে এনেছেন, ঠিক সেভাবেই ভারতে বাংলাদেশের মতো পরিস্থিতি তৈরির চক্র সচল বলে ভাগবত মন্তব্য করেন।
মোদি-শাহরা রাহুল গান্ধীকে মাওবাদী বা কংগ্রেসকে ‘আরবান নকশাল’ বলে সবসময় আক্রমণ করে যাচ্ছেন। ভাগবত যেন তঁার ভাষণে মোদিকে পূজ্যপাদ করে সেই তত্ত্বেই সিলমোহর দিয়েছেন। দ্বিতীয়ত, ভাগবতের ভাষণে এই বার্তা দেওয়ার প্রচেষ্টা ছিল যে, বিজেপি দলিত সমাজের পক্ষে কাজ করতে চাইলেও বিরোধী দলগুলি আপন রাজনীতির স্বার্থে সমাজের এই অংশের মধ্যে জাতপাত তুলে বিভেদ ঘটাচ্ছে। লোকসভা ভোটে বিজেপির বিরুদ্ধে কংগ্রেসের প্রচারের মূল ইসু্য ছিল, বিজেপি সংবিধানকে বদলে দেবে। যা দলিত মানুষ বিশ্বাস করেছিল। সংবিধানের চিরাচরিত সমালোচক অারএসএস প্রধানের সংঘের প্রাক-শতবর্ষ ভাষণে কর্মীদের প্রতি তাৎপর্যমূলক বার্তা, সংবিধানকে রক্ষা করতে হবে। তার প্রস্তাবনা ও সংরক্ষণ ব্যবস্থাকে বঁাচাতে হবে। রাজনৈতিক বিশ্লষকদের একাংশের মতে সরসংঘচালকের মুখে এই কথা খুবই হেঁয়ালিপূর্ণ। শুধুমাত্র ভোটের স্বার্থে তিনি মোদি-শাহের মুখের ভাষাই অাওড়েছেন প্রাক-শতবর্ষের বার্তায়। তিনি হাথরস, বিলকিস বানো বা ব্রিজভূষণ নিয়ে চুপ থাকলেও অার জি কর নিয়ে মন্তব্য করেছেন। মোদ্দা কথা, হরিয়ানার ভোটের ফল দেখেই দূরত্ব ঘুচেছে নাগপুর ও নর্থ ব্লকের মধে্য। যার প্রতিফলন অারও নগ্নভাবে এ বার কেন্দ্রর সরকার পরিচালনাতেও পড়ার অাশংকা। তারই ইঙ্গিত ভাগবতের ভাষণে।