৫ মার্চ হঠাৎ ফেসবুক, ইনস্টাগ্রামে ছন্দপতন। ডিজিটাল দুনিয়ায় আছড়ে পড়ল সুনামি। নিমেষে বিশ্বজুড়ে চাউর হয়ে গেল ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম আর থ্রেডস ব্যাহত হয়েছে। এর নেপথ্যে কী কারণ? লিখলেন কিংশুক বন্দ্যোপাধ্যায়
একেই বলে বিনা মেঘে বজ্রপাত! ‘ফেসবুক’, ‘ইনস্টাগ্রাম’-এ দিব্যি জমিয়ে চলছিল জামনগরের বিয়েবাড়ি থেকে ভোটের দামামা। আম্বানিদের প্রাসাদে দুনিয়াভর বড়, মেজ, ছোট সেলেবদের লোটাকম্বল নিয়ে আসার লাগাতার রিলের ধারাবিবরণী আমজনতা বিস্ফোরিত নেত্রে দেখছিল। চলছিল সেসব নিয়ে নানা মিম। তার মধ্যেই হঠাৎ ছন্দপতন। ৫ মার্চের ভর সন্ধ্যাবেলা হঠাৎ ফেসবুক আর ইনস্টাগ্রাম-নিবাসীরা দেখল, তাদের সাধের অ্যাকাউন্ট শুধু যে লগ আউট হয়ে গিয়েছে তা-ই নয়, পাসওয়ার্ড দিয়েও ঢুকতে পারছে না তারা।
পরের দু’-ঘণ্টা ডিজিটাল দুনিয়ায় সুনামি আছড়ে পড়ল বললে অত্যুক্তি করা হবে না। নিমেষে বিশ্বজুড়ে চাউর হয়ে গেল ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম আর থ্রেডস ব্যাহত হওয়ার কথা। পরিস্থিতি এমন হল যে, মেটা (ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপ আর থ্রেডস-এর মূল পরিচালন সংস্থা)-র তরফে বিবৃতি দিয়ে আশ্বস্ত করতে হল, যান্ত্রিক ত্রুটির জন্য ব্যাহত পরিষেবা অতি দ্রুত সচল করা হচ্ছে। ঘণ্টা দুই বাদে হলও তা-ই। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, থ্রেডস ফের স্বমহিমায় ফিরে এল। সবাই হইহই করে বলল, ‘অল ইজ ওয়েল।’ যুক্তি হিসাবে বলা হল, ২০২১ সালেও তো ফেসবুকের বিশ্বব্যাপী পরিষেবা ব্যাহত হয়েছিল সাত ঘণ্টা। এবার তো ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া গিয়েছে। তাহলে সমস্যা কোথায়?
[আরও পড়ুন: CAA মুসলিম বিরোধী নয়, ভোটব্যাঙ্ক নিশ্চিত করতে অপপ্রচার, বলছেন শাহ]
কিন্তু তা-ই কি? দুর্যোগ কাটার পরই অতি উৎসাহীদের মিমে ভরল ফেসবুক ওয়াল। বিপত্তির কারণ খুঁজতে গিয়ে অতি উৎসাহীরা জুকারবার্গের জামনগরে নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে আসা থেকে ‘পথের পঁাচালী’-র ইন্দির ঠাকরুণের সেই জিজ্ঞাসার দৃশ্য– সবই এনে ফেলল। ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ এল প্রতিদ্বন্দ্বী মহল থেকেও। ‘এক্স’ (যা আগে ‘টুইটার’ নামে পরিচিত ছিল)-এর কর্ণধার ইলন মাস্কের সঙ্গে জুকারবার্গের আকচাআকচির কথা তো বিশ্বময় লোক জানে। মেটা-য় বিপত্তি হতেই তাই মাস্ক তাঁর এক্স হ্যান্ডেলে জুকারবার্গকে কার্যত ব্যঙ্গ করে লিখলেন, ‘আপনারা আমার ‘পোস্ট’ পড়তে পারছেন মানে ‘এক্স’-এর পরিষেবা ঠিকই আছে।’
বিপত্তির খতিয়ান
বিপত্তির পরিমাণটা কীরকম ছিল? যদিও এ-ব্যাপারে পরিষ্কার কোনও তথ্য মেলেনি, তবে বিভিন্ন সূত্রের খবর, আবিশ্ব সাড়ে ২৪ লক্ষ ফেসবুক অ্যাকাউন্টে সমস্যা হয়েছিল। এর মধ্যে ছিল আমেরিকারই ১৮ লক্ষ অ্যাকাউন্ট। নিউ ইয়র্ক, ফিলাডেলফিয়া, শিকাগো, আটলান্টা, হিউস্টন, ডালাস, সিয়াটেলের মতো মার্কিন শহরে বিপত্তির প্রভাবটা বেশি পড়ে। আদতে, সেদিনটা ছিল ১৫টি মার্কিন রাজ্যে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রাথমিক ভোটের দিন ছিল। হঠাৎ ফেসবুক বন্ধ হওয়ায় অনেক ভোটারই অথৈ জলে পড়েন। কারণ তাদের একে-অপরের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুক মেসেঞ্জার। এ-বাদে ব্রিটেন, জার্মানি, দক্ষিণ আফ্রিকা আর সিঙ্গাপুরের গ্রাহকরাও বেশ সমস্যায় পড়েন।
[আরও পড়ুন: ‘এক দেশ, এক ভোট’, রাষ্ট্রপতির কাছে ১৮ হাজার পাতার রিপোর্ট জমা দিল কোবিন্দ কমিটি]
স্বাভাবিকভাবেই ভারতেও এই বিপত্তির প্রভাব পড়ে। পরিসংখ্যান বলছে, সাড়ে ৩ লক্ষ ইনস্টাগ্রাম আর ৩ লক্ষ ৫২ হাজার ফেসবুক অ্যাকাউন্টে পরিষেবা ব্যাহত হয়। কলকাতা, মুম্বই, বেঙ্গালুরু, দিল্লি, হায়দরাবাদের মতো মহানগরীতেই পরিষেবা মূলত ব্যাহত হয়।
বিশেষজ্ঞরা অবশ্য এটাকে শুধুমাত্র প্রযুক্তিগত গোলযোগ হিসাবে মানতে নারাজ। তঁাদের মতে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন অতিকায় প্রযুক্তি সংস্থাগুলোর জন্য ডিজিটাল মার্কেট আইন এনেছে। এই আইন মানার সময়সীমা ছিল ওদিনই। ফলে, বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, সময়সীমার ভিতর নয়া আইন মেনে সফটওয়্যার ঠিকঠাক করতে গিয়েই তাড়াহুড়োতে কোডিংয়ে ভুল হয়। যার ফল এই ঘণ্টা দুয়েকের ব্যাহত পরিষেবা।
কিন্তু সবটা বোধহয় এত সহজে মিটে যায়নি। ব্লুমবার্গ বিলিওনেয়ার ইনডেক্স জানাচ্ছে, এই ঘণ্টাদুয়েকের বিপত্তিতে মেটা-র শেয়ারের দাম ১.৬ শতাংশ পড়ে যায়। যার জেরে মেটা কর্ণধার মার্ক জুকারবার্গের প্রায় ১০ কোটি ডলার ক্ষতি হয়েছে। অবশ্য তাতেও ১৭ হাজার ৬০০ কোটি ডলারের সম্পত্তি নিয়ে বিশ্বের ধনকুবেরদের তালিকায় জুকারবার্গ রয়েছেন চতুর্থ স্থানে।
এ তো গেল জুকারবার্গের নিজস্ব ক্ষতির খতিয়ান! কিন্তু এই বিপত্তির সময় ‘মেটা’-র বিজ্ঞাপন পরিষেবাও তো ব্যাহত হয়েছে। ক্ষতির পরিমাণ ঠিক কত, তা এক্ষুনি না বলা গেলেও ওয়াকিবহাল একটা হিসেব করেছে। ২০২০ সালে ফেসবুক-এর (তখন মেটা ছিল না) বিজ্ঞাপন বাবদ আয় ছিল ৮৪২০ কোটি ডলার। সেই হিসেবমতো মিনিট পিছু মেটা-র আয় হতে পারে ১ লক্ষ ৬০ হাজার ডলার। অর্থাৎ ঘণ্টা দুয়েকের বিঘ্নে মেটা-র ১৯ লক্ষ ২০ হাজার ডলার লোকসানের সম্ভাবনা।
এসব তো গেল আর্থিক ক্ষতির খতিয়ান। কিন্তু এই বিপর্যয়ের অন্য প্রভাব কেমন? ফেসবুক মেসেঞ্জার ব্যাপকভাবে অনলাইন যোগাযোগের মাধ্যম হিসাবেও ব্যবহৃত হয়। বিশেষত, হোয়াটসঅ্যাপের মতো ব্যবহারকারীর ফোন নম্বর এতে লাগে না। ফলে, আপাতভাবে অপরিচিতের সঙ্গেও যথেষ্ট গোপনীয়তা বজায় রেখে চ্যাট করা যায়। এখন তো মেসেঞ্জারে ভিডিও চ্যাটও করা সম্ভব। ফলে মেসেঞ্জার যে জনপ্রিয়তা পাবে, তাতে আর আশ্চর্য কী? ২০২২ সালের পরিসংখ্যান বলছে প্রতি ঘণ্টায় মেসেঞ্জারে গড়ে ৫৯ কোটি বার্তা যায়। অর্থাৎ, এর থেকে সহজেই অনুমেয়, ফেসবুক পরিষেবা ব্যাহত হলে বিপুল পরিমাণ অনলাইন যোগাযোগও ব্যাহত হতে পারে।
তবে এই সুবিধা যাতে জঙ্গিদের হাতে না পড়ে তার জন্যও সচেষ্ট হয়েছে মেটা। সূত্রের খবর হাজারচারেক জঙ্গি ও জঙ্গিগোষ্ঠীর নামে ‘ডেঞ্জারাস অর্গানাইজেশনস অ্যান্ড ইন্ডিভিজুয়ালস’ নামে কালো তালিকা রয়েছে সংস্থার কাছে। ২০২১ সালে এক মিডিয়া রিপোর্ট অনুসারে, এই ধরনের কড়াকড়ি আর নিরাপত্তা বাহিনীর নজরদারির জেরেই সম্ভবত মেসেঞ্জার আর হোয়াটসঅ্যাপে ঢুকতে পাক-জঙ্গিরা ভয় পাচ্ছে। আপাতত প্লে-স্টোর থেকে ডাউনলোড করা যোগাযোগ অ্যাপ-ই এদের ভরসা। তাই বিশেষজ্ঞদের মতে, তাই এই বিপত্তিতে এদের যোগাযোগ ব্যবস্থার উপর তেমন প্রভাব পড়বে বলে মনে হয় না।
তবে প্রভাব পড়তে পারে সার্ভার সমন্বয়ে। অদূর ভবিষ্যতে এই ধরনের বিপত্তিতে যাতে সংস্থার সব ক’টি পরিষেবা একসঙ্গে ব্যাহত না হয় তার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে। এছাড়া একাধিক ভৌগোলিক সার্ভারের ব্যবস্থা করা যেতে পারে বিশ্বময় পরিষেবার জন্য কেন্দ্রীয় সার্ভার না-রেখে।
২০১০-এর হলিউড ছবি ‘দ্য সোশ্যাল নেটওয়ার্ক’-এর কথা মনে পড়ে? ফেসবুকের জন্মকাহিনি নিয়ে ২০০৯ সালে প্রকাশিত মার্কিন লেখক বেন মেজরিচের ‘দ্য অ্যাক্সিডেন্টাল বিলিয়েনেয়ারস’ অবলম্বনে ডেভিড ফিঞ্চার পরিচালিত এই ছবিতে মার্ক জুকারবার্গের ভূমিকার অভিনয় করেন জে. সি. আইজেনবার্গ। সেই পর্দার জুকারবার্গকে এক দৃশ্যে চিৎকার করে বলতে শোনা যায়, ‘উই ডোন্ট ক্রাশ এভার।’এই ডায়লগ কি আর চলে?
(মতামত নিজস্ব)