নির্মল ধর: কবিতার একটা লাইন - 'পাগলই আজ সবচাইতে বড় সত্যবাদী!' হ্যাঁ, কবির সেই লাইনটির ওপর ভর করেই আজ থেকে প্রায় বছর ১২/১৩ আগে দেবল গুহ রায় নামের এক তরুণ 'পাগলা রে' নাটকটি লিখেছিলেন। অভিনয় শুরু হয় আরও কিছু বছর বাদে। শঙ্খ ঘোষ, শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়ের শুভেচ্ছাপ্রাপ্ত নাটকটি এখনও অনিয়মিত ভাবে হলেও মঞ্চস্থ হচ্ছে এই শহরের মঞ্চে। কিছুদিন আগে দেখা গেলো অ্যাকাডেমিতে।
দেবলের চিন্তাভাবনায় সমাজ সচেতনতার ছবি স্পষ্ট। তিনি সেই সময় থেকেই উপলব্ধি করেছিলেন প্রকৃত সত্য। সেকথা বলতে গেলে শাসক গোষ্ঠী কখনই তাঁকে সহজে ছাড়বে না। সুতরাং একজন পাগল চাই তাঁর। সেই পাগলের মুখ দিয়েই তিনি 'ওতো পাগলের কথা'র মোড়কে সমাজের প্রকৃত ছবি শুধু নয়, অনেক অনৃত সত্যও প্রকাশ করা যাবে। এবং সেজন্যই এই নাটকের পটভূমি এক 'রিহ্যাব', আর সেখানে থাকে স্বপ্ননীল (দেবল গুহ রায়) নামের এক পাগল। থাকে মীরা (স্মৃতি সান্যাল) নামের এক তরুণী, যে ধর্ষিতা হওযার কারণে স্বজন পরিত্যক্তা হয়ে ওই রিহ্যাবের নার্স এখন। আছেন ডাক্তার ডা. মহেশ (তাপস সিংহ)। এদের সংলাপ বিনিময়ের মধ্য দিয়েই উঠে আসতে থাকে রাজনীতি, দুর্নীতি, সমাজের কুটিল চেহারা এবং চিরকালীন কিছু সত্যভাসন। যার মধ্যে দর্শক খুব সহজেই খুঁজে পান আজকের দিনগুলোকেও।
স্বপ্ননীলের মুখেই শুনতে পাই শঙ্খ ঘোষের কবিতা। সে সাবলীল স্বরেই বলে 'আজ যার রাজ্যপাট, কাল কি তার থাকে!' সে চায় সবার ভেতরের স্বপ্নগুলো নিয়ে এক 'স্বপ্নবৃক্ষ' তৈরি করতে। মীরা তার কথায় উদ্বুদ্ধ হয়, জীবনকে সে নতুন করে গড়ার স্বপ্ন দেখে। কিন্তু সব স্বপ্ন তো সবসময় পূরণ হয় না। হঠাৎ সেখানে আবির্ভাব ঘটে এক পুলিশের। পাগল স্বপ্ননীল তাঁর টার্গেট। দুজনায় মুখোমুখি হলে বোঝা যায় সত্যবাদী পাগলকে আর প্রশাসন প্রশ্রয় দিতে চায় না। অগত্যা এক সাজানো দুর্ঘটনায় 'মৃত্যু' ঘটে স্বপ্ননীলের। মীরার স্বপ্নও ভেঙে যায়।
নাটকের সমাপ্তি বুঝিয়ে দেয় এই সমাজে প্রকৃত সত্যকথনের কোনও স্থান হয় না, হবে না। নাট্যকার, পরিচালক এবং প্রধান চরিত্র - তিন ভূমিকাতেই দেবল গুহ রায় ডিস্টিংশন নম্বর নিয়ে পাশ করে গেছেন। তাঁর কলমে সংলাপের ভার যেমন ওজনদার, তেমনি নির্দেশনার কারিকুরিগুলো খুব সহজ-সরল হয়েও তীব্র ও তীক্ষ্ম। সুধা মাসির চরিত্রটি এনে পুরো নাটকের শরীরে দেবল এক অপূর্ণ স্বপ্নের চাদর জড়িয়ে দিয়েছেন। ইমন ও কলাবতীর এপিসোড সেখানে একটু বাড়তিই মনে হয়।
আজকের চলমান ঘটনার সঙ্গেও কোথায় যেন এই নাটকের সুর মিলে যায়। যে জন্য নাটক শেষ হওয়ার পর দর্শকের মধ্য থেকেও স্বর ওঠে 'উই ওয়ান্ট জাস্টিস!' দর্শকদের কাছে নাটকটির বিষয় ও ঘটনা অন্য সময় ও প্রেক্ষিতে হলেও কোথায় যেন চিরকালীন এক বার্তা দিয়ে যায়। সেজন্য অবশ্যই ধন্যবাদ দিতে হবে দেবলের পাশাপাশি তিনজন অভিনেতাকে - মীরার ভূমিকায় স্মৃতি, ডাক্তার মহেশের চরিত্রে তাপস এবং পুলিশের চরিত্রে আশিস রায়কে। স্মৃতির অভিনয় এই প্রযোজনার এক বাড়তি প্রাপ্তি। 'প্রত্যয়' নাট্যদলের এই প্রযোজনা বুঝিয়ে দিল বাংলা নাটকের কিছু দল এখনও শিরদাঁড়া সোজা রেখে কাজ করায় বিশ্বাসী, শিরদাঁড়া নিচু করে নয়।