কংগ্রেসের ‘হাইকমান্ড’ কে বা কারা, তা নিশ্চিত করে বলা দায়। কারণ শতাব্দীপ্রাচীন দলে না আছে ‘উচ্চতা’, না আছে ‘দাপট’। সোনিয়া-ম্যাজিক অস্তমিত প্রায়। মল্লিকার্জুন খাড়গে বয়সের ভারে নু্যব্জ। প্রিয়াঙ্কা গান্ধী ভদরা চিরকালীন ‘দুধভাত’। ফলে রাহুল গান্ধী-ই দলের একমাত্র, যঁার গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু একজন আদর্শিক যোদ্ধা হয়েও, যে উদ্যমী নেতার প্রয়োজন কংগ্রেসের– সেই খাপে তিনি এঁটে উঠছেন না। ফল: কর্নাটকে কংগ্রেসের ল্যাজেগোবরে দশা। লিখছেন রাজদীপ সরদেশাই
রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের প্রতিযোগিতা হলে কংগ্রেসের স্বর্ণপদক প্রায় নিশ্চিত। কেন এমন বলছি! বিস্তারে আসি।
কর্নাটকের হালের ‘নাটক’ বা ‘গেম অফ থ্রোনস’ সপ্তাহের পর সপ্তাহ ধরে সংবাদের শিরোনাম হঁাকাচ্ছে। এই সাম্প্রতিক রাজনৈতিক রঙ্গে মিডিয়ার একটাই মাথাব্যথা– কৌন বনেগা মুখ্যমন্ত্রী– ডি. কে. শিবকুমার (ডিকেএস), না, সিদ্দারামাইয়া (সিদ্দা)। এমনকী, দুই নেতা বৈঠকে বসে কী জলখাবার খেলেন, তা-ও ক্যামেরাবন্দি করতে ব্যস্ত মিডিয়া! উচ্চাকাঙ্ক্ষায় টইটম্বুর রক্তগরম আঞ্চলিক শাসক দল এবং দুর্বল হাইকমান্ড মিলে এমন ঝালঝাল ‘কন্নড় থালি’ তৈরি করতে উন্মুখ, যা পাতে পড়লে মুখে তোলা যাবে কি না সন্দেহ। প্রশ্ন: কংগ্রেসের শেষ দুর্গে অবশিষ্ট যেটুকু দাপট বহাল, তা নিয়ে নাড়াঘঁাটা করে মাটিতে মিশিয়ে দিতে
কারা উঠেপড়ে লাগল?
প্রথমেই শুরু করা যাক, অত্যন্ত দক্ষ ক্ষমতাধরদের দিয়ে। ডিকেএস এবং সিদ্দা হলেন যাকে বলে– জল ও জলপাইয়ের মতো। ডিকেএস একজন অসাধারণ শক্তিধর দলীয় নেতা, সম্পদশালী এবং যারপরনাই উচ্ছৃঙ্খল। তঁার ‘সোয়্যাগ’ খানিকটা বিগ বসের মতো, উচ্চাকাঙ্ক্ষা তিনি গোপনে-গহিনে রাখতে পছন্দ করেন না। নিঃসন্দেহে বিচক্ষণ চুক্তিপ্রণেতা। অন্যদিকে, সিদ্দা হলেন পুরনো ধাতুতে গড়া, তঁার চালচলন স্বভাবতই অনেক বেশি সতর্ক। তিনি বিচক্ষণ ও ধূর্ত।
যেখানে ডিকেএস মনের কথা বলার আগে দু’বার ভাবেন না, সেখানে সিদ্দা এক ও অত্যল্প কথার মানুষ, সাসপেন্স ধরে রাখতে জানেন, ধরে খেলতে পারেন। বিরোধীরা তাই প্রায়ই তঁার স্ট্র্যাটেজি নিয়ে ভ্যাবাচাকা খেয়ে যায়। ডিকেএসের ট্র্যাক রেকর্ড জানান দেয়, তঁার দলীয় আনুগত্য কতখানি দৃঢ় এবং তা কত দূর সাংগঠনিক সাফল্যের ইঙ্গিতবাহী। পিছড়েবর্গ, দলিত ও মুসলমান– তিন গোষ্ঠীর গণনেতা হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে পারা– তঁার দীর্ঘ দিনের রণকৌশলের পরিণতি।
‘আদর্শ আবহ’ গড়ে তুলতে পারলে হয়তো কংগ্রেসের এই দুই মহীরূহকে একমঞ্চে সৌহার্দপূর্ণ পরিবেশে দেখা যেতে পারত। কিন্তু পোকা-কাটা ‘গ্র্যান্ড ওল্ড পার্টি’-র এখন সময় ভাল নয়, ক্ষমতার জন্য এক সময়ের অপরিমেয় খিদে এবং তদ্বজনিত সংঘাত দলের ভিতে ঘুণপোকা ডেকে এনেছে অনেক আগেই। একটি উদাহরণ টানা যাক। আড়াই বছরের জন্য দুই পাক্ষিক মুখ্যমন্ত্রীর কথাটাই ধরুন। এমন ঘটনা শুধু অদ্ভুত নয়, ভারতীয় প্রেক্ষাপটে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অকার্যকর। আমাদের দেশে কেউ স্বেচ্ছায় ‘কুর্সি’ ছাড়ে না। সিদ্দার আড়াই বছরের শাসনের পর যদি কংগ্রেস নেতৃত্ব ডিকেএস-কে মুখ্যমন্ত্রিবের প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকে, তবে তারা স্পষ্টত এই নীতি দ্বারা চালিত হয়েছিল যে– লজ্জা, ঘেন্না, ভয় তিন থাকতে নয়। রাজস্থানে এই পালা করে ফিরে আসা করতে গিয়েই মুখ্যমন্ত্রিত্বের ট্রেন্ড মুখ থুবড়ে পড়েছিল তীব্র ক্ষোভ ও বিদ্রোহের ফলে, ছত্তিশগড়েও শেষ পর্যায়ে অন্তর্ঘাত করা হল, কর্নাটকেও যে পুনরাবৃত্তি ঘটত না– বলা যায়?
আসল সমস্যা হল, তথাকথিত কংগ্রেসের ‘হাইকমান্ড’ কঠিন সময়ে প্রয়োজনীয় ও দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিতে অনিচ্ছুক বা অক্ষম। ২০২৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে কংগ্রেসের ‘পুনরুজ্জীবন’, অথবা সম্ভবত টিকে থাকার যে-সম্ভাবনা তৈরি হয়, সেই কর্মকাণ্ডের কান্ডারি রাহুল গান্ধী শুধুমাত্র শুকনো শুভেচ্ছা কুড়িয়েছিলেন এমন নয়, দলীয় কর্মীদের থেকেও সম্মানও অর্জন করেছিলেন। সংবিধানের একটি কপি হাতে নিয়ে, তিনি যেভাবে বিজেপির ‘জাদুকর’-কে চ্যালেঞ্জ করার জন্য সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে। বিরোধীরা তঁাকে নিয়ে উপহাস করলেও কংগ্রেসের অন্দরে–সংঘ পরিবারের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য রাহুলের অটল সংকল্প– দলের প্রশ্নাতীত নেতা রূপে দৃঢ়প্রতিষ্ঠা দেয় তঁাকে। কিন্তু দলীয় সংগঠনের মধ্যে একজন কার্যকর রাজনীতিবিদ হিসাবে তঁার অধিকার প্রয়োগের পরিবর্তে, রাহুল তঁার অনুগত ও অনুরক্ত কে. সি. বেণুগোপালের দ্বারস্থ হলেন– নানাবিধ জটিল সাংগঠনিক বিষয় আউটসোর্স করার জন্য। যে বেণুগোপাল হালে কংগ্রেসের ‘সিস্টেম’-এর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ শক্তিশালী ব্যক্তি।
ফলে দেখা গেল, ২০২৪ সালের সাফল্যের নটেগাছ অচিরেই মুড়িয়ে গেল। হাতেনাতে ফল, অতি আত্মবিশ্বাসে হরিয়ানায় হার। একদিকে নির্বাচনের ঠিক আগে মহারাষ্ট্রকে বিজেপি কার্যত ‘কিনে’ নিল– নগদ থেকে মহিলা হস্তান্তর– কিছুই বাকি রইল না নির্বাচনী প্রচারে।
অপর দিকে, দিল্লি ও বিহারে কংগ্রেসের প্রচারে সে কী ঢিমেতাল! এক এক রাজে্য ধারাবাহিকভাবে হারের পর, কংগ্রেসের ‘হাইকমান্ড’ যেন কঠিন রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে আরও বেশি অনিচ্ছুক হয়ে পড়ল, যেন মনে হল নরসিমা রাওয়ের মতো– ‘রাজনীতিতে কখনও কখনও সিদ্ধান্ত না নেওয়াই সেরা সিদ্ধান্ত’– এই পুরনো নীতির একনিষ্ঠ অনুসারী তারা!
আদতেই কংগ্রেসের অন্দরে ‘হাইকমান্ড’ কে বা কারা, তাও নিশ্চিত করে বলে যাচ্ছে না, কারণ দলে না আছে ‘উচ্চতা’ না আছে ‘দাপট’। নিশ্চিতভাবেই সোনিয়া গান্ধী এখন আর ‘হাইকমান্ড’ নন কারণ তিনি ইতিমধে্যই আধা-অবসরপ্রাপ্ত; দ্বিতীয় ব্যক্তি– মল্লিকার্জুন খাড়গে হতে পারতেন, কিন্তু বয়সের ভারে তঁারও আর নৌকা বাইবার সামর্থ্য নেই; প্রিয়াঙ্কা গান্ধী ভদরাও নন, কারণ তিনি চিরকালীন ‘দুধভাত’– তঁাকে দলের নির্দিষ্ট দায়িত্বই কখনওই দেওয়া হয়নি। ফলে রাহুল গান্ধীই একমাত্র কংগ্রেস নেতা, যঁার গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু এ-যাবৎ তঁার মতিগতি দেখে মনে হচ্ছে, তিনি একজন আদর্শিক যোদ্ধা বটে, কিন্তু ধুঁকতে থাকা সংগঠনকে চাগিয়ে তোলার মতো দম তঁার নেই। যে উদ্যমী নেতার প্রয়োজন কংগ্রেসের এই মুহূর্তে, সেই খাপে রাহুল চেয়েও অঁাটছেন না।
ফলে আবার চোখ রাখতে হবে কংগ্রেসের কর্নাটক ধঁাধার দিকে। সত্যি বলতে, কংগ্রেসের কাছে সহজ কোনও ‘বিকল্প’ খোলা নেই। সিদ্দারামাইয়া এখনও বেশিরভাগ বিধায়কের সমর্থন আগলে বসে আছেন এবং নিজের ‘ওবিসি’ স্টেটাস কাজে লাগিয়ে কংগ্রেসের পিছিয়ে পড়াদের ক্ষমতায়নের প্রধান মুখ। ডিকেএস এখন ৬৩ বছরের সিনিয়র সিটিজেন, তবে তঁার একমাত্র নিকট প্রতিদ্বন্ধীর থেকে বয়সের ফারাকে ১৪ বছরের ছোট। স্বাভাবিকভাবেই তিনি তুলনায় বেশি উদ্যমী। যদি সিদ্দা এবারও জিতে যান, তাহলে পরের বছরের শুরুতে তিনিই হবেন কর্নাটকের এ যাবৎকালীন দীর্ঘস্থায়ী মুখ্যমন্ত্রী। তঁার জায়গায় ডিকেএসের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার অর্থ– বৃদ্ধতন্ত্রের বদলে নবীন প্রজন্মের উত্তরাধিকার-সহ দীর্ঘলালিত রাজনীতির আঙ্গিকে কংগ্রেসের পদোন্নতি ও পরিবর্তন– কারণ তারা এত কাল প্রবীণ নেতাদের ‘মার্গদর্শক মণ্ডল’-এ পাঠাতে অনিচ্ছুক মনোভাবই প্রকাশ করে এসেছে। প্রসঙ্গত বলে রাখি– এর আগে মধ্যপ্রদেশ ও রাজস্থানে, কংগ্রেস প্রজন্মগত পরিবর্তনের ধারণায় বদল আনার ক্ষেত্রে বিরক্তি প্রকাশ করার ফলেই জঘন্যভাবে হেরে যায়। এবারও কর্নাটক আর-একটি সুযোগ করে দিচ্ছে পালাবদলের– এমন ভাবার কোনও কারণ নেই যে, সিদ্দারামাইয়া সহজেই ক্ষমতার লোভ ছেড়ে নির্বাসন নেবেন– এত অপক্ব রাজনীতিক তিনি নন।
যদিও জল্পনা, ২০২৭ সালে মসৃণ ক্ষমতা হস্তান্তরের আভাস পাওয়া যাচ্ছে, তবু একটি প্রশ্ন রয়ে যায়– এই যুদ্ধবিরতি কত দিন স্থায়ী হবে? বিজেপি রাতারাতি গুজরাতের মন্ত্রীদের পদত্যাগ করতে বাধ্য করে কোনও মতবিরোধ ছাড়াই পার পেয়ে যেতে পারে। এর কারণ ভারতীয় রাজনীতির আসল ‘হাইকমান্ড’– ৭ লোক কল্যাণ মার্গ এবং ৬এ কৃষ্ণ মেনন মার্গ থেকে ছড়ি ঘোরান এবং দেশের তামাম গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত সেখান থেকেই নেওয়া হয়। কংগ্রেসের কাছে গুজরাতের ‘একনম্বর জোড়ি’-র মতো কেউ নেই– যঁারা প্রায় প্রতিটি বিষয়ে তঁাদের মতামত দিতে সক্ষম। বেশ কয়েকটি বিজেপিশাসিত রাজ্যে, বিশেষ করে গোয়ায়, তীব্র ক্ষমতার দ্বন্দ্ব বহাল, কিন্তু শাসক দলের মধ্যে ‘ভয়ের বাতাবরণ’-এর দাপটে কারণে কোনও নেতাই প্রকাশ্যে টুঁ শব্দ করতে সাহস পান না। অন্যদিকে, কংগ্রেসের অন্দর গড়ের মাঠ– প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের ভয় ছাড়াই সমস্ত দলীয় নেতা খুল্লমখুল্লা দলের নামে খিস্তিখেউরে মেতে। ‘হাইকমান্ড’ দুর্বল বা বলা ভাল নিরুদ্দেশ হলে রাজনৈতিক মহলে এমন ‘সিন’ তো অবশ্যম্ভাবী। কর্নাটক যদিও দেখিয়েছে– ‘প্রতে্যকে আমরা নিজের তরে’– অর্থাৎ,
যোগ্যতমই টিকে থাকবে।
পুনশ্চ: ইতিহাসপ্রেমীদের মনে রাখা প্রয়োজন, কর্নাটকে কংগ্রেসের পতন শুরু হয় আটের দশকের গোড়ার দিকে। তৎকালীন জননেতা, দেবরাজ উরসকে রাজকীয় চালে ক্ষমতাচ্যুত করেন সঞ্জয় গান্ধী। কাকার মতোই রাহুল গান্ধী ‘শিরচ্ছেদ’ করার নির্মম ক্ষমতার রাজনীতিতে বিশ্বাস করেন না। সম্ভবত, এ-ই তঁার শক্তি, এবং এ-ই তঁার দুর্বলতা।
