গিজগিজ করছে কাশ্মীর। শ্রীনগরে কাশ্মীরির চেয়ে বাংলা শোনা যাচ্ছে বেশি। প্রতি একশো গজে বন্দুকধারী কেন্দ্রীয় বাহিনী। দূরে দূরে সিআরপিএফের ক্যান্টার। কাশ্মীর শান্ত তো? লিখছেন স্যমন্তক ঘোষ।
‘এটিএম কোথায় আছে বলতে পারেন?’
পর্যটকসুলভ প্রশ্নে জলপাই হেলমেটের নিচের চোখ দুটো গাড়ির হেডলাইটের মতো দপ করে জ্বলে উঠল। উত্তর এল অন্তত মিনিট দেড়েক পরে। হাতের ইশারা ততক্ষণে বুঝিয়ে দিয়েছে– রাস্তার ধারে অপেক্ষা করতে হবে।
গিজগিজ করছে কাশ্মীর (Jammu and Kashmir)। শ্রীনগরে কাশ্মীরির চেয়ে বাংলা শোনা যাচ্ছে বেশি। ৫০০ টাকার হোটেল-ঘর বিক্রি হচ্ছে দু’-হাজারে। ডালের হাউসবোটে পঁাচফোড়নের গন্ধ। স্থানীয় গাড়িচালকেরা প্রয়োজন ছাড়া যেতে চাইছেন না। একবার জ্যামে ফঁাসলে সারা দিনের মতো গ্যারাজ। এরই মধ্যে রমজান। ব্যাজার মুখে পর্যটকদের খিদে মেটাচ্ছেন দোকানদারেরা। মাঝে মাঝে রাস্তার ধারে থুতু ফেলছেন তঁারা। রোজায় থুতু গেলাও অনুচিত! মসজিদের লাউড স্পিকার সবই রাস্তামুখী। আজানের সময় শ্রীনগরকে হঠাৎ
দুবাই মনে হয়।
বাম নেতা তারিগামির অবশ্য এই কাশ্মীরকে কখনও কখনও তিহারের মতো মনে হয়। এখনও। প্রতি একশো গজে বন্দুকধারী কেন্দ্রীয় বাহিনী। আরেকটু দূরে দূরে সিআরপিএফের ক্যান্টার। বিভিন্ন জায়গায় কঁাটা লাগানো তার ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে রাস্তার উপর পাতা। সিআরপিএফের হাতে অটোমেটিক রাইফেল, ইনসাস, একে সিরিজ। মুখে বঁাশি। তঁারা-ই যান নিয়ন্ত্রণ করছেন।
এ-ও এক বিস্ময়কর দৃশ্য! কান ফাটিয়ে টুরিস্ট গাড়িতে বাজছে ভক্তিমূলক ভজন, অথবা ইয়ো ইয়ো হানি সিং। রাস্তার মোড়ে হাত তুলে দঁাড়িয়ে স্থানীয় মানুষ। গাড়ি থেকে নামিয়ে তঁাদের তল্লাশি চলছে। ‘টুরিস্ট গাড়ি’ মানে ইন্ডিকেটর জ্বলবে। আর, গাড়িতে পর্যটক থাকলে তল্লাশি মাফ।
রাস্তার ধারে ইফতারের কাটা ফল, শেকলের মতো দেখতে শিক কাবাব। রাস্তায় খন্দ। জমানো ময়লা। দু’-একজন ভিখিরি। খানচারেক কুকুর। একটা ষঁাড় এবং ক্যামোফ্লাজ বাঙ্কার। ১৪ কেজির বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট পরিহিত একজন জওয়ানের বুকের কাছ থেকে উঁকি মারছে অতিরিক্ত ম্যাগাজিন। পর্যটকসুলভ সাংবাদিককে তিনি-ই একমিনিট ধরে দঁাড় করিয়ে রেখেছেন রাস্তার ধারে। ফলে, পিঠে ব্যাগ নিয়ে পর্যবেক্ষণ ছাড়া আপাতত আর কোনও কাজ নেই। অবশেষে ছেলেটি এল। মানে, জওয়ান।
মেরে-কেটে বছর তিরিশ বয়স। জলপাই উর্দিতে মোড়া শরীর। পায়ে হান্টার। হাতের রাইফেলের মুখ রাস্তার দিকে। তর্জনী ট্রিগারে ঠেকানো। মুখের চামড়া পুড়তে পুড়তে সস্তার মেক-আপের মতো আস্তরণ তৈরি করেছে। স্কেলে মাপা গোঁফ। জবানে বাংলা। সম্ভবত, বাঙালি দেখেই জওয়ানটি অপেক্ষা করতে বলেছিল পর্যটকসুলভ সাংবাদিককে। অভিজ্ঞতা বলছে, সচরাচর সাধারণ মানুষের সঙ্গে খুব প্রয়োজন না-হলে কথা বলেন না এই জওয়ানেরা।
‘এটিএম খুঁজছেন?’– বাংলায় উত্তুরে টান, জানা গেল ছেলেটি মালদার– ‘সামনে বঁাদিকের গলি দিয়ে ঢুকে, তিনটে দোকান ছেড়ে ডানদিকে চতুর্থ বাড়ি।’ ছেলেটি যখন কথাগুলি বলছে, হাতের তর্জনী ট্রিগার থেকে সরে গিয়েছে। পান সিং তোমারের মতো আঙুল ঘুরল দিকনির্দেশের সূত্র ধরে। চোখের মণি দুটো এতক্ষণ যতটা রুক্ষ ছিল, আচমকা তাতে গুণগত পরিবর্তন এসেছে। একটু প্রেম। কিছুটা হাহাকার। খানিকটা ক্ষোভ। অনেকটা গঙ্গায় ভেঙে পড়া পাড়ের মতো। ঠিক এই সময়েই যে জওয়ানের ডিউটি ভাঙবে। ঠিক এই সময়েই যে কাশ্মীর ভ্যালিতে একজন মেন ল্যান্ড সিভিলিয়ন এবং একজন লৌহজওয়ান কেবলমাত্র ভাষাতুতো স্বার্থে ভাই-ভাই ভাব দেখাবে, একে-অপরের সাহচর্য খুঁজবে, টুপি-ঢাকা কপালেরও তা জানা ছিল না!
২০১৯ সালের অাগস্টের প্রথম সপ্তাহে দিল্লি যখন কাশ্মীর থেকে ৩৭০ ধারা অবলুপ্তির ঘোষণা করল, কাশ্মীরে তখন ফোন নেটওয়ার্ক বন্ধ। বন্ধ ইন্টারনেট। ভ্যালি-জুড়ে কারফিউ। নেতারা অধিকাংশ গৃহবন্দি। হাজারেরও বেশি রাজনৈতিক কর্মীকে জেলে ভরে দেওয়া হয়েছে। খবরের কাগজ প্রকাশিত হচ্ছে না। বন্ধ পোর্টালের অফিস। দোকান খুলছে ঘড়ি ধরে। ঠিক এই সময়েই উপত্যকা-জুড়ে নিরাপত্তারক্ষীর সংখ্যাও বাড়িয়ে দেওয়া হয় কয়েকগুণ। মালদার এই বাঙালি জওয়ান, দিল্লির ক্যাম্প থেকে রাতারাতি বদলি হয় শ্রীনগরে। খানিক আগে সাংবাদিককে যে-এটিএমের সন্ধান দিয়েছিল, সে-ই এটিএমের ঠিক বাইরে টানা চার মাস ডিউটি করেছে। প্রতিদিন ১০ ঘণ্টার অতন্দ্র প্রহরা। শ্রীনগরে আসার মাত্র একমাস আগে বিয়ে হয় তার। বিয়ের সময় দীর্ঘদিনের বান্ধবীকে এই ফৌজি কথা দিয়েছিল, মাস কয়েকের মধ্যে দিল্লি নিয়ে যাবে। কিন্তু তার আগেই আচমকা কাশ্মীর!
আমার সঙ্গে ছিল ফোটোগ্রাফার সহকর্মী রাউফ। সে বলেছিল, কাশ্মীরে ৩৭০ অনুচ্ছেদ অবলুপ্তির পরের সময়টায় দিল্লিতে তার মন বসত না কিছুতেই। সোপিয়ানে বাবা-মা কেমন আছে, বোনের কলেজ কবে খুলবে, চাচির ডায়েলিসিস হচ্ছে কি? কোনও খবরই পাওয়া যেত না তখন। দিল্লির কাশ্মীরী সম্প্রদায় তখন একে-অপরের কঁাধ ছুঁয়ে বেঁচে আছেন। প্রত্যেকেই সুযোগ খুঁজছেন বাড়ি ফেরার। তারই মধ্যে বন্ধু মারফত খবর আসে রাউফের কাছে– গ্রামে তিনটি নতুন সেনা-ক্যাম্প হয়েছে। তাহলে কি গন্ডগোল শুরু হল? গ্রাম ঘিরে ফেলে প্রত্যেককে বাড়ি থেকে বের করে এনে ঘরে ঘরে সেনা তল্লাশি চলছে না তো? মায়ের কোমরে ব্যথা, সেনা ঘরে ঢুকলে সে-কথা জওয়ানদের বলতে পারবে তো মা?
কথা বলতে বলতে আচমকাই সশব্দে হাসতে শুরু করল রাউফ। কেন? তার মনে পড়ে যায়, এতসব চিন্তা মাথায় নিয়ে ৩৭০ অবলুপ্তির পরে নেটওয়ার্কহীন, ইন্টারনেটহীন উপত্যকায় প্রথম যখন বিমান গিয়ে নামল, রাউফ ছিল সেই বিমানের শেষ আসনের যাত্রী। বিমানের চাকা রানওয়ের অ্যাসফল্ট ছোঁয়ার পর বিমানসেবিকা স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে ঘোষণা করেন, ‘এবার আপনারা মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে পারেন।’ আসলে, অভ্যাসে বলে ফেলেছিলেন। ভুলে গিয়েছিলেন, কাশ্মীর বাকি ভারতের চেয়ে একটু ‘স্পেশাল’!
এমনকী, ৩৭০ অবলুপ্তির পরেও। ‘জওয়ান’ বলেও ছাড় নেই। অফিসার্স মেসে কোথাও কোথাও ইন্টারনেট চালু থাকলেও, সাধারণ সিআরপিএফ জওয়ানদের ফোন ব্যবহারের অনুমতি ছিল না। ডিউটি চলাকালীন তো নয়ই, ক্যাম্পে ফিরে গেলেও টাওয়ার পাওয়া যাবে– এমন নিশ্চয়তা ছিল না। এদিকে, মালদার সেই জওয়ানের সদ্যবিবাহিত স্ত্রী বাড়িতে ছটফট করছে। প্রতিনিয়ত টেলিভিশনের পরদায় চোখ রেখেছে, কাশ্মীরের খবর ট্র্যাক করতে। টেলিভিশন বলছে, শান্তি ফিরেছে ভ্যালিতে। উড়ছে তেরঙা। অথচ শান্ত উপত্যকায় বরকে ফোনে কেন পাওয়া যাবে না মাথায় ঢুকছে না স্ত্রীর। এমনই চলতে চলতে, আচমকা এক চোরা-ফোনে একদিন রফা হল মালদার জওয়ান এবং তার সিভিলিয়ন স্ত্রীর।
বিয়ের পর যে জয়েন্ট অ্যাকাউন্টে নতুন সংসারের টাকা জমাতে শুরু করেছে তারা, সেই এটিএম কার্ড জওয়ানের কাছে, আর ফোন নম্বর দেওয়া আছে স্ত্রীয়ের। অর্থাৎ, জওয়ান টাকা তুললে নোটিফিকেশন যাবে স্ত্রীর কাছে। রফা হল, প্রতিদিন অন্তত একবার এটিএম থেকে টাকা তুলতে হবে জওয়ানকে। ফোনে সেই নোটিফিকেশন অ্যালার্ট ঢুকলে স্ত্রী বুঝতে পারবে, জওয়ান সুস্থ আছে, বেঁচে আছে। পর্যটককে যে এটিএমের দিকনির্দেশ দিয়েছে জওয়ান, তার কাছে তা আসলে জীবনের এক নোটিফিকেশন। টানা চার মাস, প্রতিদিন ওই এটিএম থেকে ১০০ টাকা করে তুলে গিয়েছে স্ত্রীর কাছে বেঁচে থাকার বার্তা পৌঁছে দেওয়ার জন্য।
স্বাভাবিকভাবেই চোখ ছলছল জওয়ান এবং সাংবাদিকেরও। এদিকে, বাঙ্কার থেকে তারস্বরে বঁাশি বাজিয়ে যাচ্ছেন বদলি হয়ে আসা নতুন জওয়ান। একজন পর্যটকের সঙ্গে সহকর্মীকে এতক্ষণ ধরে কথা বলতে দেখে কিছুটা সন্দেহ-ই করছেন তিনি।
হঠাৎ হাতে লাল পতাকা নিয়ে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় রাস্তার মাঝ-বরাবর দঁাড়িয়ে পড়লেন আধা-সামরিক বাহিনীর একাধিক সদস্য। একদিকের গাড়ি বন্ধ করে দেওয়া হল। আটকে দেওয়া হল পথচলতি মানুষদের। রাস্তা পারাপার করা যাবে না। ছোটবেলার স্ট্যাচু খেলার মতো হঠাৎ কেমন সব থমকে গিয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রবল বিক্রমে হুটার বাজিয়ে রাস্তার দখল নিল বিরাট সেনা কনভয়। ট্রাক, জিপ, ক্যান্টারের মাথা থেকে বেরিয়ে আছে উদ্ধত নল।
ততক্ষণে মসজিদে আজান শুরু হয়েছে। ইফতারের সময় সমাগত। এটিএমের পাশের দোকানে সারি-সারি লোভনীয় পেস্ট্রি। দোকানি এতক্ষণ জওয়ানের সঙ্গে দেখেছেন পর্যটকসুলভ সাংবাদিককে। কাশ্মীর এবং বেকারি-সংক্রান্ত তিনটি প্রশ্নের একটিরও জবাব দিলেন না তিনি। কেবল একটি পেস্ট্রি এগিয়ে দিলেন। মুখ খুললে পাছে ‘রাষ্ট্রবিরোধী’ শব্দ শুনে ফেলে সাংবাদিকের শকুনে-কান।
তবে আপাত কানে-চোখে কাশ্মীর শান্ত। শান্তই। স্বাভাবিকের চেয়েও একটু বেশি। হাজার-হাজার পর্যটক। টিউলিপ গার্ডেন। গুলমার্গে গন্ডোলা। পাহেলগামে ঘোড়সওয়ার। গাড়ির সাউন্ডবক্সের গান ‘ঝিলাম রোয়া, কাশ্মীর কে লিয়ে ঝিলাম রোয়া’। ডাল। লিডার। দিকে-দিকে মাংকি ক্যাপ। ইয়ো ইয়ো মধু সিং। মদ। হাউসবোট। মজলিস। চূড়ান্ত মজলিস।
(মতামত নিজস্ব)
লেখক জার্মানির ডি ডব্লিউ সংবাদমাধ্যমের
ফরেন করেসপনডেন্স
abir.peace@gmail.com