shono
Advertisement

এলআইসি'র ভবিষ্যৎ কোন পথে?

আদানি বিতর্কে জড়িয়ে গিয়ে ‘এলআইসি’-র ভবিষ্যৎ ঘিরে অনিশ্চয়তা বাড়বে বই কমবে না।
Published By: Biswadip DeyPosted: 05:05 PM Jun 10, 2025Updated: 05:05 PM Jun 10, 2025

কয়েক দিন আগে ‘আদানি পোর্টস অ্যান্ড স্পেশাল ইকোনমিক জোন লিমিটেড’-এর পাঁচ হাজার কোটি টাকার বন্ড কিনেছে ‘এলআইসি’। ‘আদানি পোর্টস’-এ ইতিমধ্যেই ৮.০৬ শতাংশ ইক্যুইটি শেয়ার রয়েছে তাদের। রাহুল গান্ধী প্রতিবাদী, এর ফলে আদানি গোষ্ঠী লাভবান হবে বলে তাঁর অভিযোগ। লিখছেন সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায়।

Advertisement

রাষ্ট্রায়ত্ত বিমা সংস্থা ‘এলআইসি’-র লগ্নি নিয়ে রাহুল গান্ধীর কথায় যেন তঁার পিতামহ ফিরোজ গান্ধীর সুর শোনা গেল। গত শতাব্দীর পঁাচের দশকে ফিরোজ গান্ধী ‘এলআইসি’-র কিছু লগ্নি নিয়ে প্রশ্ন তুলে সংসদে সরব হয়েছিলেন। আর এবার, সেই ‘এলআইসি’-র লগ্নি নিয়েই কটাক্ষ করতে দেখা গিয়েছে নাতি রাহুল গান্ধীকে। সেই সময় ফিরোজ ছিলেন শাসক কংগ্রেসেরই সাংসদ, এবং এখন রাহুল কংগ্রেসের সাংসদ হলেও, বিরোধী দলনেতা। তবে বলা বাহুল্য দু’ক্ষেত্রেই পরোক্ষভাবে প্রধানমন্ত্রীদেরই অস্বস্তিতে ফেলতে চেয়েছেন এঁরা, তখন ফিরোজের লক্ষ্য নেহরু সরকার, আর এখন রাহুলের লক্ষ্য মোদি সরকার।

সম্প্রতি সোশ‌্যাল মিডিয়ায় ‘পোস্ট’ করে রাহুলের মন্তব্য– ‘টাকা আপনার, বিমার পলিসি কিনেছেন আপনি, কিস্তিও দিচ্ছেন আপনি। কিন্তু সুরক্ষা, সুবিধা আর মুনাফা সবই আদানির!’ কারণ, দেখা গিয়েছে, কয়েক দিন আগে ‘আদানি পোর্টস অ্যান্ড স্পেশাল ইকোনমিক জোন লিমিটেড’-এর পঁাচ হাজার কোটি টাকার বন্ড কিনেছে ‘এলআইসি’। শেয়ার বাজারে আদানি গোষ্ঠী জানিয়েছে, দেশের মধ্যে, সবচেয়ে বেশি, পঁাচ হাজার কোটি টাকা লগ্নি এসেছে বন্ড থেকে, আর এই ‘নন-কনভার্টিব্‌ল ডিবেঞ্চার’ কিনেছে ‘এলআইসি’। বিনিয়োগের মেয়াদ ১৫ বছর এবং বার্ষিক কুপন রেট ৭.৭৫ শতাংশ। অর্থাৎ দীর্ঘ মেয়াদে বিপুল টাকা আদানির ঘরে গচ্ছিত রেখেছে এই রাষ্ট্রায়ত্ত বিমা সংস্থা। এবারের আদানি গোষ্ঠীর এই লগ্নি-প্রস্তাবে অন্য কোনও সংস্থা সাড়াও দেয়নি, একমাত্র ‘এলআইসি’ অত টাকা খরচ করে তা কিনেছে। ফলে, লগ্নি ঘিরে সন্দেহটা বেড়ে গিয়েছে। ‘আদানি পোর্টস’-এ ইতিমধ্যেই ৮.০৬ শতাংশ ইক্যুইটি শেয়ার রয়েছে ‘এলআইসি’-র। এবার রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাটি, এই শিল্পগোষ্ঠীর সংস্থাটিকে, তার স্বল্পমেয়াদি ঋণের পুনঃঅর্থায়ন, মূলধন ব্যয় তহবিল এবং সাধারণ কর্পোরেট প্রয়োজনীয়তা পূরণে সহায়তা করার জন্য বিনিয়োগ করেছে বলে জানা গিয়েছে। এইভাবে রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের তহবিল নির্বাচিত বেসরকারি সংস্থাগুলিকে সুবিধা করে দেওয়ার জন্য ব্যবহার করা তো উচিত নয়, ফলে উদ্বিগ্ন বিরোধী দলগুলি।

গত শতাব্দীর পঁাচের দশকে ফিরোজ গান্ধী ‘এলআইসি’-র কিছু লগ্নি নিয়ে প্রশ্ন তুলে সংসদে সরব হয়েছিলেন। সেই সময় ফিরোজের নজরে আসে কলকাতা স্টক এক্সচেঞ্জের ফাটকাবাজ হরিদাস মুন্দ্রা কেমনভাবে ভারতীয় জীবনবিমা নিগমে তঁার প্রভাব খাটাচ্ছেন। ফলে তখন ফিরোজ লোকসভা উত্তাল করেন জীবনবিমার লগ্নি নিয়ে। মুন্দ্রার কাজকর্ম নিয়ে সংসদে প্রশ্ন তোলেন। ওই সময় ‘এলআইসি’ মুন্দ্রার ছ’টি দুর্বল সংস্থায় ১.২৪ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে মোটা অঙ্কের লোকসানের মুখে পড়েছিল। ফিরোজ স্বয়ং সোচ্চার হন এভাবে ওই সংস্থার টাকা নয়ছয় হতে দেখে, কারণ তিনি অনুভব করেছিলেন এতে আখেরে বিমা সংস্থাটির সাধারণ পলিসি হোল্ডারদের টাকাই নয়-ছয় হচ্ছিল। শোরগোল ওঠায় অর্থমন্ত্রী কৃষ্ণমাচারি প্রথমে ওই ঘটনা ধামাচাপা দিতে চাইলেও পরে স্বীকার করে নেন, অমন ঘটনা ঘটেছে বলে। এই দুর্নীতি জানাজানি হওয়ার পর সরকার বাধ্য হয় তদন্ত কমিটি গড়তে। তদন্তে এমন কিছু উঠে আসে, যার জেরে শেষমেশ কৃষ্ণমাচারি বাধ্য হন পদত্যাগ করতে এবং হরিদাস মুন্দ্রাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।

এদিকে, এবার এই বন্ডে লগ্নির কারণে আদানি গ্রুপের সঙ্গে ‘এলআইসি’-র বিনিয়োগ নিয়ে বিতর্ক ফের মাথাচাড়া দিচ্ছে। এর আগে হিন্ডেনবার্গ রিপোর্ট বিতর্কের সময় আদানির শেয়ারের দর নেমে যাওয়ায় টাকা খোয়াতে হয়েছিল ‘এলআইসি’-কে। সেই সময় একদিনে, জীবন বিমা নিগমের ৮ হাজার ৭০০ কোটি টাকা লোকসান হয়েছিল আদানি গোষ্ঠীর সাত সংস্থায় শেয়ারের দর নেমে যাওয়ায়। আদানি গোষ্ঠী ঘিরে বিতর্ক ও অনিশ্চয়তা নতুন কিছু নয়। সেখানে স্বাভাবিক কারণেই প্রশ্ন উঠছে: জনগণের টাকা রয়েছে যে-আর্থিক সংস্থায়, সেই ‘এলআইসি’-কে বারবার কেন আদানির সংস্থায় টাকা ঢালতে বাধ্য করা হচ্ছে ?

ঘটনাচক্রে হঠাৎ রকেটের মতো উত্থান দেখা গিয়েছে গৌতম আদানির। আর আদানির এমন ‘ম্যাজিক’ উত্থান ঘটেছে মূলত ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর। বিশ্বের ধনীদের তালিকায় আদানি ৬০৯ নম্বর স্থানে থাকলেও দিল্লিতে মোদি জমানায় ক’-বছরে তিনি একেবারে দ্বিতীয় স্থানে উঠে আসেন। যা দেখে রাহুল গান্ধী জানতে চেয়েছিলেন আদানির সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর মোদির সম্পর্ক কেমন? অভিযোগ করেন, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বন্ধুত্বের সুবাদে রাস্তা, বন্দর, বিমানবন্দর সবকিছুই আদানির নিয়ন্ত্রণে চলে যাচ্ছে। যঁার কোনও দিন বিমানবন্দর চালানোর অভিজ্ঞতা ছিল না, তঁার হাতে একের পর এক বিমানবন্দর তুলে দেওয়া নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন রাহুল। শুধু তা-ই নয় মুম্বই বিমানবন্দর যাদের হাতে ছিল, সিবিআই-ইডি মারফত নানাভাবে তাদের উপর চাপ সৃষ্টি করা হয়। আশ্চর্যের ব্যাপার, তারপর যেই তারা মুম্বই বিমানবন্দরটি আদানিদের হাতে তুলে দিল, তার কিছু দিনের মধ্যেই তদন্তকারী সংস্থাগুলি তাদের ক্লিন চিট দিয়ে দিল।

তবে মোদি-আদানি সম্পর্ক নিয়ে শুধু রাহুল গান্ধীর মতো বিরোধী নেতা-ই সরব হচ্ছেন, এমন নয়। আদানি-মোদির সম্পর্ক নিয়ে ইতিমধ্যে বিজেপির অন্দরে অস্বস্তি রয়েছে। এক সময় প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী তথা বর্ষীয়ান বিজেপি নেতা সুব্রহ্মণ‌্যম স্বামী দাবি তুলেছিলেন, প্রধানমন্ত্রী মোদির উচিত আদানির সমস্ত সম্পত্তি জাতীয়করণ
করে তা নিলামে বিক্রি করা। বলা বাহুল্য সে আওয়াজ দলের অন্দরে জোরালো হয়নি। তবে ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রীর যে-ক্ষমতা ছিল, গত নির্বাচনের পরে আসন সংখ্যার নিরিখে সেই ক্ষমতা অনেকটাই কমে গিয়েছে ঠিকই। তবু মাঝে মাঝে আদানিকে ঘিরে বিতর্ক ফিরে ফিরে আসছে। বিস্ময়ের বিষয় রাষ্ট্রায়ত্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং আদানি গ্রুপের মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে রাজনৈতিক তরজা অব্যাহত থাকার মধ্যেই এই বিনিয়োগ এসেছে, বিশেষ করে ‘এলআইসি’ এবং অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠানের আদানির স্টক এবং বন্ডের এক্সপোজারের বিষয়ে পূর্ববর্তী অভিযোগের পরেও। এমন চললে আদানি বিতর্কে জড়িয়ে গিয়ে ‘এলআইসি’-র ভবিষ্যৎ ঘিরে অনিশ্চয়তা বাড়বে বই কমবে না।

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

হাইলাইটস

Highlights Heading
Advertisement