নির্মল ধর: আরব্য রজনীর অন্যতম একটি কাহিনি 'আলাদীন'কে নিয়ে। সেটা রূপকথা, কল্পকথা না লোককাহিনি- সেটা বড় কথা নয়। আসল কথা হল, অত বছর আগে লেখা হলেও, আলাদীন কাহিনির মধ্যে মানুষের লোভ, লালসা, ক্ষমতার ক্ষুধা, স্বার্থপরতা এসব চিরকালীন দোষ-গুণের পরতগুলো সুন্দর বুনে দেওয়া হয়েছে। এবং আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, তরুণ পরিচালক সানি চট্টোপাধ্যায় তাঁর আগের প্রোডাকশন 'তুঙ্গভদ্রার তীরে'র মতো করেই মঞ্চমায়া দিয়ে সুন্দর সাজিয়েছেন এই 'আলাদীন'কে। নাটকওয়ালা কলকাতার প্রযোজনায় নাটকটি কিছুদিন আগে মঞ্চস্থ হল জ্ঞানমঞ্চে।
সহজ-সরল তরুণ আলাদীন আগ্রা শহরে ঘুরতে এসে সুলতানকন্যা বদর জেসমিনের প্রেমে পড়ে যায়। অন্যদিকে সুলতানের ষড়যন্ত্রমন্ত্রী জাফর চায় সুলতানকন্যার হাত। আশ্চর্য প্রদীপ করায়ত্ত করার ফলে আলাদীন ও জেসমিনের প্রেম গাঢ় হয়। আর চক্রান্ত করে আলাদীনের কাছ থেকে প্রদীপটি হাতিয়ে নেয় জাফর। কীভাবে এরপর আলাদীন জিনকে সরিয়ে জাফরকে হারিয়ে রাজকুমারীকে জয় করে সুলতানের হৃদয় বদল করে, সেই গল্প সবার জানা। কিন্তু মঞ্চে প্রায় আড়াই ঘন্টা বসে দেখার একমাত্র কারণ পরিবেশনার কারুকার্য! ঝলমলে পোশাক (সংহিতা- জ্যোতির্ময়-ঊষা), বাহারি আলোকসজ্জা, চোখ টানার মতো মঞ্চ পরিকল্পনা (সবই সানি চট্টোপাধ্যায় কৃত) সবকিছু এমন উচ্চকিত যে, নাটকের বক্তব্য অনেকটাই যেন চাপা পড়ে যায়।
বাস্তবকে শিল্পের ছোঁয়া দিতে গিয়ে সাধারণ মানুষ যে সামাজিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অব্যবস্থার শিকার হয়ে পড়ছেন- সেই বার্তাটি কিঞ্চিৎ হারিয়ে যায়। ভঙ্গি দিয়ে চোখ ভোলানোর কারুকাজটাই প্রকট হয়ে ওঠে। তবে হ্যাঁ, শিল্পীদের অভিনয় কিন্তু পরিচালক সানির পরিবেশনার উজ্জ্বলতার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সমান তালে চলেছে। দুটি নাম সবার আগে - আলাদীনের চরিত্রে শুভ্রদীপ বণিক ও জিনের ভূমিকায় সানি চট্টোপাধ্যায়। একজন যেমন সারল্যের প্রতীক, তেমনি অন্যজন জাদুকরী ক্ষমতায় বেশ ধুরন্ধর ভঙ্গিটি সুন্দর সাবলীলভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। এক নম্বর বেশি শুভ্রাদীপই আদায় করে নেন তাঁর শরীরী মুভমেন্ট দিয়ে! জাফরের চরিত্রে অরিন্দম সরদার কুটকচালির ব্যাপারটা স্পষ্ট করেছেন। সুলতানের ভূমিকায় চিরঞ্জিত দাশ মাথায় কিম্ভুত আকারের পাগড়িটি নিয়ে কিছুটা বেসামাল হলেও, সবটাই 'ম্যানেজ' করে নিয়েছেন মঞ্চে। রাজকুমারী সেজে নিশা হালদার ও পাখি সেজে কৌশিক খাঁও সমবেত অভিনয়ের সঙ্গে সঙ্গতি রেখেছেন। তবুও পরিশেষে বলতেই হচ্ছে, এবার পরিচালকের উপস্থাপনার চাকচিক্যের সঙ্গে বার্তা দেওয়ার ক্ষেত্রেও একটু সচেতন হওয়া প্রয়োজন।
