সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়: কাল থেকেই ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’-এর ক্যাকোফোনি শুরু হয়ে যাবে। প্রতি বছর যেমন হয়। কিন্তু সম্ভবত এই প্রথম, নতুন বছরের আবাহন-জুড়ে বিসর্জনের বিষণ্ণতা ও আশঙ্কার দোলাচল বহমান! এত মনখারাপ, হতাশা, আতঙ্ক ও অনিশ্চয়তায় ভরা বর্ষবিদায় শেষ কবে হয়েছে জানি না। যা গেল ও যেভাবে গেল– ‘সে বড়ো সুখের সময় নয়, সে বড়ো আনন্দের সময় নয়।’ স্বস্তিরও কি? অবশ্যই নয়। কারও পক্ষেই নয়। রাজনীতির চালচিত্রও তা-ই দেখায়। ‘রাজধানীর হাল’ ও ‘রাজনীতির চাল’ নিয়ে আমার সাপ্তাহিক কারবার। বর্ষশেষের ফিরে দেখায় সেই রাজনীতির রংবদলের রকমফেরে তাই বিস্মিত হই! শাসকের কাছে এই সেদিনও যে-পথ ছিল কুসুমকোমল, বর্ষশেষে সেই পথের বাঁক কণ্টকাকীর্ণ না হলেও অনিশ্চয়তার ঘেরাটোপ যেন উঁকি দিয়ে যাচ্ছে!
[আরও পড়ুন: ভারত-ফ্রান্স যৌথ সামরিক মহড়ায় শক্তিপ্রদর্শন করবে অত্যাধুনিক রাফালে যুদ্ধবিমান]
ঘটনাবহুল ফেব্রুয়ারি-মার্চ স্মরণে আসছে। শাসকের মনপ্রাণজুড়ে তখন ‘নমস্তে
ট্রাম্প’-এর গরিমা। আর তার পাশে শাহিনবাগের দামামা। করোনার বিপদকালীন ঘণ্টি টিংটিং শব্দে বেজে চলেছে, অথচ সরকার নির্বিকার! অত্যাশ্চর্য ঔদাসীন্যের সে এক বিরল উদাহরণ! দিল্লির দাঙ্গা হয়ে উঠেছে ‘রাষ্ট্রদ্রোহী ও গদ্দারদের’ সবক শিখিয়ে ধর্মীয় মেরুকরণের হাতিয়ার। কংগ্রেসকে বেইজ্জত করতে ততদিনে লোকচক্ষুর অন্তরালে জ্যোতিরাদিত্যকে দিয়ে পাকিয়ে তোলা হয়েছে মধ্যপ্রদেশের ঘুঁটি। কমল নাথের ইস্তফার জন্য জিইয়ে রাখা হয়েছে সংসদ।
মার্চে যবনিকা পতন। শিবরাজ সিং চৌহানের পুনরভিষেক, বাজেট অধিবেশনের সমাপ্তি ও ২১ দিনের লকডাউনের মতো একাধিক সিদ্ধান্তের ঘনঘটার মধ্য দিয়ে শুরু হল করোনা-কালের অনিশ্চিত জীবন। টলমল করতে করতে বাঁচার শিক্ষা ক্রমশ সর্বজনীন হয়ে গেল, দেশে ও বিদেশে।বছর শেষের হিসেবনিকেশে হয়তো বা এখন খানিক নির্দ্বিধায় বলা যায়– অভিসম্পাতের পাশাপাশি এ-দেশের শাসকের শিরে করোনা তার আশীর্বাদী হাতও রেখেছে। না-হলে করোনার দোহাই দেখিয়ে এত সহজে আইনসভার চরিত্রকে শাসক গোষ্ঠী বদলে দিতে পারত না। ‘বাড়াবাড়ি রকমের’ গণতন্ত্রের স্থলাভিষিক্ত হয়েছে ‘প্রায়োগিক গণতন্ত্র’। দাতা শাসকের বিবেচনায় যতটুকু প্রয়োজন, গ্রহীতা বিরোধীকুলের কাছে গণতন্ত্রের আস্বাদন আজ ঠিক ততটুকুই! এটাই হয়ে উঠেছে এই জমানার দস্তুর। দ্বিধাগ্রস্ত জটায়ু চিন্তামগ্ন ফেলুদার কাছে প্রশ্ন করার অনুমতি চেয়েছিলেন। পেয়েওছিলেন। সর্বগ্রাসী করোনার দোহাই গণতন্ত্রী ভারতের সাংসদদের সেই অধিকার শুধু নয়, শীতকালীন অধিবেশনটাই হাপিস করে দিল! কৃষকদের আয় দ্বিগুণ করতে এই যে আজ নতুন আইন ঘিরে অসন্তোষের ঢেউ, ‘অশিক্ষিত, মূর্খ ও বিপথগামীরা’ যা বুঝছে না– করোনার করুণাতেই তো তার দিনের আলো দেখা! প্রথমে জুন মাসে অধ্যাদেশের বর্ম পরে, তারপর শাসকীয় নির্দেশে ধ্বনিভোটের নিদানে। বর্গির মতো করোনার হানায় আইনসভার মতো আদালতও তার স্বাভাবিকত্ব হারিয়েছে। শাসক বিচলিত হয় এমন মামলা বিশ বাও জলে। শাসক-বিরোধী জমায়েত হোক, বিক্ষোভ হোক কিংবা বিরোধী নেতাদের নির্ঝঞ্ঝাট রাষ্ট্রপতি ভবন অভিযান– নিষেধের নতুন অজুহাত ও জুজু আজ করোনা। আশীর্বাদ নয়তো কী? কিন্তু ওই যে বললাম, বর্ষশেষের বাঁকে অনিশ্চয়তার ঘেরাটোপের উঁকিঝুঁকি, একঘেয়েমি কাটিয়ে রাজনীতিকে তা আচম্বিতে চনমনে করে তুলেছে। রাজনৈতিক বিধাতার লিখনে কী আছে কে জানে, এটুকু বলা যায়, কাশ্মীর উপাখ্যান গোটা দেশকে নির্বিকল্প পথের সন্ধান দিয়েছে। দেখাতে পেরেছে, সম্মিলিত বিরোধিতার প্রয়োজনীয়তা ও তার সুফল। করোনা-বছরে দিশাহারা বিরোধীদের জন্য এ-ও এক অমূল্য শিক্ষা!
২০১৯-এর ৫ আগস্ট কাশ্মীরের দ্বিখণ্ডন ঘটে। রাজ্য লোপ পেয়ে জন্ম দুই কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের। বিলুপ্ত হয়েছিল সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ। ঠিক তার আগের দিন অশীতিপর ফারুক আবদুল্লার গুপকর রোডের বাসভবনে মিলিত হন জম্মু-কাশ্মীরের সাত রাজনৈতিক দলের নেতা, এতকাল ধরে পারস্পরিক বিরোধিতা অথবা সাহচর্য রাজ্য রাজনীতিতে যাঁদের প্রাসঙ্গিক করে রেখেছিল, আচমকা সর্বহারা হওয়ার আতঙ্কই তাঁদের জোটবদ্ধতার কারণ। ২০১৯-এর ৪ আগস্ট মর্যাদারক্ষার সেই ‘গুপকর ঘোষণা’ বছর দেড়েকের মাথায় হয়ে দাঁড়ায় অস্তিত্বরক্ষার একমাত্র হাতিয়ার। জন্ম হয় ‘পিপল্স অ্যালায়েন্স ফর গুপকর ডিক্লারেশন’ বা ‘গুপকর জোট’। বিজেপির কাছে সেটাই হল মোক্ষম ধাক্কা! জম্মু-কাশ্মীরকে তিন পারিবারিক শাসনের কব্জা থেকে মুক্ত করার প্রতিজ্ঞার কথা প্রধানমন্ত্রী নিজেই শুনিয়েছিলেন। ঘটনাপ্রবাহও সেদিকেই এগোচ্ছিল। গোয়েন্দা রিপোর্টও ছিল অনুকূল। জেলা উন্নয়ন পর্ষদের (ডিডিসি) ভোটগ্রহণের সিদ্ধান্ত তারই ভিত্তিতে। শাসক বিশ্বাস করেছিল, উপত্যকার সব দলই ভোট বয়কট করবে। ফলে তৃণমূল স্তরে ক্ষমতা দখলের পর বিধানসভার দখলও নেবে তারা, ও তাদের মদতপুষ্ট জম্মু-কাশ্মীর আপনি পার্টি। দুনিয়া দেখবে, উপদ্রুত কাশ্মীরে গণতন্ত্রের হাত ধরে স্বাভাবিকতার প্রত্যাবর্তন ঘটেছে। প্রধানমন্ত্রী পালন করেছেন তাঁর দায়িত্ব ও প্রতিশ্রুতি। বিধাতা অন্তরালে বাঁকা হাসি হেসেছিলেন। ভোট বয়কটের রাস্তায় হাঁটল না কেউ। বরং, জোট গড়ে ভোট লড়ল সবাই। ২০ জেলার মধ্যে বিজেপির ভাগে তাই জম্মু ডিভিশনের ৬টি, জোটের দখলে কাশ্মীরের ৯টি জেলা। কংগ্রেসের সাহচর্যে জম্মুর আরও অন্তত তিন জেলাশাসনের সম্ভাবনা জোটের কাছে উজ্জ্বল।
এই ধাক্কা বিজেপি কীভাবে সামলাবে, সেই প্রশ্ন ক্রমেই সংশয়ী ও সন্দিহান করে তুলেছে জোট-নেতৃত্বকে। তাঁরা বুঝছেন, আগামী দিনের সংগ্রাম আরও কঠিন হবে। রাষ্ট্রশক্তির পাশাপাশি মোকাবিলা করতে হবে সংঘ পরিবারের বর্ষপ্রাচীন ‘সাম-দাম-দণ্ড-ভেদ’ নীতির। ভেসে থেকে যোঝার একমাত্র উপায়– জোট অটুট রেখে প্রলোভন ঠেকানো। বর্ষশেষে কাশ্মীর উপাখ্যানের শিক্ষা এটাই। সেই শিক্ষায় ‘মেনল্যান্ড ইন্ডিয়া’-র বিরোধীকুল শিক্ষিত হবে কি না, ’২১-এর আগ্রহও সেটাই। অস্তিত্ব রক্ষা বড় দায়! বিজেপির সম্প্রসারণবাদের ব্লু—প্রিন্ট এখন ‘মমতাময়’। তাদের দিন-রাত একাকার পশ্চিমবঙ্গে। মমতাকে ক্ষমতাচ্যুত করাই একনিষ্ঠ কামনা। নতুন বছর তাদের অভীপ্সা পূর্ণ করলে, তারা নজর দেবে অন্ধ্রপ্রদেশ ও তেলেঙ্গানায়। ওড়িশা দখলের ক্ষেত্রে নবীন-পরবর্তী অধ্যায়ের জন্য অপেক্ষায় রাজি বিজেপি। তারা জানে, বিজয়রথের গতি রোখার মতো নেতৃত্ব, একাগ্রতা ও সাধন কারও নেই। তাদের সামনে হু হু ফাঁকা মাঠ। তা সত্ত্বেও এই প্রথম বিচলিত হওয়ার মতো কিছু প্রধানমন্ত্রীর বলিরেখা গভীর ও গাঢ় করে তুলেছে। মীমাংসার তাগিদ তাই এত তীব্র। গত ছ’-বছরে কোনও কিছুতেই যিনি বিচলিত হননি, ভাবমূর্তি ও ক্যারিশমা যাঁকে বারবার তরিয়ে দিয়েছে, নতুন কৃষি আইন সেই প্রধানমন্ত্রীকে তটস্থ করে রেখেছে। এ এক শাঁখের করাত! আইন বাতিল হলে মুখ পুড়বে সরকারের। বিশ্বাসযোগ্যতা তলানিতে ঠেকবে। গেঁা ধরে বসে থাকলে কৃষক বিক্ষোভ হতে পারে সর্বনাশের হেতু।
কী করবেন প্রধানমন্ত্রী? বছরশেষের সবচেয়ে বড় প্রশ্নবোধক ধাঁধা এটাই। আর বিস্ময়? তার জন্মদাতার নাম রাহুল গান্ধী। দলের প্রতিষ্ঠা দিবসের প্রাক্কালে ইতালি যাত্রার প্রয়োজন যা-ই থাকুক না কেন, তাঁর বিরুদ্ধে তোলা ‘পার্ট-টাইম পলিটিশিয়ান’ প্রচারকে আরও একবার নিজেই মান্যতা দিলেন! শারদ পাওয়ারকে ‘ইউপিএ’-র চেয়ারম্যান করার একটা উদ্যোগ হালকাভাবে শুরু হয়েছে। অসুস্থ সোনিয়ার জায়গায় পঞ্চাশে পা দেওয়া রাহুলের যোগ্যতার প্রশ্নে সেটা আদৌ ভাল বিজ্ঞাপন নয়। কিন্তু রাহুল রয়েছেন নিজের জগতে! নিরুৎসাহী! নিস্তেজ! নির্বিকার! বিজেপির বিজয়রথ থামাতে ‘মেনল্যান্ড ইন্ডিয়া’-য় কাশ্মীরি জোটের রূপায়ণ ও কৃষক বিদ্রোহের পরিণতি নতুন বছরের আগ্রহ হয়ে জেগে থাকল।
(মতামত নিজস্ব)
saumyabandyo@gmail.com