shono
Advertisement

‘পরিযায়ী শ্রমিক থেকে আমাকে ঘরে ফিরিয়েছে গল্পই’, জানাচ্ছেন সদ্য যুব অকাদেমি জয়ী হামিরউদ্দিন

রাজমিস্ত্রিদের সহায়ক হিসাবে কাজ করার সময়ও লেখার স্বপ্নকে ছাড়েননি হামিরউদ্দিন।
Posted: 03:57 PM Jun 27, 2023Updated: 09:40 PM Jun 27, 2023

সোনামুখী থেকে সাহিত্য অকাদেমি। রূপকথার মতো শোনালেও এ-যাত্রাপথে মিশে আছে ঘাম-শ্রম-সংগ্রামের ইতিবৃত্ত। মিশে আছে জেদ আর লড়াইয়ের অকথিত কাহিনি। আর আছে লেখার প্রতি নিবিড় টান। সেই লেখাই তাঁকে পরিযায়ী শ্রমিক থেকে ফিরিয়ে এনেছিল ঘরে। জীবন থেকে উঠে আসা গল্প আর গল্পজীবনের সেই কথাই সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল-কে একান্ত সাক্ষাৎকারে জানালেন সদ্য যুব অকাদেমি পুরস্কার পাওয়া তরুণ লেখক হামিরউদ্দিন মিদ্যা। লিখলেন সরোজ দরবার

Advertisement

প্রশ্ন: সোনামুখী থেকে সাহিত্য অকাদেমি- জীবনের এই যাত্রাপথে নিশ্চিত অনেক বিস্ময় জমা হয়ে আছে। নিজের কাছেও কি এই অক্ষরযাপন আশ্চর্যের মনে হয়?

হামিরউদ্দিন মিদ্যা: আশ্চর্য তো বটেই! তবে লেখালিখি যখন শুরু করেছিলাম, তখন তো এত কিছু ভেবে লিখতে বসিনি। আমি প্রত্যন্ত এলাকার ছেলে। মনের ভিতর অজস্র গল্প ঘনিয়ে ওঠে। নিজের মনে সেই সবই লিখতে শুরু করেছিলাম। তখন শুধু মনে হত, আমার এই গল্পগুলো যদি অনেকের কাছে পৌঁছায় তাহলে বড় ভাল হয়। যদি কোনও পত্রিকায় প্রকাশ পায়, তাহলে সেটাই আমার কাছে দারুণ প্রাপ্তি হবে। আমাদের এখান থেকেই প্রকাশিত হয় ‘লগ্নঊষা’ পত্রিকা। সেই পত্রিকা আয়োজিত সাহিত্যবাসরে আমি গল্প পড়ে শোনাতাম। তখন সবে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছি। সেইসব সাহিত্যসভায় উপস্থিত থাকতেন সায়ন্তন মুখোপাধ্যায়, শ্যামল মুখোপাধ্যায়, জয়দেব দত্ত, অসিত বেড়ের মতো বলিষ্ঠ গল্পকাররা। তাঁরা আমার গল্পের প্রশংসা করতেন। আরও লেখার উৎসাহ দিতেন। সেই উৎসাহেই লেখালিখিতে আরও একটু এগিয়ে যাওয়া। এই পত্রিকাতেই আমার প্রথম গল্প ছাপা হয়। তারপর বিভিন্ন পত্রিকাতে গল্প পাঠাতে শুরু করি।

[আরও পড়ুন: প্রধানমন্ত্রীর নিশানায় বিরোধী মহাজোট, বাংলা নিয়ে দুর্নীতি তোপ মোদির]

আমার একটি গল্প যখন কলকাতার পত্রিকায় ছাপা হল, তখন সকলে আমার লেখার ব্যাপারে উৎসাহী হয়ে ওঠেন। পরে চন্দনগর গল্পমেলায় গল্প পড়তে গিয়ে শ্রদ্ধেয় সাহিত্যিক অমর মিত্রের সঙ্গে আলাপ হয়। উনি সেই গল্পটি আর এক ওয়েব পত্রিকায় ছাপার ব্যবস্থা করেন। তখন পাঠকমহলে একটু বেশি পরিচিতি পেলাম। সেই সময় থেকে একটা বই হওয়ার স্বপ্ন দেখতাম। সে স্বপ্ন পূরণ হল ২০১৯ সালে, ‘সৃষ্টিসুখ’ থেকে প্রকাশিত হল আমার গল্পের বই ‘আজরাইলের ডাক’। বই প্রকাশের আগে থেকেই জেলার প্রতিশ্রুতিমান গল্পকার হিসাবে পরিচিত হয়েছিলাম। ‘গল্পলোক’ পত্রিকার তরফে সেই স্বীকৃতিও পেয়েছিলাম। আর এ বছর তো ‘মাঠরাখা’ গল্পগ্রন্থের (প্রকাশক: সোপান) জন্য অকাদেমির স্বীকৃতি এল। আমার এগিয়ে যাওয়া এভাবেই ধাপে ধাপে। লেখাই আমার অবলম্বন কিংবা অস্ত্র। সে-ই আমাকে জোর দিয়েছে। কখনও পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি।

প্রশ্ন: এ যেমন লেখার জার্নি, তেমন জীবনও তো অনেক পরীক্ষার মুখে ফেলেছে। এক সময় তো উপার্জনের কারণে ঘরও ছাড়তে হয়েছিল। যেতে হয়েছিল অন্য রাজ্যে। সেখান থেকে লেখায় ফেরা কীভাবে সম্ভব হল?

হামিরউদ্দিন মিদ্যা: সেটা ওই ২০১৫ সালেই। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষে দিশাহারা হয়ে ঘুরছি। বাড়ির আর্থিক অবস্থা ভাল নয়। পড়াশোনা সেভাবে এগনোর উপায় নেই। কিছু তো একটা করতে হবে। এই ভাবনা থেকেই গ্রামের কয়েকজনের সঙ্গে কেরলে চলে গিয়েছিলাম। রাজমিস্ত্রিদের সহায়ক হিসাবে কাজ করার জন্য। তখন সবে ওই গল্প পড়ার ব্যাপারটা শুরু হয়েছে। কিন্তু কোনও গল্প পত্রিকায় বেরোয়নি। কেরলে তো সারাদিন কাজ। তার উপর মেসে একসঙ্গে অনেকে মিলে ঠাসাঠাসি করে থাকা। ইচ্ছে থাকলেও, সেখানে লেখা বা পড়ার সেরকম পরিবেশ ছিল না।

ওখানে কাজ করতে করতেই একদিন খবর পাই যে, পত্রিকায় আমার গল্প বেরিয়েছে। তখন অনেকেই ফোন করে খোঁজ নিলেন আমার ব্যাপারে। কেন আমি লেখালিখি করছি না তা-ও জানতে চাইলেন। তখন আমার মনে হল, কেরলে আর থাকব না। বাংলাতেই ফিরে যাব। যা-ই হোক করে উপার্জনের একটা ব্যবস্থা করব। কিন্তু লেখা কখনও ছাড়ব না। আমার গল্পই সেদিন আমাকে প্রবাস থেকে নিজের মাটিতে ফিরিয়ে এনেছিল।

[আরও পড়ুন: ‘উদ্দাম যৌনতার সাক্ষী বন্ধু…’, লালসার গল্প শোনালেন কঙ্কনা সেনশর্মা]

প্রশ্ন: এই যে নিয়ত দারিদ্র্যের সঙ্গে সংগ্রাম, এর ভিতরও গল্প লেখার মন বা তাগিদটা বাঁচিয়ে রাখেন কীভাবে?

হামিরউদ্দিন মিদ্যা: আমার একটা জেদ আছে যে, আমি লিখব। এই জেদই আমার জ্বালানি। মাঠে কাজ করে যখন ক্লান্ত হয়ে যাই, অনেক কষ্ট হয়, তখন এই জেদই আমাকে লেখার কাছে ফিরিয়ে আনে। তা ছাড়া কত মানুষ ভালবাসেন। বহু বরিষ্ঠ লেখক উৎসাহ দেন আমার লেখালিখিতে। ভাবি, আমি যদি লেখা বন্ধ করে দিই, তাঁদের সেই স্নেহ আর আবেগকেও হয়তো মর্যাদা দেওয়া হবে না। এইসব ভাবনাতেই শত কষ্ট সত্ত্বেও আমি লেখালিখিকে এগিয়ে নিয়ে যাই।

প্রশ্ন: এই সময়ের লেখাপত্র জীবনবিচ্ছিন্ন বা রাজনীতিবর্জিত এরকম অভিযোগ কোনও কোনও মহল থেকে আসে। আবার আপনার গল্পভুবন মাটি ও জীবনসংলগ্ন এরকম কথাই শোনা যায়। আপনি নিজে এই সময়ের লেখালিখির জগৎকে কীভাবে দেখেন?

হামিরউদ্দিন মিদ্যা: আমি তো অনেক গল্প পড়ি। যাঁরা এরকম অভিযোগ করেন, তাঁরা সম্ভবত ঠিক কথা বলেন না। আসলে নির্দিষ্ট কয়েকটি পত্রপত্রিকাতেই লেখালিখি সীমাবদ্ধ নেই। জেলা-মফস্‌সল থেকে অনেক পত্রিকা প্রকাশিত হচ্ছে। অনেক ওয়েবজিনে দারুণ দারুণ সব গল্প প্রকাশিত হচ্ছে। সেসব লেখায় জীবনের গন্ধ আছে। রাজনীতিও আছে। যে লেখক এই সময়ের ভিতর দিয়েই যাচ্ছেন, তিনি রাজনীতি স্পর্শ করবেন না কেন! আমার মনে হয়, আমাদের পাঠ-পরিধি যদি আর একটু প্রসারিত হয়, তাহলে আর এ অভিযোগ থাকে না। এই সময়ও খুব ভাল ভাল লেখা হচ্ছে। খুঁজে পড়তে হবে।

প্রশ্ন: বাইরের আলোচনা বা সমালোচনা কখনও আপনার লেখাকে প্রভাবিত করেছে?

হামিরউদ্দিন মিদ্যা: আমি তো থাকি কলকাতা থেকে অনেক দূরে। শহরে খুব কমই যাই। যে সব আড্ডার কথা শুনি, সেখানেও আমার যাতায়াত নেই। আমি আমার গ্রামে নিরিবিলিতে বসে আমার গল্পটাই লিখে যাচ্ছি, আর সেটাই করে যেতে চাই। কিছু কথা কানে আসে। সাময়িক হয়তো একটা খারাপ লাগাও তৈরি হয়। তবে সে সব আমার লেখাকে প্রভাবিত করে না।

প্রশ্ন: যুব অ্যাকাডেমি পুরস্কার পাওয়ার পর জীবনে কি কোনও পরিবর্তন এল?

হামিরউদ্দিন মিদ্যা: আমি তো একই আছি। আমার কোনও পরিবর্তন নেই। তবে যে পাঠকরা আমার নাম জানতেন না, তাঁরা এখন জেনেছেন। আমার কাছে লেখা চাওয়া বেড়েছে। যাঁরা হয়তো আগে সেভাবে গুরুত্ব দিতেন না, তাঁরা এখন বাড়তি গুরুত্ব দিচ্ছেন। এ ছাড়া আমার নিজের কোনও পরিবর্তন হয়নি। তবে একটা কথা বলতে চাই, আমার জেলা এই পুরস্কারকে খুব ভালভাবে গ্রহণ করেছে। আমি যে কী করি, তা অনেকেই জানতেন না। তাঁরা এখন জেনেছেন। খোঁজ নিচ্ছেন। কেউ কেউ বাড়িতেও এসেছেন। সেগুলো অবশ্যই ভাল লাগার বিষয়। তাঁদের আনন্দ দেখে মনে হচ্ছে, নিজের মাটিতেও যেন স্বীকৃতি পেলাম।

প্রশ্ন: অনেক লেখার চাপ বাড়লে, লেখাও তো খানিক বদলে যেতে পারে, নাকি?

হামিরউদ্দিন মিদ্যা: না আমি আমার লেখাই লিখে যাব। আমার ভূমি, আমি যে মানুষের কথা বলে যাচ্ছি তাঁদের কথাই আমার লেখায় বলে যাব। লেখা যদি সময়ের সঙ্গে বদলে যায় তো আলাদা কথা। বা আমার পাঠকরা যদি আমার লেখার ভিতর দিয়ে অন্য কিছু চান, সেটা গুরুত্ব দিয়েই ভাবব। আমি ফর্ম নিয়ে বিশেষ ভাবি না। আমার কাছে বিষয়টা গুরুত্ব পায় বেশি। আমাদের গ্রামবাংলায় এখনও এমন বহু বিষয় আছে যেগুলোর কথা সেভাবে বলা হয়নি। আমি সেই কথাগুলো সহজ-সরল ভাবেই বলে যেতে চাই।

প্রশ্ন: এর আগেও আপনি যুব সাহিত্য অ্যাকাডেমির মনোনয়ন পেয়েছেন। এবার পেলেন। আজকের হামিরউদ্দিন মিদ্যা সেদিনের হামিরউদ্দিনকে ঠিক কী বলে?

হামিরউদ্দিন মিদ্যা: একটাই কথা বলে যে, ব্যর্থ হতে হতেই সাফল্য আসে। বহু মানুষ ভালবাসেন। অনেকে স্নেহ করেন। পুরস্কার তো শুধু আনন্দের জিনিস নয়। একটা দায়িত্বও তো চলে এল। নতুন লেখায় সেই দায়িত্ব পালনেরই চেষ্টা করে যাব।

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement