পল্লবিত হল রামমন্দির। শ্রীরাম যুক্ত হলেন রাষ্ট্রনির্মাণের সঙ্গে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দেখাতে চাইলেন, এটা বিজেপির ক্ষুদ্র রাজনীতি নয়। ভালো স্ক্রিপ্টের উপর যেমন ছবির ভাগ্য নির্ভরশীল, তেমনই এই উৎসব নিতান্তই দলীয় ইভেন্ট নয়, সমগ্র ভারতের ভবিষ্যৎ এরই মাঝে নিহিত। লিখছেন জয়ন্ত ঘোষাল।
আরম্ভের আগেও একটা আরম্ভ থাকে। ২০২৪ সালের ২২ জানুয়ারি বালক রামের প্রাণপ্রতিষ্ঠার জাতীয় উৎসব অনুষ্ঠিত হল। কিন্তু এই অাখ্যানের শুরু ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। যেদিন প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি নৃপেন মিশ্রকে নরেন্দ্র মোদি (PM Modi) তঁার সচিবালয় থেকে সরিয়ে অযোধ্যা মন্দির নির্মাণ কমিটির চেয়ারম্যান করে উত্তরপ্রদেশ পাঠিয়ে দেন।
তিনি ১৯৬৭ সালের আইএএস অফিসার। উত্তরপ্রদেশ ক্যাডার। বয়স ৭৮। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা। লখনউতে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কাজ করেছেন, প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ আস্থাভাজন। অযোধ্যায় গিয়েই রামলালার মন্দির নির্মাণ, নগরীর উন্নয়ন, বিমানবন্দর নির্মাণের কাজে মনোনিবেশে করেন। ২০১৮ সালে এলাহাবাদের নতুন নাম হয় ‘প্রয়াগরাজ’, তার ঠিক ২১ দিনের মধে্য যোগী আদিত্যনাথ ফৈজাবাদের নামকরণ করেন ‘অযোধ্যা’। ২০১৯ সালের নভেম্বর মাসে সুপ্রিম কোর্ট ১০৪৫ পৃষ্ঠার রায়ে মন্দির নির্মাণের অনুমতি দেয়। তারপর শুরু হয় যুদ্ধকালীন তৎপরতা।
[আরও পড়ুন: অফিসের স্ট্রেস থেকেই রাজ্যে বাড়ছে সন্ধ্যার পথদুর্ঘটনা! সমীক্ষায় এল চাঞ্চল্যকর তথ্য]
মানতেই হবে, বিরোধীরা জানত রামমন্দির (Ram Mandir) নির্মাণকে একটি মস্ত বড় ইসু্য করেই মোদি এবার ভোটে যাবেন। কিন্তু কীভাবে, কোন উচ্চতায় তিনি এই অনুষ্ঠানকে নিয়ে যেতে পারেন, তা কেউ ভাবতে পারেনি। পূর্ব পরিকল্পিত স্ক্রিপ্ট, কিন্তু মেগা ইভেন্টে কী-কী হবে তার অনেকটাই শেষ পর্যন্ত ছিল গোপন। দেখা গেল, এই অনুষ্ঠানটি বহু ভারতীয় হিন্দুর আবেগের বিষয় শুধু নয়, ভোটের আগে এটি ‘মোদি মুহূর্ত’-ও বটে। মোদি নিজেই বলছেন, এই প্রাণপ্রতিষ্ঠার পর এক ‘নয়া কালচক্র’ শুরু হতে চলেছে। রাম ফিরে এসেছেন। অর্থাৎ, এবার ‘রামরাজ্য’ প্রতিষ্ঠা হবে।
গর্ভগৃহ থেকে বেরিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন– ‘এখনও আমার শরীর স্পন্দিত, ওই মুহূর্তটির মধে্যই আমার চিত্ত লীন। আমি এক ঐশ্বরিক চেতনার সাক্ষী। তাই কণ্ঠ অবরুদ্ধ।’ আর, অবরুদ্ধ কণ্ঠেই তিনি এক দীর্ঘ ভাষণে বলেন, রাম-রেখা অনুসরণ করার কথা। যেখানে আদিবাসী অন্ত্যজ মা শবরীর মতো আমাদের প্রতীক্ষা শেষ, রাম এসে গিয়েছেন, আর অন্যদিকে এই সাফল্যর সঙ্গে ভারতের বিকাশের সাফল্যকেও যুক্ত করা হচ্ছে। ১৫ লাখ কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম করে ‘মিশন আদিত্য’-র সুবাদে আমরা সূর্যের কাছাকাছি। ‘আসমান’, ‘তেজস’, ‘সাগর’, ‘ভিক্রান্ত’ ভারতের গর্ব।
[আরও পড়ুন: রেললাইনেই স্টোভ জ্বালিয়ে রান্না, চলছে পড়াশোনা! ভাইরাল ভিডিও ঘিরে বিতর্ক তুঙ্গে]
মোদি একইসঙ্গে ধর্মীয়, নৈতিক ও রাজনৈতিক কর্তৃত্ব হয়ে উঠতে চাইছেন। যেন-বা ‘রাষ্ট্রগুরু’। সমগ্র দেশের মানুষের প্রতিনিধি হয়ে গর্ভগৃহে প্রভু রামের প্রাণপ্রতিষ্ঠা করে অবসান ঘটিয়েছেন বিতর্কের। ‘রাম’-কে সামনে রেখে মোদি সনাতন হিন্দু ধর্মকে নতুন করে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছেন। ভারতের ইতিহাসে আর কোনও ধর্মকেও এভাবে ‘রিক্লেম’ বা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার প্রয়াস পরিদর্শিত হয়নি। কিন্তু মোদির নেতৃত্বে সুকৌশলে ৩০৩টি আসনের সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ‘রাম-আইকনবাদ’ পৃথিবীর সামনে প্রতিষ্ঠিত করল। এক ধরনের রাজনৈতিক ‘ভ্যাটিক্যানাইজেশন’ সাঙ্গ হল বলা যায়।
প্রধানমন্ত্রীকে প্রথমে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল যে, প্রাণপ্রতিষ্ঠার পর তিনি পূজারি হিসাবে প্রথম গর্ভগৃহে প্রবেশ করবেন। কিন্তু তিনি স্বয়ং প্রাণপ্রতিষ্ঠা করার ইচ্ছাপ্রকাশ করেন পূজারি হিসাবে। এজন্য তঁাকে কী-কী করতে হবে জানতে চান। ১১ দিন উপবাস করতে হয়েছে। শুধু ডাবের জল খেয়ে থেকেছেন তিনি। এক কম্বলে রাত কাটিয়েছেন। মা শবরীর কথা উল্লেখ করে নিম্নবর্গের মানুষের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করে বলেছেন, উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণ নেতা তিনি নন।
একদা লালকৃষ্ণ আদবানি বলেছিলেন যে, নরেন্দ্র মোদি দারুণ সফল ইভেন্ট ম্যানেজার। দলের রাজকোষে শুধু টাকা থাকলেই হয় না। কর্পোরেট বিপণনে যেমন ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট একটা দীর্ঘ গবেষণা ও প্রশিক্ষণের ব্যাপার, সেভাবেই রামমূর্তি প্রতিষ্ঠার উৎসবকে দেশের প্রতিটি রাজ্যর সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে। ভাল স্ক্রিপ্ট যেমন বলিউড ছবির সাফল্য নিয়ে আসে, সেভাবেই এই উৎসবকে শুধু দলীয় ইভেন্ট হিসাবে না-বিচার করে সারা দেশের ইভেন্ট করে তোলার চেষ্টা হয়েছে।
এ-দেশের সংখ্যালঘু সমাজ চুপ। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে সংখ্যাগরিষ্ঠবাদের যে রাজনৈতিক আধিপত্য, সেখানে রাহুল গান্ধীর কংগ্রেস ‘প্রধান’ জাতীয় বিরোধী দল হলেও ‘বিকল্প’ হয়ে উঠতে পারছে না, আর সে-কারণেই হয়তো বহু মানুষের অসন্তোষও কার্পেটের নিচে লুক্কায়িত।
রামকে হিন্দু ধর্মের প্রতীক করা হলেও হিন্দু ধর্মে আছে নানা সম্প্রদায়। দ্বাদশ জে্যাতির্লিঙ্গ আছে, আছে ৫১টি শক্তিপীঠ। শঙ্করাচার্য ও রামানুজদের সমর্থকদের মধে্য লড়াইও এ-দেশের ইতিহাস। বিষ্ণুর পাশাপাশি শৈব ও শাক্ত প্রভাবও তো কম নয়। সেক্ষেত্রে, হিন্দু ধর্মের বৈচিত্রকে অবজ্ঞা করে, হিন্দু ধর্মকে শুধু ‘রাম ফ্যাক্টর’-এর সামনে রেখে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ধর্ম বলে প্রচার কি উচিত?
হিন্দু ধর্ম অন্যান্য ধর্মের থেকে এজন্য আলাদা কারণ, তা উদার বহুত্ববাদী জীবনচর্যায় বিশ্বাসী। একদেশদর্শী নয়। নাস্তিকরাও হিন্দু ধর্মেই থেকেছে। সাংখ্য-চার্বাকদের পাশাপাশি মূর্তির উপাসক নয়, এমন অদ্বৈতবাদীরাও আছে সেই ছাতার তলায়। আর এই কারণেই পশ্চিমবাংলায় এখনও এই মনোলিথিক হিন্দু ধর্মের মানসিকতা বাঙালি মানসিকতা নয়। কালীপুজো বা শিবরাত্রির দিন তবু বাঙালি উপোস করে। রামের জন্য তা কবে ও কোথায় হবে? ‘হিন্দুস্থান মডেল’ কার্যকর করার জন্য ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান কতটা বাংলায় কাজ করবে, সেটাই এখন প্রশ্ন। হিন্দি বলয়ে হিন্দু প্রধানমন্ত্রীর জাতীয় উৎসবের প্রভাব ভোটে পড়তেই পারে, কিন্তু বাংলা এখনও সম্ভবত ব্যতিক্রমী রাজ্য।