কিশোর ঘোষ: কবিতা এক আশ্চর্য দিকশূন্যপুর। যে দেশে সবাই রাজা! বাংলার এক রাজা যেমন রবীন্দ্রনাথ, অন্য রাজা জীবনানন্দ। জার্মান সাহিত্যের প্রসঙ্গ উঠলে ইয়োহান ভল্ফগাং ফন গ্যোটের কথা উঠবেই। কবি না হলেও বাঙালির অতি অতি অতি প্রিয় লেখক ফ্রানৎস কাফকাও আরেক জার্মান-ভাষা-রত্ন। এবং জনৈক রাইনের মারিয়া রিলকে, আধুনিক জার্মান তথা বিশ্বকবিতার অবিসংবাদিত সম্রাট। সেই রিলকের সার্ধশতবর্ষে ৪৮তম কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলার 'থিম দেশ' জার্মানি। এর চেয়ে ভালো কী-বা হতে পারত! এখানেই শেষ নয়, কলকাতা শহরে এসেছেন জার্মান কবি উলরিকে আলমুট জান্ডিগ। সুবোধ সরকার সম্পাদিত 'ভাষানগর' বইমেলা সংখ্যায় রয়েছে জান্ডিগের কবিতার বঙ্গানুবাদও। বইমেলার মাঠে 'ভাষানগরে'র কবিতার গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে কবিতাও পাঠ করলেন বিদুষী জান্ডিগ। অর্থাৎ কিনা কলকাতা বইমেলা যে 'আন্তর্জাতিক' তা কেবল কথার কথা নয়।
'ভাষানগরে'র সম্পাদক সুবোধ প্রথম থেকেই বাংলা কবিতার সঙ্গে ভারতীয় এবং আন্তর্জাতিক কবিতার সম্পর্ক নিয়ে ভেবেছেন। সেই কারণেই বছর বছর গুচ্ছ গুচ্ছ অনুবাদ কবিতা প্রকাশিত হয়েছে তাঁর পত্রিকায়। ২০২৫-এর বইমেলা সংখ্যাতেও সেই ঐতিহ্য অব্যাহত। যথেষ্ট সংখ্যক ভারতীয় কবিতার পাশাপাশি সুদীপ বসুর অনুবাদে প্যালেস্টাইনের জাতীয় কবি মাহমুদ দারউইশ, সন্দীপন চক্রবর্তীর অনুবাদে সিরিয়ান কবি নিজার কব্বানি, অনিন্দিতা গুপ্ত রায়ের অনুবাদে আমেরিকান কবি লুইস এলিজাবেথ গ্লুকের কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়াও বিশেষ গুরুত্ব সহকারে প্রকাশিত হয়েছে মার্কিন-প্যালেস্তিনীয় কবি নাথালি হান্ডালের কবিতা। জার্মান কবি জান্ডিগের মতোই নাথালিও এবার আমন্ত্রিত কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলায়। 'ভাষানগরে'র বর্তমান সংখ্যায় নাথালির কবিতা অনুবাদ করেছেন রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু-সহ অনেকে। এছাড়াও এই সংখ্যায় রয়েছে সদ্য নোবেলজয়ী দক্ষিণ কোরিয়ার লেখক হান কাঙের জীবন ও সাহিত্য নিয়ে জরুরি কাজ।
ভাষানগর বইমেলা সংখ্যা।
তবে কিনা বাঙালির প্রিয় কবি রিলকের সার্ধশতবর্ষে এক জার্মান কবির কলকাতায় আগমণ, বাংলা ভাষার সবচেয়ে বড় উৎসব কলকাতা বইমেলায় তাঁর অংশগ্রহণ আলাদা করে বড় ঘটনা। সুবোধ সরকার সম্পাদিত 'ভাষানগর' পত্রিকায় রয়েছে সুলগ্না মুখোপাধ্যায়ের অনুবাদে উলরিকে আলমুট জান্ডিগের কবিতাও। মেলার মাঠে ভাষানগর-এর 'কবিতার গাড়ি'র উঠোনে দাঁড়িয়ে বাংলার কবিদের সঙ্গে কবিতা পড়লেন জান্ডিগ। গায়ে কাঁটা দেওয়া সেই মুহূর্তের আগে উচ্ছ্বসিত জার্মান তরুণী বলেন---"আমাকে আমন্ত্রণের জন্য অন্তর থেকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই সকলকে। এমন আতিথেয়তায় সম্মানিত বোধ করছি। ভাষানগরের গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে কবিতাপাঠ-সহ কলকাতা বইমেলার প্রতিটি মুহূর্তকে উপভোগ করছি আমি।"
উল্লেখ্য, এই প্রথম নয়, 'ভাষানগরের কবিতার গাড়ি'র সামনের উঠোন আগেও হয়ে উঠেছে আন্তর্জাতিক কবিতার মঞ্চ। এর আগে সেখানে কবিতা পড়েছেন মার্কিন-কৃষ্ণাঙ্গ কবি নিল হল, বব হলম্যান, মুরাত নেমেত-নেজাত, এলিজাবেথ উইলিস, আদিনা কারাসিক প্রমুখ। এছাড়া আয়ওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডেনিস এই কবিতার গাড়ি থেকেই বাংলা বই কিনে নিয়ে গিয়েছেন দেশে। এই গাড়ির সামনে সারাদিন বসে কবিতাপাঠ শুনেছেন সাহিত্য অকাদেমির প্রাক্তন সভাপতি কন্নড় ভাষার কবি-নাট্যকার চন্দ্রশেখর কাম্বার।
পুনশ্চ: 'ভাষানগর' বইমেলা সংখ্যার আরও দুই আকর্ষণের কথা না বললে নয়। প্রথমত, সুনির্মল দাসের নেওয়া দার্শনিক অরিন্দম চক্রবর্তীর দীর্ঘ সাক্ষাৎকার। দ্বিতীয়ত, 'তুখোড় বাংলা' বলা বহু ভাষাবিদ হাইডেলবার্গ ইউনিভার্সিটির মর্ডান সাউথ এশিয়ান ল্যাঙ্গুয়েজ অ্যান্ড লিটারেচার বিভাগের অধ্যাপক হানস হার্ডারের বাউল-ফকির সঙ্গ। বর্তমান পত্রিকায় যে ধারাবিবরণী লিখিত হয়েছে তরুণ কবি অরুণাভ রাহারায়ের কলমে। আরেকটি মিষ্টি কথা, এবারের কবিতার গাড়িটি ছবি এঁকে সাজিয়েছে দশম শ্রেণির ছাত্রী অহনা বন্দ্যোপাধ্যায়।
