সরোজ দরবার: প্রতিবাদ এবং প্রতিরোধের সাহিত্য নিয়ে বাঙালির এক রকমের নস্ট্যালজিয়া আছে। সেই নিরিখেই যেন এখন তার অনুযোগ, সাহিত্যিকরা বোধহয় আর এই বিষয়ে ততখানি মনোযোগী হতে পারছেন না। গায়ে গায়ে আর একটা প্রশ্নও চলে আসে যে, দৃশ্যশ্রাব্য মাধ্যমের এই অলিখিত সর্বময়বাদী কর্তৃত্বের ভিতর লিখিত অক্ষর কি সেভাবে আর প্রতিবাদের বয়ান হয়ে উঠতে পারে? আশার কথা যে, বই আজও সে ভূমিকা পালনে দক্ষ। সাম্প্রতিক একটি বই যেভাবে প্রতিবাদের আখর হয়ে একটি পেশার সঙ্গে যুক্ত অনেক মানুষকে সংঘবদ্ধ করতে পারল, তাতে এই আশা আরও জোরদারই হয়। রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়ের 'নির্দোষ আসামির ডায়েরি' (প্রকাশক: দে'জ) তাই আলাদা আলোচনারই দাবি রাখে। সম্প্রতি বইটির প্রকাশের এক মাস উপলক্ষে যে আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছিল তা নতুন করে জানিয়ে দিল অক্ষরবৃত্তে আত্মীয়তা আর শক্তির উদ্ভাস।
এদিনের আলোচনাচক্রে লেখক রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায় শোনাচ্ছিলেন বইয়ের নেপথ্য-প্রসঙ্গ। বইটি আঙ্গিকে উপন্যাস। তবে তা নেহাত কল্পকাহিনি নয়। গল্পের পরতে মিশে আছে সত্যি একটি ঘটনার অনুষঙ্গ। আরও স্পষ্ট করে বললে, সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য এক সাংবাদিকের ব্যক্তিগত লড়াইয়ের ইতিবৃত্ত। রাজর্ষি নিজেও পেশায় সাংবাদিক, এবং এটিই তাঁর প্রথম বই। অতএব তিনি যে এই বিষয়টিকেই তাঁর আখ্যানের উপজীব্য করলেন, তার নির্দিষ্ট কারণ আছে। সে-কথা জানিয়েই রাজর্ষি বলছিলেন, "সাংবাদিক কখনও ভাবেনি যে, সে প্রতিবাদ করে উঠতে পারবে। অথচ কাজের ক্ষেত্রে হেনস্তা তো তাকেও কম পোহাতে হয় না! ক্ষমতার উপরের স্তরে যাঁরা থাকেন, তাঁরা একজন সাংবাদিককে হয়তো মানুষ বলেই গণ্য করেন না। তাই একজন সাংবাদিককে যখন একটি সংস্থা নির্বাসিত করল, তখন অনেকেই চুপ করে ছিলেন। আমিও প্রথমে দু-পক্ষের কথা শুনিনি। পরে যখন শুনলাম, তখন এই প্রতিবাদকে লিখে রাখার তাগিদ অনুভব করলাম।" পাঠক এর পাশাপাশি মিলিয়ে নিতে পারবেন বিশিষ্ট ক্রীড়া সাংবাদিক বোরিয়া মজুমদারের জীবনে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনার কথা। তিনি ইংরেজিতে লিখেছিলেন তাঁর নির্বাসিতের আত্মকথা। সেই ঘটনা অনুঘটক হয়ে উঠেছে রাজর্ষির উপন্যাসের ক্ষেত্রে। রাজর্ষি তা ধরিয়ে দিয়ে বললেন, "বোরিয়াদা যে কাজটি করেছেন, তা সৎ সাহসের পরিচয় দেয়। পৃথিবী অন্তত জানল, একজন সৎ সাংবাদিককে যতই হেনস্তা করা হোক না কেন, যত ভাবেই দমিয়ে রাখা যাক না কেন, তিনি অন্তত একটি বই লিখতে পারবেন। তাঁর প্রতিবাদ ছড়িয়ে দিতে পারবেন একটা গোটা ফ্র্যাটার্নিটির মধ্যে। এই বিশ্বাসটা উনি চারিয়ে দিতে পেরেছেন। আর সেটাই আমার এই উপন্যাসের চালিকাশক্তি।"
[আরও পড়ুন: কুস্তিগিরদের বিক্ষোভ, কৃষক অসন্তোষ, হরিয়ানার অগ্নিপথে অগ্নিবীররাই কাঁটা বিজেপির]
এদিনের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বোরিয়া মজুমদার নিজেও। অনেকটা সেই কাফকার জোসেফ কে-র মতোই যিনি একদিন বিনা দোষে দোষী সাব্যস্ত হয়ে গিয়েছিলেন। সেও ছিল এক ট্রায়াল, আর বোরিয়ার ক্ষেত্রে প্রায় অনিবার্য ভাবে নেমে আসে সোশ্যাল মিডিয়া ট্রায়াল। বিপর্যস্ত হয় তাঁর পরিবার। নেমে আসে পেশার জগতে নির্বাসন। তবে সেই সংকটকালে তিনি এলোমেলো হয়ে যাননি। বরং কষ্ট জমিয়ে জমিয়েই লিখেছেন আগুনের বর্ণমালা। তাঁর নিজের বইও প্রকাশিত হয়েছে। আবার তাঁর জীবনের ঘটনা জন্ম দিয়েছে একটি বাংলা উপন্যাসেরই। বোরিয়া তাই বলছেন, "রাজর্ষি তো এই বিষয়ে না লিখলেই পারত! অন্য যে কোনও বিষয় বেছে নেওয়া ওর কাছে সহজ ছিল। তবে আমার যে যন্ত্রণা, কষ্ট তার সঙ্গে ও একাত্ম বোধ করেছে। তাই কলম তুলে নিয়েছে। এ-ও আসলে একরকমের সাহস জোগানোই। আজ তো বোঝাই যাচ্ছে, এখনও প্রতিবাদের হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে বই। কেউ যদি একজন সাংবাদিককে হেনস্তা করতে যান, তো অন্তত দশ বার ভাববেন যে, ওর একটা বই লেখার ক্ষমতা আছে।"
বোরিয়া জানাচ্ছিলেন, যে এই বইকে কেন্দ্র করে এখন যেন একটি ছোট সংঘ গড়ে উঠেছে। যাঁরা একদা তাঁর দিকে অভিযোগের আঙুল তুলেছিলেন, তাঁর থেকে দূরত্ব বজায় রাখছিলেন, এখন তাঁরাই বলছেন যে, এই বই থেকে তাঁরা জীবনে লড়াইয়ের প্রেরণা পাচ্ছেন। অনেক সাংবাদিকও এখন পাশে আছেন। যাঁরা সম্মিলিত ভাবে একটি লড়াইকে রূপ দিচ্ছেন। সেই লড়াই কোনও ব্যক্তির নয়। বরং ব্যক্তি থেকে তা গড়িয়ে যাচ্ছে সমষ্টিতে। সামগ্রিক ভাবে ক্রীড়া সাংবাদিকতার বা আরও বড় করে বলতে গেলে সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত মানুষদেরই এই বই যেন একত্রিত করতে পেরেছে। কেননা সকলেই ক্রমে বুঝতে পারছেন যে, একজনের বিপর্যয়ে উল্লসিত হওয়ার মতো বিপর্যয় আর নেই। আদতে এই প্রবণতা ভেঙে দিতে পারে সাংবাদিকতার যৌথ পরিবার। অতএব একতা জরুরি। আর তা যদি একটি বা দুটি বইয়ের হাত ধরে হয়, তবে তার থেকে ভালো আর কী-ই বা হতে পারে!
অনুষ্ঠানের এই মূল বক্তব্যের সঙ্গে পুরোপুরি সহমত বইটির প্রকাশক শুভঙ্কর দে। তিনি বললেন, "প্রথমত, বই পড়া যে কমেছে এটা সর্বাংশে সত্যি নয়। প্রতি প্রজন্মই তার পরের প্রজন্মকে হয়তো এই দোষটা দিয়ে থাকে। তবে আমি তো নিজে বইবাজার করে দেখেছি যে, তরুণদের মধ্যে আজও বই নিয়ে কী বিপুল আগ্রহ। আর 'নির্দোষ আসামির ডায়েরি' বইটির কথাই যদি ধরি, তাহলেও সেই একই আগ্রহ দেখতে পাচ্ছি। মাসখানেক হল বইটি বেরিয়েছে। এর মধ্যে বহু পাঠক বইটি কিনে নিয়ে গিয়েছেন। আসলে তো এই গল্প এক প্রতিবাদের। নিশ্চিত যাঁরা কিনছেন, তাঁরা বইকে আজও প্রতিবাদের পথ হিসাবেই ভাবেন। সেই জায়গাটি কিন্তু এখনও খোলা আছে।"
[আরও পড়ুন: বাবা আদনান ভারতে, সেই সুযোগে পাকিস্তানে মাহিরার সঙ্গে প্রেমে মশগুল ছেলে আজান!]
অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করতে করতেই অগ্নিজিৎ সেন ধরিয়ে দিয়েছিলেন মার্টিন নিম্যোলারের সেই বিখ্যাত কবিতাটির কথা। যে কবিতার বক্তব্য ছিল, কমিউনিস্ট, ট্রেড ইউনিয়নের লোক, ইহুদিদের যখন 'ওরা' ধরে নিয়ে গেল, তখন 'আমি' চুপ করে ছিলাম। আর যখন আমাকে ধরতে এল, তখন আর আমার পক্ষে কথা বলার কেউ ছিল না। এই 'আমি' আর 'ওরা' তো কোনও ব্যক্তি নয়। সময় পেরিয়ে তাই এ-কবিতা চিরকালীন, প্রাসঙ্গিক। এই বই-ও যেন সেই মৌলিক প্রশ্নটিই নতুন করে জাগিয়ে দিয়েছে। এখন, 'আমি' আর 'ওরা'কে চিনে নেওয়ার দায়িত্ব পাঠকেরই।